জুলাই ৩৫: দিনভর সংঘর্ষ-প্রাণহানির পর ‘মার্চ টু ঢাকা’ হয়ে ওঠে আন্দোলনের ‘ট্রাম্পকার্ড’

আগের দিন ৩ আগস্ট অর্থাৎ ৩৪ জুলাই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে লাখো মানুষের সমাবেশ থেকে সরকার পতনের এক দফা দাবিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের যে ঘোষণা এসেছিল আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে, ৪ আগস্ট ছিল তার প্রথম দিন।
এর পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে সেদিন দেশের সব জেলা ও মহানগরীতে মাঠে নামার ঘোষণা দিয়েছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
এমন প্রেক্ষাপটে ৩৫ জুলাই সারাদেশে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের ব্যাপক সংঘাতে শতাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়। নিহতদের মধ্যে অন্তত ১৪ জন পুলিশ সদস্য এবং আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের ১৯ নেতাকর্মী ছিলেন।
এদিন সরকারের নির্দেশে মোবাইলে ফোর-জি নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেয় অপারেটরগুলো। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার কেমন হবে, তার একটি রূপরেখা ঘোষণা করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। শাহবাগে ব্যাপক জমায়েতের মধ্যে 'মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
শুরুতে 'মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচি পালনের কথা ছিল ৬ আগস্ট। কিন্তু ৪ আগস্ট এটি একদিন এগিয়ে ৫ আগস্ট পালনের ঘোষণা আসে। সারাদেশ থেকে ছাত্র-জনতাকে ঢাকায় আসার আহ্বান জানান সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।

বিশ্লেষকদের অভিমত, 'মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচি একদিন এগিয়ে আনার এই সিদ্ধান্তটি শেষ পর্যন্ত ট্রাম্পকার্ড হয়ে ওঠে আন্দোলনকারীদের জন্য। হঠাৎ এই সিদ্ধান্তে 'অপ্রস্তুত-দিশেহারা' হয়ে পড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।
এদিনই প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, 'ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবক সকলকে নিরাপদে ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় জঙ্গি হামলা হচ্ছে। জঙ্গি হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
সরাসরি গুলি না চালানোর রিট খারিজ
এদিন সকালে আন্দোলনকারীদের উপর সরাসরি গুলি না চালানোর নির্দেশনা চেয়ে করা রিটের আবেদন খারিজ করে দেন হাইকোর্ট।
শুনানি শেষে বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম এবং এস এম মাসুদ হোসাইন দোলনের দ্বৈত বেঞ্চ এই আবেদন খারিজ করে দেন।
দেশের প্রচলিত আইনে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে বলেই আদালত রিটটি খারিজ করে দিয়েছে বলে জানান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী। আন্দোলনকারীদের কেউ আইন ভঙ্গ করলে সংবিধান ও আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
সারা দেশে সহিংসতায় নিহত শতাধিক
সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম দিনে সহিংসতায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শতাধিক মানুষ নিহত হওয়ার খবর আসে।
দেশের বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকার সমর্থক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষে তারা মারা যান। অনেক জায়গায় আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িঘর ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় আগুন দেওয়া হয়।
এর মধ্যে সিরাজগঞ্জে ১৩ পুলিশ সদস্যসহ ২২ জন নিহত হন। ঢাকায় মারা যান অন্তত ১১ জন। এছাড়া নরসিংদী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, কিশোরগঞ্জ, বগুড়া, মুন্সিগঞ্জ, মাগুরা, ভোলা, রংপুরে, পাবনা, সিলেট, কুমিল্লা, শেরপুর, জয়পুরহাট হবিগঞ্জ, কক্সবাজার, বরিশাল ও গাজীপুরে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।

সন্ধ্যা ছয়টা থেকে অনির্দিষ্টকাল কারফিউ জারি
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা অসহযোগ কর্মসূচির মধ্যে রোববার সন্ধ্যা ৬টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করে সরকার।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণলায়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রোববার সন্ধ্যা ৬টা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ঢাকা মহানগরসহ সব বিভাগীয় শহর, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, শিল্পাঞ্চল, জেলা সদর ও উপজেলা সদরে সান্ধ্য আইন বলবৎ করা হলো।
এর আগে শনিবার রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সকাল ছয়টা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিলের ঘোষণা দিয়েছিলেন।
কিন্তু রোববার সারাদেশে অব্যাহত সহিংসতার প্রেক্ষাপটে কারফিউর সময় এগিয়ে আনার ঘোষণা আসে সরকারের তরফ থেকে।
এর মধ্যেই রাতে বিভিন্ন জেলা ও বিভাগীয় শহর থেকে সংঘর্ষের খবর আসতে থাকে।
সশস্ত্র বাহিনীকে ছাত্র জনতার মুখোমুখি দাঁড় না করানোর আহ্বান সাবেক সেনাপ্রধানের
৪ আগস্ট দুপুরে ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে দেশের সশস্ত্র বাহিনীতে সাধারণ ছাত্র জনতার মুখোমুখি না করার আহ্বান জানান সাবেক সেনাপ্রধান ও সেনা কর্মকর্তারা।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে সাবেক সেনাপ্রধান ইকবাল করিম ভুঁইয়া বলেন, 'সশস্ত্র বাহিনীকে অবিলম্বে সেনা ছাউনিতে ফিরিয়ে নিয়ে যে কোন আপৎকালীন সংকট মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত রাখা প্রয়োজন।'
সাবেক এই সেনাপ্রধান আরও বলেন 'অনুরোধ করে বলছি, এ সংকট আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করুন। দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনীকে ছাত্র জনতার মুখোমুখি করা যাবে না।
'সেনাবাহিনী যে সম্মান, মর্যাদা ও গৌরব অর্জন করেছে, তা আজ কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে।'
মাঠে দায়িত্বরত সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের নিজ দেশের সাধারণ জনগণের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বানও জানান ইকবাল করিম ভুঁইয়া।
সশস্ত্র বাহিনীকে অবিলম্বে সেনা ছাউনিতে ফিরিয়ে নেয়ার আহবান জানিয়ে সাবেক এই সেনাপ্রধান বলেন, 'আমরা নিজেরা নিজেদের সাথে যুদ্ধ করতে পারি না। দেশটাকে যুদ্ধ শহরে পরিণত করতে দিতে পারি না।'
'নৈরাজ্যবাদীদের' কঠোর হাতে প্রতিহত করার আহ্বান হাসিনার
৪ আগস্ট গণভবনে জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক কর্তৃপক্ষ 'নিরাপত্তা বিষয়ক জাতীয় কমিটি'র সঙ্গে বৈঠক করেন পলাতক শেখ হাসিনা। ওই বৈঠক থেকে বের হয়ে তিনি কঠোর হস্তে নৈরাজ্যবাদীদের দমন করতে দেশের জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।
হাসিনা বলেন, 'যারা এখন সহিংসতা চালাচ্ছে তাদের কেউই ছাত্র নয়, তারা সন্ত্রাসী।'
সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বেসামরিক বিমান চলাচলমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী এবং তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
আরও উপস্থিত ছিলেন—মন্ত্রিপরিষদ সচিব, তিন বাহিনীর প্রধানগণ, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের (এএফডি) প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও), পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি); বিজিবি, এনএসআই ও ডিজিএফআই মহাপরিচালক, এনসিএসএ'র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও), র্যাব মহাপরিচালক (ডিজি) এবং স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) প্রধান।
হত্যা ও সহিংসতার দায় আন্দোলনকারী নেতৃত্বকেই নিতে হবে: নানক
এদিন বিকেলে ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, সহিংসতা ও মৃত্যুর যেসব ঘটনা ঘটছে, সেগুলোর দায় আন্দোলনকারী নেতৃত্বকেই নিতে হবে।
নানক আরও বলেন, 'সরকার পতনের এই আন্দোলন ছাত্র সমাজের নয়। তথাকথিত সরকার পতনের এই এক দফা দাবি ক্ষমতালিপ্সু বিএনপি-জামায়াত ষড়যন্ত্রকারীদের।'
আওয়ামী লীগ তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে বলেও জানান নানক। বলেন, 'বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যেই সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে পাড়া-মহল্লায়-রাজপথে কঠিন প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি ও সকল হত্যা-সহিংসতার দায় আন্দোলনকারী নেতৃত্বকেই নিতে হবে।
এছাড়া বিএনপি-জামায়াত দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে চাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন নানক। আরও বলেন, 'আমাদের শেষ রক্তবিন্দু থাকতে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের আস্ফলন সহ্য করব না।'
নতুন কর্মসূচি ঘোষণা আন্দোলনকারীদের
অসহযোগ আন্দোলনের শুরুর দিনে পরদিন ৫ আগস্ট সোমবার থেকে তিন দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার।
এরমধ্যে ৪ আগস্ট রোববার দুপুরে ৬ আগস্টের 'লংমার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচি একদিন এগিয়ে আনার ঘোষণা দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম।
একইদিন অর্থাৎ ৫ আগস্ট সকাল ১১টায় ঢাকার শাহবাগে শ্রমিক সমাবেশ এবং বিকেল পাঁচটায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নারী সমাবেশের ডাক দেওয়া হয়।
পাশাপাশি সারা দেশে বিক্ষোভ-আন্দোলন এবং গণঅবস্থান কর্মসূচি অব্যাহত রাখার ঘোষণাও আসে।
এছাড়া সারা দেশের সকল জেলা, উপজেলা, গ্রামে এবং পাড়া-মহল্লায় ছাত্রদের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গঠন করার আহ্বান জানান নাহিদ।
গ্রেপ্তার কিংবা অন্য কোনো কারণে সমন্বয়কদের কেউ যদি পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করতে না পারেন, সেক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের পতনের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত রাজপথ দখলে রেখে শান্তিপূর্ণভাবে অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বানও জানান নাহিদ।
Comments