অনন্য-লড়াকু প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ

শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ
শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। ছবি: প্রথম আলোর সৌজন্যে

একবার তার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় ঠিক হয়েছে সকাল ১০টায়। তখন তার অফিস জাহানারা গার্ডেনে। ফার্মগেটে নেমে ওই হাঁটা দূরত্বে পৌঁছতে সামান্য দেরি হয়ে গেলো। ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল ১০টা ৭ মিনিট। দেখি চেয়ার খালি। শুনলাম ভদ্রলোক মিনিট দুয়েক আগে বেরিয়ে গেছেন।

ফোন করলাম তাকে। বললাম, আপনার সঙ্গে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল সকাল ১০টায়। তিনি স্বাভাবিক স্বরে বললেন, আপনি তো সময় মতো আসেননি।

পরেরবার যখন অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিলাম, নির্দিষ্ট সময়ের আধা ঘণ্টা আগেই পৌঁছে গেলাম তার রুমে। আমাকে দেখেই বললেন, আপনি তো নির্দিষ্ট সময়ের আগেই এসে পড়েছেন। বসেন। অপেক্ষা করেন। যথাসময়ে আমরা কথা বলবো।

এই ভদ্রলোককে দেখে অবাক হয়েছিলাম। এত ঠোঁটকাটা! কিন্তু দিনে দিনে আবিষ্কার করলাম, আমাদের দেশের আর দশটা মেধাবী, প্রতিষ্ঠিত, পেশায় সফল মানুষের মধ্যে তিনি শুধু আলাদাই নন, একবারে ভিন্ন ঘরানার মানুষ।

খুব দরিদ্রতার মধ্যে বেড়ে উঠেছিলেন বলে মানুষের কষ্টে তার বেদনা অপার। কিন্তু সেটারও একটা রাজনৈতিক চেহারা ছিল। তিনি শ্রেণিসংগ্রামে বিশ্বাস করতেন। ভাবতেন, রাজনৈতিক লড়াই ছাড়া মানুষের এই দুর্দশা কাটানো সম্ভব নয়।

বলছি তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ, বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর কথা। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ, বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির প্রাণভোমরা তিনি। পরস্পরবিরোধী-বিবদমান বহুবিধ বাম রাজনৈতিক দলকে যিনি একটি লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ রেখেছিলেন, সরবরাহ করেছিলেন প্রয়োজনীয় অর্থ ও সাংগঠনিক নেতৃত্ব অপার দৃঢ়তায়।

আজ ৩১ জুলাই, তার জন্মদিন। আজ থেকে ৯২ বছর আগে ১৯৩১ সালে খুলনা জেলার দৌলতপুরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।

২.

প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ একজীবনে ২ জীবন যাপন করেছেন।

প্রথমত, তার পেশাগত প্রকৌশলী জীবন। সেখানে তিনি অনন্য মেধায়, অসাধারণ দক্ষতায়, সততা, নিষ্ঠা ও শ্রমে দেশের প্রকৌশলী সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয় স্থানে নিজেকে আসীন করেছেন। ঢাকা মহানগরসহ দেশের নানা প্রান্তে গুরুত্বপূর্ণ অনেক বৃহৎ সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনার স্ট্রাকচারাল স্ট্রেন্থ গড়ে উঠেছে প্রকৌশলী শহীদুল্লাহর মেধা ও মননে। একটা বড় সময় ধরে দেশের যেকোনো জায়গায় যেকোনো ভবনে, যেকোনো বড় স্থাপনায় ফাটল ধরলে, বিপন্ন হলে তার প্রকৌশলগত সুরক্ষায় শেষ ভরসার দেশি মানুষ ছিলেন প্রকৌশলী শহীদুল্লাহ।

তার প্রতিষ্ঠিত প্রকৌশল উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান 'শহীদুল্লাহ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস' এক সময় দেশের শীর্ষ প্রকৌশল প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা পেয়েছে। রেট্রোফিটিং কৌশল উদ্ভাবন করে শহীদুল্লাহ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস দেশজুড়ে এক নির্ভরতার অগ্রপথিক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যেকোনো পুরনো বিল্ডিংয়ের পরিসর বাড়াতে হবে, অথচ বিল্ডিং ভাঙা পড়বে না, বিল্ডিংয়ের স্থাপনাগুলোর কোনো ক্ষতি করা যাবে না, ব্যবহারকারীদের অসুবিধা ঘটানো যাবে না—এর জন্য অন্যতম ভরসা ছিলেন দেশের সেরা প্রকৌশলীদের অন্যতম শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ।

ঢাকা স্টেডিয়ামসহ দেশের অনেক ছোট-বড় স্থাপনায় শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এ কৌশল প্রয়োগ করেছেন সফলতার সঙ্গেই। পরবর্তীতে তার বানানো নতুন প্রতিষ্ঠানের নাম হয় 'শহীদুল্লাহ অ্যান্ড নিউ অ্যাসোসিয়েটস'।

একজীবনে শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ কয়েক দশকের পেশাগত অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ, তার ফিল্ডে দেশের সেরা প্রকৌশলী। অন্য জীবনে শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ দেশের তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ বিদ্যুৎ, বন্দর রক্ষার আন্দোলনে উৎসর্গীকৃত। দেশের সক্ষমতায় জনগণের মালিকানায় এ সম্পদ রক্ষা পাবে, সেই আন্দোলনের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী, অপরিহার্য নেতাও ছিলেন তিনি।

বামপন্থি দলগুলো আদর্শগত, রাজনৈতিক নানা মত পার্থক্যে নিজেদের মধ্যে নানা দূরত্ব তৈরি করলেও শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে কেন্দ্র করেই তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ রক্ষার আন্দোলনে নিজেদের সংঘবদ্ধ রেখেছে তার সক্রিয়তায় ও উদ্যমে। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সেই ঐক্য ও সংগ্রামের দিকচিহ্ন হয়ে আছেন।

নিজে কখনো কোনো রাজনৈতিক দলের প্রত্যক্ষ সদস্য ছিলেন না। কিন্তু বামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। এ সহানুভূতি শুধু দার্শনিক, আদর্শিক, বুদ্ধিবৃত্তিক নয়, আর্থিকও বটে। প্রতি মাসে তিনি নিজে যা আয় করতেন, তার ৩ ভাগের ২ ভাগ এ কাজে ব্যয় করেছেন। বহু বছর ধরেই এ আর্থিক প্রণোদনা জুগিয়ে এসেছেন সমাজ পরিবর্তনের কাজে নিবেদিত রাজনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক দল, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানগুলোকে।

৩.

শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর বাবার নাম শেখ মুহাম্মদ হানিফ। বাবা দৌলতপুর মুহসীন উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। মায়ের নাম মরিয়ম খাতুন। ৬ ভাই ১ বোন। দৌলতপুর মুহসীন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৪৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় আরবিতে লেটারসহ প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন।

১৯৪৮ সালে তৎকালীন ব্রজলাল একাডেমী (পরে যার নাম হয় বিএল কলেজ) থেকে বিজ্ঞান বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় পূর্ব পাকিস্তান বোর্ডে সম্মিলিত মেধা তালিকায় ১৯তম স্থান অধিকার করেন।

১৯৫০ সালে একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএসসি পাস কোর্সে উত্তীর্ণ হন। বিএসসি পাস কোর্সে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান বোর্ডের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। ওই একই বছর ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়ে আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হন।

১৯৫৪ সালে আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (বর্তমান বুয়েট) থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ৭৯ শতাংশ নম্বর পেয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে গোল্ড মেডেলিস্ট হিসেবে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।

৪.

প্রকৌশলী শহীদুল্লাহকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনার শক্তির জায়গাটা কী? তিনি হাসতে হাসতে বললেন, 'আমি বিবেকানন্দের সেই লাইনটাকে খুব পছন্দ করি, "জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।"'

পাল্টা প্রশ্ন করলাম, পুনর্জন্ম হলে আবার কি প্রকৌশলী শহীদুল্লাহই হতে চান? খুব জোর দিয়েই বললেন, 'ওসবে বিশ্বাস নেই। তবে আমি বিশ্বাস করি, পেশাগত জীবনে যা করেছি তা ট্যানজিবল, দেখা যায়। সেদিক দিয়ে পেশা হয়ত ওটাই নিতাম। আর রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণায় এখন যে অবস্থানে আছি, সেটায় জীবনে আরও আগে থেকে আসা উচিত ছিল। একটু দেরি হয়ে গেছে। ১৯৬৫ সালে আমি যখন কমিউনিস্ট ভাবধারায় দীক্ষিত হই, তখন আমার বয়স ৩৪ বছর।'

'ছাত্ররাজনীতি করিনি। কিন্তু আমাদের সময় যারা যারা কমিউনিস্ট ছাত্র ছিলেন, তারা যে আমাকে রাজনীতির কথা বলেননি তা নয়। আমি তো ভালো ছাত্র ছিলাম। তাই রাজনীতিতে দেরিতে এসেছি! পরের বার জন্মালে এই ভুল আর হবে না। আরও কম বয়সেই রাজনীতিতে জড়াবো। কনস্ট্রাকশন বিজনেসে গিয়ে পেশাগত জীবনেও কিছু পণ্ডশ্রম হয়েছে। ওটাতে যদি না যেতাম তাহলে খুব ভালো হতো। সে বিবেচনায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ারই হতে চাইতাম। রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণায় এখন যা আছি তাই থাকতাম। তবে আরও আগে জড়াতাম।'

জানতে চাইলাম, এই যে এত কিছুর মধ্যে জড়িয়ে আছেন, হতাশা আসে না? প্রকৌশলী শহীদুল্লাহ তার বিখ্যাত হাসিটা ধরে রেখেই বললেন, 'হতাশা জিনিসটা যেকোনো মানুষেরই পুরোপুরি ত্যাগ করা উচিত।' এরপর মহাভারতের কাহিনী টেনে বললেন, 'অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে জিজ্ঞেস করছে, "আমরা কি এই কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধে জিতব? আপনি কি আশাবাদী?" শ্রীকৃষ্ণ বললেন, "বাছা কর্মে তোমার অধিকার। ফলে অধিকার নেই।" আমি মনে করি যে কর্ম করে যাওয়াতেই আমার আনন্দ। ফল কতদূর লাভ হলো, কি হলো না, সে সম্পর্কে পুরোপুরি নিস্পৃহ, উদাসীন থাকা উচিত। একজন মানুষ সৎকর্মে নিয়োজিত থাকলে তা থেকেই সে আনন্দ পাবে। এটাই তার ফল লাভ। অন্য কি কি লাভ হলো তার হিসেবের কোনো দরকার নেই। আনন্দ বোধটা আমাদের কর্মের থেকে আসবে, ফলের থেকে নয়। অতএব হতাশার কোনো প্রশ্ন আসবে না।'

৫.

প্রকৌশলী শহীদুল্লাহর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, নিজের চিন্তা ও বিশ্বাস প্রকাশে তিনি সবসময় থেকেছেন অকপট। কারো কাছে মাথা নোয়াবার মানুষ তিনি নন। প্রয়োজনে মুখের ওপর তার মতো করে সত্য প্রকাশে তিনি কখনই কুণ্ঠিত হননি।

পাকিস্তানি জমানায় বামপন্থি বিশ্বাসের অপরাধে রিমান্ডে নিয়ে সামরিক গোয়েন্দারা অকথ্য নির্যাতন করেছে, কিন্তু তাকে একচুলও টলাতে পারেনি। তিনি জেল খেটেছেন, জেলে থাকা অবস্থায় তার পরিবার অবর্ণনীয় দুর্দশায় পড়েছে। কিন্তু তার চিন্তাগত অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। পরিশ্রমী, জনস্বার্থে নিবেদিত, প্রকৌশল পেশায় সমুজ্জ্বল এই মানুষটির ক্ষুরধার মস্তিষ্ক এখনো সবলভাবেই সক্রিয়। বয়সের চাপে কিছুটা নুইয়ে পড়লেও মানুষের অগ্রগতির ধারায়, প্রগতির লড়াইয়ে তার সমর্থন ও সক্রিয়তা এখনো অবিরল।

প্রকৌশলী শহীদুল্লাহ আমাদের কালের নায়ক। আমাদের জন্য এক অনন্য প্রেরণা। জনস্বার্থে তার লড়াই, সততা, পরিশ্রম, মেধা, পেশাগত উৎকর্ষতা বহুকাল এই ভূ-খণ্ডের চিন্তাশীল, সমাজমনস্ক মানুষকে উৎসাহ ও প্রেরণা জোগাবে।

জন্মদিনে তার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

শুভ কিবরিয়া: সিনিয়র সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

Comments

The Daily Star  | English

Enforced disappearances: Eight secret detention centres discovered

The commission raised concerns about "attempts to destroy evidence" linked to these secret cells

2h ago