আইটি রপ্তানিতে কেবলই পেছাচ্ছে বাংলাদেশ

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুসারে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় দুই দশমিক ৩৩ শতাংশ কমে হয়েছে ৪০ কোটি ৭০ লাখ ৭০ হাজার ৭০ হাজার ডলার। আগের বছরের তা ছিল ৪১ কোটি ৬৭ লাখ ৯০ হাজার ডলার।
আইটি রপ্তানিতে পেছাচ্ছে বাংলাদেশ
অলঙ্করণ: আনোয়ার সোহেল/স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চে দেশের আইটি পণ্যের রপ্তানি কমেছে প্রায় আড়াই শতাংশ। এ থেকে স্পষ্টত বোঝা যায় যে, বৈশ্বিক তথ্য-প্রযুক্তি খাতে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ধুঁকছে বাংলাদেশ।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুসারে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় দুই দশমিক ৩৩ শতাংশ কমে হয়েছে ৪০ কোটি ৭০ লাখ ৭০ হাজার ৭০ হাজার ডলার। আগের বছরের তা ছিল ৪১ কোটি ৬৭ লাখ ৯০ হাজার ডলার।

সফটওয়্যার রপ্তানি ২৫ শতাংশ কমে দুই কোটি ৮৬ লাখ ডলার ও কম্পিউটার কনসালটেন্সি সেবা ৪৫ শতাংশ কমে এক কোটি ৪০ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছে। তবে আইটি সেবা থেকে আয় চার দশমিক ৬৪ শতাংশ বেড়ে ৩৬১ দশমিক ৩০ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।

আইটি পণ্য রপ্তানির বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে এ খাতে টানা দ্বিতীয় বছরের মতো রপ্তানি কমতে পারে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে পাঁচ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো এ খাত থেকে রপ্তানি কমে যায়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ বড় বড় আইটি প্রতিষ্ঠান তৈরিতে ব্যর্থ হওয়ায় তা সরকারের রপ্তানি বহুমুখীকরণ প্রচেষ্টার জন্য অশনিসংকেত। দেশের আয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশই আসে অন্য খাত থেকে।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সফটওয়্যার সেবায় নেতিবাচক পরিস্থিতি খারাপ সংকেত।'

ডলারের বেশি দাম হওয়ায় রপ্তানিকারকরা লাভবান হচ্ছেন। গত দুই বছরে ডলারের দাম ৩৫ শতাংশ বেড়েছে। রিজার্ভ ক্রমাগত কমতে থাকায় টাকা আরও দুর্বল হতে পারে এমন আশঙ্কায় রপ্তানিকারকদের অনেকে তাদের আয় দেশে আনছেন না।

তিনি আরও বলেন, 'যদিও দেশের সফটওয়্যার রপ্তানি কমছে। তবে পাকিস্তানের মতো অন্যান্য দেশ গত কয়েক বছর ধরে এই খাতে উচ্চ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখছে।'

আর্থ-সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের তুলনায় অনেক পিছিয়ে থাকলেও ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই থেকে মে মাস পর্যন্ত পাকিস্তানের আইটি পণ্য রপ্তানি বছরে ২৫ শতাংশ বেড়ে দুই দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার হয়েছে।

বেসিসের অপর সাবেক সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বৈশ্বিক আইটি আউটসোর্সিংয়ে বড় ধরনের পরিবর্তন এ খাতে নেতিবাচক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।'

তার ভাষ্য, দেশের আইটি সেবা রপ্তানিতে কম দক্ষতার কর্মী দরকার হলেও এখন এই খাতে অটোমেশন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) জয়জয়কার।

'ভারতে আছে শতাধিক রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান। সেখানে ৫০ হাজারের বেশি ইঞ্জিনিয়ার কাজ করছেন। যেহেতু বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো আকারে ছোট, তাই তারা বড় কাজ পায় না। ফলে তাদের আয় কম।'

'যেমন, আমরা টুডি গ্রাফিক্স ও ম্যানুয়াল ডেটা এন্ট্রি প্রচুর রপ্তানি করতাম। এসব এখন রোবোটিক অটোমেশন ও এআই এর মাধ্যমে করা যায়। এটি আইসিটি রপ্তানি মন্দায় ভূমিকা রেখেছে।'

'বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন উচ্চ পর্যায়ের কাজে আউটসোর্সিং করতে চায়। যতক্ষণ না আমরা এ ধরনের কাজ করতে সক্ষম কর্মী তৈরি করতে পারছি ততক্ষণ আমরা কাজ হারাতে থাকব। আমাদের কর্মীদের থ্রিডি অ্যানিমেশন, ব্লকচেইন, ডেটা অ্যানালাইসিস ও এআইয়ের মতো অত্যাধুনিক কাজ শিখতে হবে।'

'এসব না বদলালে রপ্তানি কমতেই থাকবে,' বলেও মত দেন তিনি।

এই আইটি উদ্যোক্তা মনে করেন, ব্রডব্যান্ড যদি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রসার ঘটানো না যায় এবং পাঠ্যক্রম আপডেট না করা হয় তবে আইটি খাতে রপ্তানি আয় বাড়বে না।

গত দেড় দশক ধরে সরকার আইটি অবকাঠামো ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্পে কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ করলেও আইটি রপ্তানিতে এমন ভয়াবহ চিত্র দেখা যাচ্ছে।

এসব উদ্যোগ বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার মতো দক্ষ জনশক্তি তৈরি করেছে কিনা জানতে চাইলে কবীর বলেন, 'দুর্ভাগ্যজনক যে, তা হয়নি।'

তার মতে, 'বাংলাদেশকে আইসিটি পাওয়ার হাউস হিসেবে গড়ে তুলতে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে সদিচ্ছা থাকলেও তা বাস্তবায়নে ব্যর্থতা দেখা গেছে।'

তিনি আরও বলেন, 'ধরুন, ১০০ তরুণ আইসিটির কোনো বিষয়ে তিন মাসের কোর্সে অংশ নিয়েছেন। তারা কতটা শিখেছেন তা মূল্যায়ন করতে তৃতীয় পক্ষের অডিট দরকার। কিন্তু, আমরা সেরকম কিছু দেখছি না।'

'যেহেতু সরকার আইসিটি খাতের উন্নয়নে প্রচুর খরচ করছে, তা ফলপ্রসূ হচ্ছে কিনা ও সঠিক উপায়ে টাকা খরচ হচ্ছে কিনা এ নিয়ে মূল্যায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।'

সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান ড্রিম৭১ বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাশাদ কবির আইটি পণ্য রপ্তানিতে এমন মন্দাকে অস্বাভাবিক বলে মনে করেন না।

তিনি বলেন, 'এটা প্রায় এক বছর আগে এমনটি ধারণা করা হয়েছিল। এর প্রাথমিক কারণ বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা ও দীর্ঘ সময় ধরে চলা উচ্চ মূল্যস্ফীতি।'

২০২২ ও ২০২৩ সালে আইটি খাতে কর্মীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। ২০২৪ সালে বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি খাতে ছাঁটাই চলছে। এটি এই ইঙ্গিত দেয় যে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা ভালো চলছে না।

যেহেতু দেশের আইটি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান রপ্তানি আউটসোর্সিং, তাই আয় কমেছে।

দেশি আইটি প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত স্টার্টআপগুলোর সঙ্গে কাজ করে। কারণ তাদের সস্তায় আউটসোর্সিংয়ের প্রতি ঝোঁক বেশি। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার কারণে স্টার্টআপগুলো তহবিল পেতে সমস্যায় পড়ছে। ফলে, তারা নতুন প্রযুক্তি পণ্যের আপগ্রেড বা প্রসার বন্ধ করে দিয়েছে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ডেটা সায়েন্স ও ব্লকচেইনের মতো উন্নত প্রযুক্তির ক্ষেত্রে দক্ষ মানবসম্পদের অভাব আইটি পণ্য রপ্তানি কমার আরেক কারণ।

'বিশ্বব্যাপী আইটি পণ্যের চাহিদা প্রচলিত প্রযুক্তি থেকে উন্নত প্রযুক্তিতে বদলে যাচ্ছে,' উল্লেখ করে রাশাদ কবির বলেন, 'নানা কারণে বাংলাদেশ আধুনিক প্রযুক্তির জন্য যথেষ্ট দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে পারছে না। আমরা সম্ভাবনাময় বাজার ও ব্যবসার সুযোগ হারাচ্ছি।'

সংশ্লিষ্টদের মতে, ২০২৫ সালের মধ্যে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য রপ্তানির যে লক্ষ্যমাত্রা বাংলাদেশ নিয়েছে তা অর্জন নাও হতে পারে।

ফাহিম মাশরুরের মত, 'রপ্তানি কম হওয়ার আরেক কারণ—দেশের বেশির ভাগ রপ্তানিমুখী আইটি প্রতিষ্ঠানই আকারে ছোট।'

তিনি বলেন, 'দেশে ৫০টিরও কম রপ্তানিমুখী আইটি প্রতিষ্ঠান আছে যাদের প্রতিটির কর্মীর সংখ্যা অন্তত ১০০। এক হাজারের বেশি কর্মীর কোনো প্রতিষ্ঠান নেই।'

'ভারতে আছে শতাধিক রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান। সেখানে ৫০ হাজারের বেশি ইঞ্জিনিয়ার কাজ করছেন। যেহেতু বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো আকারে ছোট, তাই তারা বড় কাজ পায় না। ফলে তাদের আয় কম।'

'আমরা যদি পাঁচ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে চাই, তাহলে ন্যূনতম ১০০ প্রতিষ্ঠান থাকতে হবে। সেখানে এক হাজারের বেশি প্রকৌশলী কাজ করবে,' যোগ করেন তিনি।

Comments