নাসির আলী মামুনকে এবার ‘দেশের মুখের’ ছবি তোলার তাগিদ

এতদিন সাদা-কালোয় আর আলো-ছায়ার দুর্দান্ত শৈলীতে কালের মহামানবদের মুখচ্ছবি ফ্রেমবন্দি করে এসেছেন খ্যাতিমান আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন। এবার তাকে ‘দেশের মুখের’ ছবি তোলার তাগিদ দিলেন বামপন্থী লেখক, গবেষক ও রাজনীতিবিদ বদরুদ্দীন উমর।
‘নাসির আলী মামুন ইন প্রেইজ অব শ্যাডোজ’- এর উদ্বোধনী প্রদর্শনী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানের মঞ্চে উপবিষ্ট অতিথিরা। ছবি: স্টার

এতদিন সাদা-কালো আর আলো-ছায়ার দুর্দান্ত শৈলীতে কালের মহামানবদের মুখচ্ছবি ফ্রেমবন্দি করে এসেছেন খ্যাতিমান আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন। এবার তাকে 'দেশের মুখের' ছবি তোলার তাগিদ দিলেন বামপন্থী লেখক, গবেষক ও রাজনীতিবিদ বদরুদ্দীন উমর।

আজ শুক্রবার ঢাকার সেগুনবাগিচায় শিল্পকলা একাডেমির চিত্রশালা মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হলো নাসির আলী মামুনকে নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র 'নাসির আলী মামুন ইন প্রেইজ অব শ্যাডোজ'- এর উদ্বোধনী প্রদর্শনী। বাংলায় এই প্রামাণ্যচিত্রের নামকরণ করা হয়েছে 'ছায়াবন্দনা'। এ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানের শুরুতে 'দেশের মুখের' ছবি তোলার এই তাগিদ আসে বদরুদ্দীন উমরের কাছ থেকে।

অনুষ্ঠানে বদরুদ্দীন উমর নাসির আলী মামুনের সঙ্গে সেই আশির দশকের শুরুতে পরিচিতি হওয়ার ঘটনা বর্ণনা করে বলেন, 'নাসির আলী মামুন দেশ-বিদেশের অনেক বিখ্যাত মানুষের ছবি তুলেছেন। এ জন্য তার কোনো আর্থিক প্রাপ্তি হয়নি। এটা অনেকটা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো। তাই এটা উল্লেখযোগ্য একটা ব্যাপার।'

এ পর্যায়ে নবতীপর এই রাজনীতিবিদ নাসির আলী মামুনকে উদ্দেশ্য করে আরও বলেন, 'আজ দেশের ৮০ শতাংশ মানুষের কোনো ভরসা নেই। দেশের নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। নদীগুলো সব দখল করে নিচ্ছে। ভরাট করে ফেলছে। দূষিত হয়ে যাচ্ছে। গাছপালা কেটে ফেলছে। এই ঢাকার রাস্তায় পথশিশু, মানুষের দুর্দশা—এমন অনেক বিষয় আছে ছবি তোলার জন্য। মামুন, মানুষের মুখের ছবি তুলুন। কিন্তু দেশের মুখের এই ছবিগুলোও তোলা দরকার।'

এর আগে আরেক কীর্তিমান ও অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, 'এই অনুষ্ঠানটা সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক। এখানে একটা সাংস্কৃতিক ঘটনা ঘটবে। একটা চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী হবে এবং সেই প্রদর্শনীটা সামাজিকভাবে হবে। আমাদের দেশে বর্তমান সময়ে সাংস্কৃতিক কাজ এবং সামাজিক কাজ—এ দুটো তো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেই। এবং দুটোরই খুব ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। আমরা সামাজিকতা হারিয়ে ফেলছি। সাংস্কৃতিক কাজকর্ম অত্যন্ত ক্ষীণ ও স্বল্পসংখ্যক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এর মধ্যে এ ধরনের অনুষ্ঠান আমাদের জন্য একটা আনন্দের উপলক্ষ।'

এছাড়া নাসির আলী মামুন ও তার তোলা ছবি সম্পর্কে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার বক্তব্যে বলেন, 'পোট্রেট তো অনেকে তোলেন। কিন্তু মামুন যার ছবি তোলেন তার বৈশিষ্ট্য, নিজস্বতা ও ব্যক্তিত্ব মামুন সেই ছবিতে তুলে ধরতে চান। এক্ষেত্রে তিনি অনন্য। একইসঙ্গে মামুন অনেক পরিশ্রমী।'

উদ্বোধনী প্রদর্শনীর পর বক্তব্য দিচ্ছেন নাসির আলী মামুন। ছবি: স্টার

অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি চলচ্চিত্রকার মোরশেদুল ইসলামের ভাষ্য ছিল এ রকম—'মামুন এমন একজন আলোকচিত্রী, যিনি ছবির ভেতর দিয়ে অন্যরকম একটা দৃশ্যকল্প তৈরি করেন।'

নাসির আলী মামুন শেখ মুজিবুর রহমানের অনেক ছবি তোলার সুযোগ পেয়েছিলেন। তার তোলা ছবির তালিকায় মাওলানা ভাসানী, কবি জসিম উদ্দীন, শিল্পী এস এম সুলতান, শিল্পী কামরুল হাসান, মাদার তেরেসা, লেস ওয়ালেসা, মিখাইল গরবাচেভ, ডেসমন্ড টুটু, বিল ক্লিনটনসহ অসংখ্য বিশ্ব বরেণ্য মানুষ আছেন। আছেন মাদার তেরেসা, অমর্ত্য সেন, স্টিফেন হকিংদের মতো অধিকারকর্মী ও বিজ্ঞানীরাও।

এছাড়া মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা কমরেড মনি সিংহ, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানী, ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিন ও ভাষা সংগ্রামী গাজিউল হকের ছবিও তুলেছেন নাসির আলী মামুন। তার আলোকচিত্রে উঠে এসেছে বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কবি সুফিয়া কামাল, আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, হুমায়ূন আহমেদ, হুমায়ূন আজাদ, আহমেদ ছফার বিভিন্ন মুহূর্ত।

এভাবে গত শতকের সত্তরের দশকের শুরু থেকে পোট্রেট ফটোগ্রাফির নেশায় উন্মুখ মামুন দেশ-বিদেশ ঘুরে তুলে এনেছেন কিংবদন্তীতুল্য সব মানুষের ছবি।

আজ প্রদর্শিত নাসির আলী মামুনকে নিয়ে তৈরি এক ঘণ্টার চলচ্চিত্রটিতে এর অনেকটাই তুলে ধরতে দেখা যায় যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাংলাদেশি নির্মাতা মকবুল চৌধুরীকে। কোলাকার প্রডাকশনসের ব্যানারে নির্মিত এই ছবিটিতে আবহ সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন ব্রিটিশ মিউজিক কম্পোজার জ্যাক ব্লুর।

ছবিটি নিয়ে নির্মাতা মকবুল চৌধুরী বলেন, 'গত ৭-৮ বছর ধরে ছবিটা নিয়ে আলোচনা চলছে নাসির আলী মামুনের সঙ্গে। এর ভেতর দিয়ে তার সঙ্গে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এই সম্পর্কটা তৈরি না হলে এই ছবি নির্মাণ করা সম্ভব হতো না।'

শুরুর আলোচনা পর্ব পার করে ছবিটি প্রদর্শনের পর উচ্ছ্বাসে ভাসতে দেখা যায় মিলনায়তনভর্তি দর্শকদের। এ পর্যায়ে 'ক্যামেরার কবি' নাসির আলী মামুন বলেন, 'এ ছবি সম্পর্কে কথা বলার বিষয়টি আমার সাধ্যের বাইরে। এটা আমার জন্য প্রচণ্ড আবেগের একটা ব্যাপার।'

খ্যাতিমান ও প্রবল জনপ্রিয় এই আলোকচিত্রী বদরুদ্দীন উমরের বক্তব্যের প্রসঙ্গ ধরে আরও বলেন, 'আমার ৭১ বছর বয়সের মধ্যে ৫০ বছরই কেটেছে দারিদ্র্যতার মধ্যে। নানা কিছুর বিরুদ্ধে আমাকে লড়াই করতে হয়েছে। জীবনের একটা বড় অংশ ছিলাম বেকার। অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে জীবনে। বদরুদ্দীন উমর আমাকে দরিদ্র, নিঃস্ব, অসহায় মানুষের ছবি তুলতে বলেছেন। আমি তাদের কথা সবসময়ই স্মরণ করি। যেহেতু আমি নিজেই তাদের সমগোত্রীয় একজন।'

এ সময় নাসির আলী মামুন প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে রচিত তার দুটি বইয়ের কথাও উল্লেখ করেন।

মূলত নাসির আলী মামুনের হাত ধরেই দেশে পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফির সূচনা হয়। এ পর্যন্ত প্রায় আট হাজার মানুষের লক্ষাধিক ছবি তুলেছেন তিনি। দেশে-বিদেশে তার ৫০টির বেশি একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে। 

Comments

The Daily Star  | English

Managing expectations the challenge for EC

The EC was a rubber stamp to legalise AL's usurpation of power in last three elections

3h ago