জুলাইয়ের কার্টুন বিদ্রোহ

কার্টুনিস্ট: মেহরাব সিদ্দিক সাবিত

২০১০ সালের মাঝামাঝির কথা। আমি তখন একটি দৈনিক পত্রিকার সাপ্তাহিক স্যাটায়ার ম্যাগাজিনের সম্পাদনার দায়িত্বে। একদিন সম্পাদক জানালেন, যদি সম্ভব হয় প্রধানমন্ত্রীকে বিদ্রূপ করে কোনো ক্যারিকেচার না ছাপাতে, ছাপা পরবর্তী প্রতিক্রিয়া খুবই খারাপ হয় উনার, সেটা সামলানো মুশকিল। যেকোনো দিন আরও খারাপ কিছু হতে পারে।

স্বভাবতই আমার মন খুব খারাপ হলো। কার্টুন ছাপানোর ক্ষেত্রে এমনিতেই আমরা বাধ্য হই নির্দিষ্ট কিছু বিষয় এড়িয়ে চলতে। সেই জায়গাটা এবার আরও সংকুচিত হলো। তাহলে আমরা ছাপবো কী? পত্রিকার মূলপাতায় কমে গেলো শিশির ভট্টাচার্যের কার্টুন, অন্যান্য দৈনিকের পাতাও কার্টুনের জন্য বরাদ্দ অংশ দিনদিন কমতে থাকলো।

এরপর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেছে। আমরা প্রধানমন্ত্রীকে বিদ্রূপ করে কোনো কার্টুন আর ছাপতে পারিনি। একসময় পরিস্থিতি এমন হলো, পত্রিকাটি স্যাটায়ার ম্যাগাজিনটাই বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলো। এ নিয়ে দ্বিতীয়বার পত্রিকাটি তাদের জনপ্রিয় স্যাটায়ার ম্যাগাজিন বন্ধ করলো। পরবর্তী সময়ে যারাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ নানা মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে বিদ্রূপ করার চেষ্টা করেছেন, আমরা জানি তাদের মধ্যে অনেকেরই ঠাঁই হয়েছে জেলে—কুখ্যাত ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের কারণে। প্রধানমন্ত্রী হয়ে উঠেছিলেন কার্টুন, স্যাটায়ার আর হিউমারের ঊর্ধ্বে।

কার্টুনিস্ট: অধরা

স্যাটায়ার ও হিউমারের একটা বিশেষ ধর্ম হলো, যে পরিবেশ যত বেশি অবরুদ্ধ, সেই পরিবেশে বুদ্ধিদীপ্ত রেফারেন্সধর্মী হিউমারের প্রবণতা আরও বেশি দেখা যায়। সে কারণে (আমার মতে), পৃথিবীর অন্যতম ফাইনেস্ট পলিটিক্যাল জোকসগুলো তৈরি হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নে জার বা স্ট্যালিন পিরিয়ডে। বাংলাদেশে এর মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া বুমের কারণে মিম কালচারের প্রবর্তন শুরু হয়েছে। সেইসঙ্গে শুরু হয়েছে দ্ব্যর্থবোধক নতুন নতুন শব্দ দিয়ে স্যাটায়ারের যাত্রা—সামাজিক মাধ্যমের পরিসরে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে 'উগান্ডা', 'নাম বললে চাকরি থাকবে না', 'ইউ নো হু' এর মতো ফ্রেজ। কিন্তু টিমটিম করে জ্বলতে থাকা এক-দুটি পত্রিকা ছাড়া বাংলাদেশের পত্রিকা থেকে পলিটিক্যাল কার্টুন বলতে গেলে প্রায় হারিয়েই গেলো।

কার্টুনিস্ট: অপু

এমন না যে বাংলাদেশের পলিটিক্যাল কার্টুনের ইতিহাস খুব একটা পোক্ত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে ছিল না। সেই বায়ান্নতেই বাংলা ভাষার ওপর যখন আক্রমণ হলো, তখন উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম কার্টুনিস্ট কাজী আবুল কাশেম (দোপেঁয়াজা)-এর 'হরফ খেদাও' কার্টুন দারুণ অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে মানুষের মাঝে। শিল্পী কামরুল হাসানের আঁকা ইয়াহিয়া খানের সেই বিখ্যাত ক্যারিকেচার 'এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে' তো এক আইকনিক চিত্রেই পরিণত হয়ে গেছে, সঙ্গে তার স্বৈরাচার এরশাদকে নিয়ে আঁকা স্কেচ 'দেশ আজ বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে' বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল।

কার্টুনিস্ট: আপন রাহাদ

শিল্পী রফিকুন নবী 'রনবী' পরিচয়ে 'টোকাই' চরিত্রের মাধ্যমে দীর্ঘদিন তুলে ধরেছেন সমাজের বৈষম্য, রাজনৈতিক ভাষ্য। কাইয়ুম চৌধুরী, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনরাও এঁকেছেন প্রচুর। আর শিল্পী শিশির ভট্টাচার্যের হাত ধরে তো বাংলাদেশের রাজনৈতিক কার্টুনের চিত্রটাই পাল্টে গেছে অনেকখানি। পত্রিকায় পাতায় তার একটা কার্টুনের জন্য অপেক্ষা করতো পাঠক, সেই কার্টুন হয়ে উঠতো টক অব দ্যা টাউন।

সেই সময়েই হুদা, কুদ্দুস, বিপুল, নজরুল এঁকে গেছেন সমানতালে। তাদেরকে সামনে আইকন হিসেবে রেখে একঝাঁক তরুণ কার্টুনিস্ট যখন মাত্র জ্বলে উঠতে শুরু করেছে, তখনই শুরু হয়েছে বাংলাদেশে বাকস্বাধীনতার খর্ব হওয়ার কাল। ধীরে ধীরে এই তরুণ কার্টুনিস্টের দল পত্রিকার পাতায় আর জায়গা না পেয়ে হতাশ হয়ে অন্য মাধ্যমে তাদের ক্যারিয়ার শুরু করে। এরমধ্যে কার্টুনিস্ট পরিচয়ে কিশোরের জেল তাদের মধ্যে আরেক পরত ভয় ঢুকিয়ে দেয়।

কার্টুনিস্ট: বিপ্লব চক্রবর্তী

আমি নিজে পলিটিক্যাল কার্টুনের মস্ত বড় ফ্যান। তাই, যখন দৈনিক পত্রিকার স্যাটায়ার ম্যাগাজিনের ছেলে অনলাইন স্যাটায়ার ওয়েব ই-আরকি সম্পাদনা শুরু করলাম, তখন মনে হলো এবার নিয়মিত পলিটিক্যাল কার্টুন ছাপা যাক। কিন্তু ততদিনে পরিচিত প্রায় সব কার্টুনিস্টই পলিটিক্যাল কার্টুন আঁকা ছেড়ে দিয়ে অন্য ক্ষেত্রে কাজ করা শুরু করেছে। হাতেগোনা দুয়েকজনের মাঝে নিয়মিত কার্টুন করে যাচ্ছে মেহেদী হক। একদিন মেহেদীর সঙ্গে পরামর্শ হলো, পুরোনোদের দিয়ে আর হবে না। চলেন, নতুন ছেলে-মেয়েদের একটু সাহস আর উৎসাহ দেই কার্টুন আঁকার জন্য। একটা পলিটিক্যাল কার্টুন এক্সিবিশন আর কিছু ওয়ার্কশপ করাই। দেখি কিছু কার্টুনিস্ট পাওয়া যায় কি না।

কার্টুনিস্ট: মেহেদী হক

২০২৩ সালের মার্চে আমরা সেই পলিটিক্যাল কার্টুনের প্রদর্শনী শুরু করলাম ধানমন্ডির ইএমকে সেন্টারে, সঙ্গে তিনদিনের টানা ওয়ার্কশপ। প্রদর্শনীতে রাখা হলো ১৯৫২ থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিক্রমায় গুরুত্বপূর্ণ এ পর্যন্ত আঁকা বাছাই করা প্রায় ১৫০টির মতো পলিটিক্যাল কার্টুন।

রফিকুন নবী, শিশির ভট্টাচার্য্যের সঙ্গে দেশের রাজনীতি বিশ্লেষক, সিভিল রাইটস, ফ্রিডম অব স্পিচ নিয়ে কাজ করা অনেকেই ওয়ার্কশপে এলেন তরুণ কার্টুনিস্টদের সঙ্গে কথা বলতে। ৪০ জন তরুণ কার্টুনিস্ট এই তিনদিনে অনেক আঁকলেন, কথা বললেন, কথা শুনলেন, তর্ক-বিতর্ক করলেন। মনে হলো, তারা কিছুটা সাহস পেলেন। আমরা কিছু কার্টুনিস্ট পেলাম সেখান থেকে। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন নিয়মিত আঁকতে থাকলেন আমাদের সঙ্গে ও সোশ্যাল মিডিয়ায়।

কার্টুনিস্ট: সাদাত মাহতাব

এরপর ২০২৪ সালের একতরফা নির্বাচনের আগে আগে আমরা 'ইলেকশন দ্য সিলেকশন' নামে আরেকটা প্রদর্শনীর আয়োজনের জন্য ওপেন কল দিয়ে কার্টুন আহ্বান করলাম। এবার ফলাফল দেখে খুবই অবাক। অসাধারণসব কার্টুন এসেছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী একেবারে নবীন কার্টুনিস্টদের কাছ থেকে। মনে হলো, কে বলেছে আমাদের তরুণরা কার্টুন আঁকা ভুলে গেছে! মূলধারার পত্রিকার পাতার সম্পাদকরা সেলফ সেন্সরশিপে পড়েছে বলে আমরা তাদের আঁকা দেখতে পাই না।

প্রায় সাড়ে ৫০০ কার্টুন থেকে বাছাই করে ১০০ কার্টুন নিয়ে দৃক গ্যালারিতে শুরু হলো প্রদর্শনী। সেটা দেখতেও এলেন প্রচুর মানুষ। বুঝলাম, দেশের মানুষের কার্টুন নিয়ে আগ্রহের কোনো ভাটা পড়েনি এখনো। আর এই রিলস আর মিমের দুনিয়ায় কার্টুন নিয়ে মানুষের আগ্রহ যেহেতু আছে, তাহলে কার্টুন আবার বিপুল বিক্রমে ফিরবেই।

কার্টুনিস্ট: মেহেদী হক

কিন্তু সেটা এভাবে ফিরবে, একবারও কল্পনা করিনি। জুলাইয়ের ১ তারিখ থেকে কোটা আন্দোলন নামে গণঅভ্যুত্থান শুরু হলেও কার্টুনিস্টরা একেবারে বারুদের মতো জ্বলে উঠলেন ১৫ তারিখের পর থেকে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের নির্যাতনের ছবি দেখে, পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর ভিডিও দেখে যখন পুরো জাতি স্তম্ভিত, তখন শিল্পীদের মধ্য থেকে কার্টুনিস্টরাই প্রথম প্রতিবাদের বারুদ জ্বালিয়ে দিলেন। দীর্ঘদিনের ভয় আর জং ধরা কলমগুলো যেন ঝনঝন করে উঠতে লাগলো খোলা তলোয়ারের মতো। দীর্ঘদিন পর কার্টুনে সরাসরি এলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবয়ব—হাতে তার রক্তের দাগ, খুনের চিহ্ন। মাহতাব রশীদ আঁকলেন, মাথায় হেলমেট পরা খুনি ছাত্রলীগকে প্রশংসা করছেন প্রধানমন্ত্রী। আরেকজন আঁকলেন, আবু সাঈদের বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অবয়ব।

কার্টুনিস্ট: মিঠু

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পেজ থেকে কয়েক ঘণ্টাতেই সেটা ছড়িয়ে পড়লো দাবানলের মতো। 'খুনি হাসিনা' আর 'স্বৈরাচার' থিমের কার্টুনে দেখতেই দেখতেই ভরে উঠলো নিউজফিড। মানুষের তীব্র হতাশা, যন্ত্রণা, রাগ, ক্ষোভ প্রকাশের প্রধান মাধ্যমই হয়ে উঠলো যেন কার্টুন। এতদিন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যে ভয়ে মানুষ সরকারের একটু সমালোচনামূলক পোস্টেই রিয়্যাক্ট করতে ভয় পেতো, সেটা যেন বালির বাঁধের মতো ভেঙে গেলো। দাবানলের মতো কার্টুন ছড়িয়ে পড়লো মানুষের শেয়ার, আপলোড আর রিআপলোডে।

কার্টুনিস্ট: শাহাদাত

গণআন্দোলনে কার্টুনের ব্যবহার বরাবরই হয়ে থাকে। কিন্তু ৩৬ দিনে হওয়া ২৪ সালের এই জুলাইয়ের শেষ ২০ দিনে যত কার্টুন হয়েছে, এমন কার্টুন মনে হয় বাংলাদেশ এর আগে কখনো দেখেনি। সবচেয়ে বড় কথা, এইসব কার্টুনের বেশিরভাগই এঁকেছেন একেবারে নবীন কার্টুনিস্টরা। তারমধ্যে অনেকেরই হয়তবা এবারই প্রথম প্রকাশিত পলিটিক্যাল কার্টুন। কিন্তু তাদের কার্টুন দেখলে একবারও আপনার মনে হবে না, এরা নবীন আঁকিয়ে। যেমন ক্ষুরধার আইডিয়া, তেমনি তাদের আঁকার মুন্সিয়ানা। আরেকটি বিষয় ছিল লক্ষ্য করার মতো, বেশিরভাগ কার্টুনেরই কালার প্যালেট ছিল রক্তের লাল রংয়ের। এ দিয়ে বোঝা যায়, স্বৈরাচার সরকারের পাখির মতো মানুষ খুন করাটাই কার্টুনিস্টদের মনে সবচেয়ে বেশি রেখাপাত করেছে।

শেখ হাসিনার পতনের পর এই গণঅভ্যুত্থানে আঁকা কার্টুন থেকে বাছাই করা ১৭৫টি কার্টুন নিয়ে যখন দৃক গ্যালারিতে একটা প্রদর্শনীর আয়োজন করল ই-আরকি, দৃক ও বাংলাদেশ কার্টুনিস্ট অ্যাসোসিয়েশন, সেখানে এত দর্শক এসেছিল যে, এটা ছিল দৃকের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ভিজিটেড এক্সিবিশন। 

কার্টুনিস্ট: তীর্থ

মানুষের অনুরোধে এক্সিবিশনের সময়ও বাড়ানো হয়েছিল আরও এক সপ্তাহ। এ থেকে বোঝা যায়, কার্টুন এখনো মত প্রকাশের অন্যতম শক্তিশালী একটা মাধ্যম। যে মাধ্যমে পাঠক-দর্শকরাও আশা করে, একঝাঁক নবীন কার্টুনিস্ট এখন থেকে আবারও এঁকে বেড়াবে বাঁধাহীন, এক নতুন বাংলাদেশের ছবি—যে ছবি কথা বলবে হাজার শব্দের চাইতেও বেশি।

২০২৪ যেমন বাংলাদেশের ইতিহাসে লেখা থাকবে গণআন্দোলনের বছর হিসেবে, তেমনই লেখা থাকবে কার্টুনের বছর হিসেবেও।

সিমু নাসের: পলিটিক্যাল স্যাটায়ারিস্ট ও সম্পাদক, earki.co

Comments

The Daily Star  | English

Have patience for election

Chief Adviser Prof Muhammad Yunus yesterday said the government would issue a roadmap to the election as soon decisions on electoral reforms are made.

6h ago