সংশপ্তক শহীদুল্লাহ কায়সার

শহীদুল্লাহ কায়সার।

ঢাকার কারাগারে বসে ডায়েরির পাতায় তিনি দিনের পর দিন লিখতেন। কখনো রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে যেতো। কিন্তু তার লেখা থামছে না। জেল থেকে মুক্ত হওয়ার এক মাস পরে ১৯৬২ সালের নভেম্বর মাসে ছাপা হলো তার বিখ্যাত উপন্যাস 'সারেং বউ'। 

কেবল সারেং বউই নয় বিখ্যাত উপন্যাস 'সংশপ্তক', 'রাজবন্দীর রোজনামচা'ও লেখা কারাগারে বসে। জীবনের একটা বড় একটি সময়ই শহীদুল্লা কায়সার ছিলেন কারাগারের নির্জন গহীন প্রকোষ্ঠে। তার বিখ্যাত উপন্যাস 'সংশপ্তক' রচনা করেছিলেন বাস্তব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে।

সাহিত্য তার আপোষের জায়গা ছিল না। বারবার দৃঢ় হয়ে সত্য প্রকাশ করেছেন নিঃসঙ্কোচে। কেবল সাহিত্যই নয়, রাজনীতি, সাংবাদিকতা বা জীবনের আদর্শ কোথাও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। তিনি কখনোই আপোষ করতে শেখেননি। বরং বারবার সাহস জুগিয়েছেন। জাতির ক্রান্তিলগ্নে এগিয়ে এসেছেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাত্রির গণহত্যার পর যখন বহু শিল্পী, বুদ্ধিজীবি সাহিত্যিক দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন, নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য হন্নে হয়ে ঘুরেছেন তখন শহীদুল্লা কায়সার ছিলেন ঢাকায়। তিনি কর্মরত ছিলেন দৈনিক সংবাদ-এ।

২৫ মার্চ কালরাত্রে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পুড়িয়ে দিলো দৈনিক সংবাদের অফিস। এসময় অনেকেই তাকে বলেছিলেন দেশ ছেড়ে চলে যেতে। অনেকে বললেন, এই মুহূর্তে দেশে থাকা আপনার উচিত নয়। আপনি ভারতে চলে যান। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার ফিরে আসবেন। ওরা কাউকেই রাখবে না।

তিনি নিজেও শুনেছিলেন ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনা। কমরেড মনি সিংহ বলেছিলেন, এই মুহূর্তে তোমার থাকা আর ঠিক না। ভারত থেকেও কাজ করা যাবে। জবাবে তিনি স্পষ্টভাবে বলেছিলেন 'সবাই যদি চলে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করবে কে? আর এই তথ্যগুলো আমার উপন্যাসের কাজে লাগবে।'

শহীদুল্লা কায়সারের রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়েছিল মাত্র ১৪ বছরে বয়সে। মহাত্মা গান্ধীর ভারত ছাড় আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। তবে রাজনীতিতে পুরোদস্তুর প্রবেশ পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে ১৯৪৭ সালে। তার ৪ বছর পরে হন পার্টির সদস্য। পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য।

একদিকে সাংবাদিকতা, একদিকে রাজনীতি আবার একদিকে সাহিত্যকর্ম। তার পরিব্যাপ্তি ছিল ত্রিমুখী। 'দেশপ্রেমিক' ছদ্মনামে রাজনৈতিক পরিক্রমা ও 'বিশ্বকর্মা' ছদ্মনামে বিচিত্রা কথা শীর্ষক উপ-সম্পাদকীয় রচনা যার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। ভাষা আন্দোলনে রাজনৈতিক ভূমিকার কারণে ১৯৫২ সালের ৩ জুন তিনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। বিচারে তাকে সাড়ে ৩ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। ১৯৫৫ সালে মুক্তি পাওয়ার কিছুদের মধ্যেই তিনি ফের আটক হন।

১৯৫৮ সালে তিনি মুক্তি পেলেন। দৈনিক সংবাদ এর সম্পাদকীয় বিভাগে সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ওই বছরই কিন্তু ৭ অক্টোবর সামরিক আইন জারি হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে ১৪ অক্টোবর তাকে জননিরাপত্তা আইনে ফের গ্রেপ্তার করে আইয়ুব সরকার। এরপর তিনি মুক্তি পেলেন প্রায় ৪ বছর পরে ১৯৬২ সালের অক্টোবরে। সাংবাদিকতা ছিল শহীদুল্লা কায়সারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সাংবাদিকতার শুরু মাত্র ২২ বছর বয়সে ইত্তেফাক পত্রিকায়। তখন ইত্তেফাক ছিল সাপ্তাহিক পত্রিকা। ১৯৬২ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি ফের ফিরে এসেছিলেন দৈনিক সংবাদ এ।

মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন তিনি ঢাকার থাকতেন না তখন রেশনকার্ড দিয়ে যেতেন কবি সুফিয়া কামালের কাছে। কবি সুফিয়া কামাল রেশন কার্ড দিয়ে জিনিসপত্র তুলে আনতেন আর শহীদুল্লা কায়সার ঢাকায় ফিরে সেই জিনিসপত্র মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। কেবল তাই নয়, তার বাসাও ছিলো মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল। এখান থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার দেয়া হতো।

১০ ডিসেম্বর থেকে যখন পরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী নিধন পূর্ণ মাত্রায় শুরু হয়ে গেল তখন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন তার পরিবার। বিশেষ করে ১০ ডিসেম্বর ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে উঠিয়ে নিয়ে গেল আলবদর বাহিনী। ঠিক এক ঘণ্টা পরেই পিপিআইর প্রধান প্রতিবেদক ও কলম্বিয়া ব্রডকাস্টিং সার্ভিসের প্রতিবেদক সৈয়দ নাজমুল হককে পুরানা পল্টনের বাসা থেকে ও ভোর ছয়টার দিকে দৈনিক পূর্বদেশের প্রধান প্রতিবেদক এএনএম গোলাম মুস্তাফাকে গোপীবাগের বাসা থেকে ধরে নিয়ে গেল। ১২ ডিসেম্বর আলবদরের বেশ কয়েকজন তরুণ পিপিআইর জেনারেল ম্যানেজার ও বিবিসির প্রতিবেদক নিজামউদ্দিন আহমেদকে পুরান ঢাকার কলতাবাজারের তার বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর ১৩ ডিসেম্বর শহীদুল্লা কায়সার পরিবারের চাপে নিরাপত্তার জন্য বাসা ছাড়তে বাধ্য হলেন। তিনি ভাবলেন ঢাকাতেই কোথাও আত্মগোপনে থাকবেন। কিন্তু বাসা ছাড়ার আধঘন্টা পর তিনি ফিরে এলেন। স্ত্রী পান্না কায়সারকে বললেন, 'আমি একা থাকবো না। তোমাদের নিয়ে একসাথে থাকবো!'

এদিন রাতে খাওয়ার পর স্ত্রীকে একটি চিঠি লিখলেন শহীদুল্লা কায়সার। চিঠির ভাষাটা এমন 'প্রিয়তমা সুপান্না কায়সার, আমার ছেলে-মেয়েগুলোকে তুমি যত্নে রেখো। আমি জানি, তুমি পারবে। তুমি ভালো থেকো। আমি কখনো কোথাও তোমার কাছ থেকে হারিয়ে যাবো না।'

১৪ ডিসেম্বর। সন্ধ্যা গড়িয়ে আসছে। পুরান ঢাকার কায়েতটুলির বাসায় শহীদুল্লা কায়সার মোমবাতি জ্বালিয়ে বিবিসি শোনার জন্য অপেক্ষা করছেন। তখন তার স্ত্রী পান্না কায়সার শিশু কন্যা শমী কায়সারকে ফিডারে দুধ খাওয়াচ্ছেন। ঠিক এমন সময় দরজায় ঠক ঠক করে কড়া নাড়ার শব্দ হলো। শহীদুল্লা কায়সারের ছোট ভাই ওবায়দুল্লা এসে শহীদুল্লাহ কায়সারকে বললেন, 'বড়দা দরজায় কে যেন কড়া নাড়ছে খুলে দেব?'

শহীদুল্লা কায়সার ভাবলেন কোনো মুক্তিযোদ্ধা হবে। তিনি বললেন, নিশ্চয়ই মুক্তিযোদ্ধারা হবে। জলদি দরজা খুলে দে।' তিনি নিজেও আলমারি খুলে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সংগৃহীত অর্থ গুণতে লাগলেন। কিন্তু না। কালো কাপড়ে মুখ জড়ানো চার পাঁচ জন তরুণ এসে বললো, 'শহীদুল্লা কায়সার কে?' জবাবে শহীদুল্লা কায়সার বললেন, 'আমিই শহীদুল্লা কায়সার। কী দরকার বলুন?'

তখন একজন বলল, আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে একটু' বলে তাকে ধরলো। এর মধ্যে শহীদুল্লা কায়সারের বোন ও স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, 'আপনারা তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? জবাবে তরুণরা সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললো, ' তাকে কিছুক্ষণ পর আমরা ছেড়ে দেবো।'

কিন্তু সেই যে গেলেন আর ফিরে এলেন না শহীদুল্লা কায়সার। যাওয়ার আগে শুধু একবার হালকা গলায় বললেন 'ভালো থেকো।' বাইরে তখন কারফিউ চলছে, গভীর অন্ধকারে ধীরে ধীরে তাকে বহনকারী গাড়িটি অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। আর ফেরা হলো না শহীদুল্লা কায়সারের। রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে বুদ্ধিজীবীদের অনেকের লাশ চিহ্নিত করা গেলেও পাওয়া যায়নি শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কায়সারের লাশ।

সূত্র-

একাত্তরের শহীদ শহীদুল্লা কায়সার/ পান্না কায়সার

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র ৮ম খণ্ড

Comments

The Daily Star  | English

Mindless mayhem

The clashes between students of three colleges continued yesterday, leaving over 100 injured in the capital’s Jatrabari.

5h ago