আবারও এনবিআর সার্ভারে অনুপ্রবেশ, শীর্ষ কর্মকর্তার আইডিতে পণ্য খালাস
ইয়া চেন টেক্সটাইল করপোরেশনের বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (বিন) চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার ইউজার আইডি ব্যবহার করে সচল করে অন্তত ৩টি চালানে ৪০ টন পণ্য খালাস করে নিয়েছে একটি চক্র।
অথচ, ৮ কোটি ৬০ লাখ টাকার রাজস্ব ফাঁকি ও রপ্তানি না করে পণ্য খোলাবাজারে বিক্রির দায়ে কুমিল্লা ইপিজেডে অবস্থিত ইয়া চেন টেক্সটাইল করপোরেশনের কার্যক্রম গত ১ মার্চ বন্ধ করে দেয় চট্টগ্রাম কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট।
পণ্য খালাসের সময় কাস্টমসে দাখিলকৃত আমদানি অনুমতিপত্রসহ (আইপি) বেশকিছু আমদানি নথি জাল হওয়া সত্ত্বেও পণ্য চালানগুলো গত জুন ও জুলাইয়ে ছাড় দিয়েছেন কাস্টমসের কর্মকর্তারা। কোনো ধরণের তদারকি ও পরীক্ষণ ছাড়া খালাস হওয়ায় এসব চালানে কী ধরনের পণ্য ছিল, তা জানে না কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের অতিরিক্ত কমিশনার আবু নূর রাশেদ আহমেদের ইউজার আইডি ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানের বিন লক খুলে দেওয়া হয়েছে এবং পরবর্তীতে শুল্কায়ন কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে তৌহিদুল ইসলাম নামে একজন রাজস্ব কর্মকর্তারা ইউজার আইডি ব্যবহার করে।
এর আগে গত ১ বছরে অন্তত ২১টি আমদানি চালান এনবিআর সার্ভারে অনুপ্রবেশ করে কোনো ধরণের তদারকি ছাড়াই খালাস নেয় একাধিক চক্র। এসব বিষয় জড়িতদের চিহ্নিত করতে কাস্টমস একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করলেও জড়িতদের শনাক্তে ব্যর্থ হয়েছে।
এসব জালিয়াতি রোধে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি সার্ভার সুরক্ষায় কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হলেও তা কাজে আসেনি।
সম্প্রতি ছাড়িয়ে নেওয়া ৩টি চালানের নথি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এসব পণ্য খালাসে ভুয়া নথি দাখিল করলেও ব্যবস্থা নেননি কাস্টমসের শুল্কায়ন কার্যক্রমে জড়িত কর্মকর্তারা। পণ্য আমদানি থেকে খালাসের প্রতিটি ধাপে অনিয়ম থাকলেও কোনো ধরনের তদারকি ছাড়াই খালাস দেওয়া হয়েছে ৪০ টন পণ্যের এসব চালান।
এমনকি শুল্কায়নের প্রাথমিক ধাপে বেপজার অনুমতিপত্রের (আইপি) যাচাই বাধ্যতামূলক হলেও তা করেননি শুল্কায়নে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা। জাল আইপি দাখিল ও ভুল ওয়্যারহাউজ কোড ব্যবহার করা হলেও পণ্য খালাসে কোনো ধরনের আপত্তি করেননি কাস্টমস কর্মকর্তারা।
এনবিআর সার্ভারের তথ্য অনুযায়ী, গত ২২ জুন চীন থেকে প্রায় ১৪ লাখ টাকা মূল্যের ১০ টন সুতার একটি চালান আমদানি করে প্রতিষ্ঠানটি। একই দিনে আমদানিকারকের পক্ষে চালানটির তথ্য সার্ভারে এন্ট্রি করেন সুপারসনিক ফ্রেট সার্ভিস নামে একটি সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট।
এর ৫ দিন পর ২৭ জুন চালানটির সব তথ্য সঠিক জানিয়ে তা খালাসের চূড়ান্ত অনুমোদন দেন রাজস্ব কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলাম। এরপর ২৯ জুন বন্দর থেকে সেগুলো বের করে নেয় চক্রটি। একইভাবে কোনো ধরনের তদারকি ও পরীক্ষণ ছাড়াই খালাস হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির অপর ২টি চালান।
কুমিল্লা ইপিজেডের মহাব্যবস্থাপক জিল্লুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চীনের মালিকানাধীন এ প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরেই বন্ধ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ করার পর পরই মালিকরা দেশ ছেড়ে চলে গেছেন এবং কারখানাটিও সিলগালা করা হয়েছে।'
সম্প্রতি ৫ মাস আগের এই ঘটনায় তদন্ত কমিটি করেছে কাস্টম হাউজ কর্তৃপক্ষ। আমদানিকারকের প্রতিনিধি ও পণ্য চালানগুলো খালাসের সঙ্গে জড়িত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট সুপারসনিক সার্ভিসের লাইসেন্স সাময়িক স্থগিত করার পাশাপাশি ২ কর্মকর্তার ইউজার আইডিও সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে।
নিয়ম অনুযায়ী, কাস্টমস কর্তৃপক্ষ কোনো প্রতিষ্ঠানকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করলে, যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটির সব ধরণের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ করতে এনবিআরের সার্ভারে প্রতিষ্ঠানটির বিন লক করা হয়।
বিল লক করার ক্ষমতা প্রতিটি কাস্টমস স্টেশনে একজন শীর্ষ কর্মকর্তার ইউজার আইডিতে দিয়ে থাকে এনবিআর। ওই কর্মকর্তার ব্যতীত আর কোনো কর্মকর্তার ইউজার আইডিতে এ ধরণের ক্ষমতা দেওয়া থাকে না। বিশেষ এ আইডির পাসওয়ার্ডের তথ্য ওই কর্মকর্তা ছাড়া স্বয়ং এনবিআরের সার্ভার টিমের কাছেও থাকে না।
এ ঘটনায় তৌহিদুল ইসলাম নিজের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেন এবং কোনো জালিয়াতি চক্রের সঙ্গে তিনি জড়িত নয় বলে দাবি করেন।
তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রপ্তানিমুখি প্রতিষ্ঠানের পণ্য খালাসের আগে বেপজা আইপির সঠিকতা জুনিয়র অফিসাররা যাচাই করেন। পরবর্তীতে সেই নথি দেখেই শুল্কায়ন করি। এ ক্ষেত্রে কি হয়েছিল তা মনে নেই। তবে এ ক্ষেত্রে বড় ধরনের জালিয়াতি চক্র জড়িত থাকতে পারে।'
এ বিষয়ে কথা বলতে চট্টগ্রাম কাস্টমসের অতিরিক্ত কমিশনার আবু নূর রাশেদ খানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি কেনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
সুপারসনিক সার্ভিস প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফাইজুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ ঘটনার সঙ্গে কে বা কারা জড়িত তা আমি জানি না। আমিও চাই এই ঘটনা তদন্ত করে প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হোক এবং এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধ হোক।'
প্রতিটি চালানের প্রাথমিক তথ্য এনবিআরের সার্ভারে এন্ট্রি করানো হয় সিঅ্যান্ডএফের আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে। সিঅ্যান্ডএফের আইডি ও পাসওয়ার্ড ছাড়া কীভাবে চালানগুলোর নথি দাখিল করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
আগে পূর্বে খালাস নেওয়া ২১টি চালানের মধ্যে ৭টি চালানে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা মূল্যের মদ, সিগারেট ও গৃহস্থালি পণ্য থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হলেও অপর ১৪ কনটেইনারের পণ্য সম্পর্কে জানে না কাস্টমস। এসব চালানের বেশির ভাগ নথি গায়েব হয়ে যাওয়ায় আমদানিকারকদের সম্পৃক্ততাও প্রমাণ করতে পারেনি তদন্ত কর্মকর্তারা। ফলে জানা যায়নি পণ্যের গন্তব্যও।
এ ছাড়া, গত ১ বছরে কোনো ধরনের পণ্য রপ্তানি না করেই ২১টি প্রতিষ্ঠান প্রায় দেড় হাজার চালানে প্রায় ১ হাজার ৭৬০ কোটি টাকার ভুয়া রপ্তানি দেখিয়েছে। এর ক্ষেত্রে ১৭ জন কর্মকর্তার আইডি ব্যবহার করার প্রমাণ পেয়েছে কাস্টমস। ভুয়া রপ্তানি দেখানো সবগুলো চালানেই কৃষি পণ্য ঘোষণা দেওয়ায় সরকার থেকে ২০ শতাংশ প্রণোদনাও পেয়েছেন এসব প্রতিষ্ঠান।
আমদানি ও রপ্তানি চালানে জালিয়াতি বিষয়ে দ্য ডেইলি স্টারে গত বছরের নভেম্বরে ২টি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হলে ২টি পৃথক তদন্ত কমিটি করে কাস্টমস। যদিও এসব তদন্ত কমিটি এনবিআরের সার্ভারে প্রবেশ ও জলিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করতে পারেনি।
এই জালিয়াতির সঙ্গে শক্তিশালী চক্র জড়িত থাকতে পারে— এমন ধারণা থেকে এনবিআরকে বড় পরিসরে তদন্ত করতে একাধিকবার অনুরোধও করে তদন্ত কর্মকর্তারা। তবে এ বিষয়ে এনবিআর কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রাম কাস্টমসের তৎকালীন কমিশনারকে জালিয়াতি চক্রকে শনাক্ত করতে কাস্টমস ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের অনুরোধ জানানো হয়েছিল।
এনবিআরের সদস্য মাসুদ সাদিক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অতীতে ঘটনাগুলোতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বের হয়ে আসলেও কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে কোন প্রক্রিয়ায় সার্ভার জালিয়াতি হচ্ছে এবং কারা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত, তা জানা যায়নি। এ বিষয়ে তদন্ত করতে শুল্ক গোয়েন্দা সম্প্রতি অন্য সংস্থা থেকে জনবল কো-অপট করার অনুমতি চেয়েছে। আমরাও অনুমতি দিয়েছি। আশা করছি এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি করা হলে প্রকৃত চিত্র উঠে আসবে।'
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, এসব ঘটনা প্রতিরোধে একাধিক উদ্যোগ নিয়েছিল এনবিআর। এসব উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে, কর্মকর্তারা সার্ভারে প্রবেশের সময় তাদের মোবাইল নম্বরে ওয়ানটাইম পাসওয়ার্ড (ওটিপি) যাবে, আমদানি চালানের তথ্য সার্ভারে প্রবেশ করার সময় আমদানিকারকের নির্ধারিত ইমেইলে তথ্য প্রেরণ করতে হবে।
কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছেন, এসব অনিয়ম কীভাবে হচ্ছে এবং কারা এসব অনিয়ম করছে, তা না জানতে পারলে কোনো উদ্যোগই কাজে আসবে না। ফলে এসব নিরাপত্তা নেওয়ার পরে জালিয়াতি বন্ধ না হয়ে আরও বেড়েছে। তার অর্থ, জালিয়াতি চক্র কত শক্তিশালী তা আমাদের ধারণার বাহিরে।
সাইবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব ঘটনায় শুল্কায়নের সঙ্গে জড়িত কাস্টমস কর্মকর্তাদের পাশাপাশি শক্তিশালী একটি সাইবার চক্রও জড়িত থাকতে পারে। দ্রুত জড়িতদের চিহ্নিত করতে না পারলে আমদানি নিষিদ্ধ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকি এমন পণ্যও দেশে প্রবেশ করতে পারে।
Comments