কাফকার চিঠিতে কর্তৃত্বপরায়ণ পিতার স্বরূপ
প্রাহা কাফকার শহর। শহরের এক প্রান্তে অবস্থিত প্রাচীন সমাধিস্থলে প্রবেশের সময় ধর্মানুরাগী ইহুদিদের পরিধেয় ক্ষুদ্র একটি টুপি হাতে ধরাইয়া দেওয়া হইল। সমাধিস্তম্ভের পাদদেশে বিশুষ্ক পুষ্পরাশি কাহারও মমতার স্বাক্ষর বহন করিতেছে। কাফকার জন্মবার্ষিকী উপলক্ষেই এই পুষ্পাঞ্জলি। সমাধি কেবলই স্মৃতিফলক নহে, ইহা বর্তমান ও অতীতের অনস্বীকার্য সেতু। কাফকার সমাধিস্থলে দাঁড়াইয়া মন বিষণ্ণ হইল। হারম্যান সাহেবের এই পুত্রের জীবন সুখের হয় নাই। তিনি যশস্বী হইয়াছেন, আজ চেক রিপাবলিকের রাজধানী প্রাহা (বা প্রাগ) 'কাফকার শহর' বলিয়াই পরিচিত। কিন্তু আশৈশব জীবন কাটিয়াছে নিদারুণ যন্ত্রণায়। এই যন্ত্রণার সূত্রপাত হইয়াছিল শৈশবেই। পিতা হারম্যান কাফকা তাহার খবর রাখিতেন না।
তখন প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ হইয়া গিয়াছে। একদিন পিতা পুত্রকে জিজ্ঞাসা করিলেন, 'আচ্ছা, তুমি আমাকে এত ভয় পাও কেন?'
অনুমিত হয় সদা ভয়-তটস্থ কাফকা এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়া মাথা হেঁট করিয়াছিলেন, পালাইয়া বাঁচিয়াছিলেন। কাফকার বয়স ৩৬। পিতার ওপর তিনি মহাক্ষুব্ধ। ধরিতে গেলে পিতার ইচ্ছা ও ষড়যন্ত্রেই প্রণয়ী ফেলিসের সহিত সম্প্রতি তাহার সম্পর্কচ্ছেদ হইয়াছে।
কয়েক মাস পর নভেম্বরের (১৯১৯) এক সন্ধ্যায় মাথায় ভূত চাপিলে কাফকা তাহার পিতাকে উদ্দেশ্য করিয়া এই প্রশ্নের জবাব লিখিতে বসিলেন। এক-বাক্য প্রশ্নটির জবাব দীর্ঘ হইল। প্রাহা শহরে অবস্থিত কাফকা মিউজিয়ামে দেখিয়াছি ১৯২২-এ মৃত্যু শয্যা হইতে ছুটি চাহিয়া ইন্সুরেন্স অফিসে দরখাস্ত করিতে কাফকার ফুলস্ক্যাপ কাগজের আড়াই পাতা লাগিয়াছিল। চিঠির মাধ্যমে বাবার প্রশ্নের উত্তর লিখিতে লিখিতে কাফকা ছোটোখাটো একটি বই লিখিয়া ফেলিলেন। ইংরাজি অনুবাদে ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত বইটির নাম 'লেটার টু ফাদার' (বাবাকে লেখা পত্র)। বইটির দৈর্ঘ্য ৭২ পাতা। চিঠি লিখিতে কাফকা পারঙ্গম ছিলেন বটে। শত শত পত্র তাহার প্রণয়াকুল হৃদয়ের আবেগ অভিব্যক্ত করিয়া নির্মাণ করিয়াছেন শব্দপ্রাসাদ।
কথিত আছে দীর্ঘ এই পত্র বাবার হাতে পৌঁছানের জন্য কাফকা মাকে দিয়াছিলেন; মা তাহা স্বামী হারম্যান কাফকার হাতে পৌঁছাইতে সাহস করেন নাই। তবে সত্যই বাবার হাতে পৌঁছানোর জন্য কাফকা পত্রোপাখ্যানটি মাকে দিয়াছিলেন কি না তাহা নিশ্চিতভাবে নিরূপণ করা সম্ভব হয় নাই। কারণ হাতে লেখা পাণ্ডুলিপির সঙ্গে কাফকার নিজ হাতে সংশোধিত টাইপ করা পাণ্ডুলিপি ও উদ্ধার হইয়াছে।
জীবদ্দশায় কাফকা বহু রচনা স্বহস্তে বিনষ্ট করিয়াছেন। অপ্রকাশিত রচনা, চিঠিপত্র, দিনপঞ্জী ইত্যাদি মৃত্যুর পর নষ্ট করিয়া ফেলিবার জন্য কাফকা তাহার অনুরাগী বন্ধু ম্যাক্স ব্রডকে বিশেষভাবে অনুরোধ করিয়া গিয়াছিলেন। এইরূপ অনুরোধ করা সহজ হইতে পারে, তাহা রক্ষা করা কঠিন। ম্যাক্স ব্রডও এই অনুরোধ রক্ষা করিতে পারেন নাই। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে বন্ধুর অকাল মৃত্যুর পর অপ্রকাশিত রচনাসম্ভার সযত্নে উদ্ধার, সংরক্ষণ ও প্রকাশ করিয়াছেন। তবে বাবাকে লেখা পত্র প্রকাশে ম্যাক্স ব্রড দ্বিধান্বিত হইয়াছিলেন। দীর্ঘ বিবেচনার পর ম্যাক্স ব্রড যখন ১৯৫৩ খ্রিষ্ট্রাব্দে বাবাকে লেখা পত্রটি কাফকা-সমগ্রের অংশ হিসাবে প্রকাশ করিলেন ততদিনে হারম্যান কাফকা লোকান্তরিত হইয়াছেন।
চিঠিটি শুরু হইয়াছে এইভাবে:
প্রিয়তম বাবা,
কিছুদিন আগে আপনি জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন আমি আপনাকে এত ভয় পাই কেন।
এই প্রশ্নের উত্তর সহসা আমার মুখে আসে নাই: অংশত আপনারই ভয়ে, অংশত এই ভয়ের কারণ এমনই বিস্তীর্ণ যাহা বাক্যবন্দি করা আমার সাধ্যাতীত। এই চিঠিতে আমি আপনার প্রশ্নটির জবাব দেওয়ার চেষ্টা করিতেছি। তবে কার্যত জবাবটি পরিপূর্ণ হইবে না, কারণ লিখিতে বসিয়াও আমার ভয়-তাড়না কলমের গতি রূদ্ধ করিয়া দিতেছে, আর বিষয়টির পরিধি এতই ব্যাপক যে, তাহা আমার স্মৃতি আর উপলব্ধিশক্তির অতীত।...
সন্দেহ নাই হারম্যান কাফকার পর্বতসমান ব্যক্তিত্ব, সফলতা, দম্ভ এবং ভর্ৎসনা ফ্রানৎস কাফকার কিশোর অবচেতনায় অনপনেয় ছাপ মুদ্রিত করিয়া গিয়াছিল। শৈশবে পিতৃভয়ে সদা-তটস্থ কাফকা যৌবনেও বাবাকে কাছের মানুষ মনে করিতে পারেন নাই। বাহাত্তুর পৃষ্ঠার এই দীর্ঘ চিঠিতে পিতা-পুত্রের এই দূরত্বের বিশদ ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ রহিয়াছে।
কাফকার অনুরাগী পাঠক এই পুস্তকাকারে প্রকাশিত পত্র পাঠে আগ্রহী হইবেন আশ্চর্য কী! কিন্তু ইহা আত্মজীবনীর আদলে লেখা হয় নাই। দৃশ্যত ইহা পিতার কাছে পুত্রের ব্যক্তিগত অকপট একখানি চিঠি। তবে কাফকার লেখনীশৈলী ইহাকে আকর্ষণীয় এক উপাখ্যানে পরিণত করিয়াছে। পিতাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাইয়া কাফকা শৈশব-কৈশোর-যৌবনের অবদমনের পূর্ণ প্রতিশোধ লইয়াছেন বটে। স্মরণ করা যাইতে পারে যে, দ্য জাজমেন্ট নামীয় গল্পটিরও কেন্দ্রে রহিয়াছে পিতা-পুত্রের দ্বন্দ্ব। এই চিঠিতে পিতা-পুত্রের দূরত্বের জন্য কাফকা পিতাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাইলেও নিজেকেও যথেষ্ট দূষিয়াছেন। তিনি ভীরু ছিলেন বলিয়াই গোঁয়ার হইয়াছিলেন। বদরাগী বাবার মেজাজ খারাপ করিবার সুযোগ হেলায় নষ্ট করেন নাই। তবে তাহার শেষ কথা: বাবা একটু সহৃদয়, একটু মমতাময় হইলে সম্পর্কটি উষ্ণ ও স্বাভাবিক হইয়া উঠিত।
যেকোনো লেখকের বয়ানে রচিত উপাখ্যান যে ঠিক অতিকথন নহে, বরং মোচড় দিয়া বাস্তবকে প্রকটিত করিবার যে প্রবণতা, তাহা আমরা কাফকার রচনায় আদ্যোপান্ত লক্ষ্য করি তাহার প্রভাব হইতে বাবাকে লেখা চিঠি মুক্ত এইরূপ অনুমানের কোনো কারণ নাই। বাবাকে লেখা চিঠিতে এক পর্যায়ে কাফকা কর্তৃত্বপরায়ণ পিতা হারম্যান কাফকাকে শস্যখেকো পোকার সহিত তুলনা করিয়াছেন যাহা দংশনে দংশনে শস্যকে নিরক্ত করিয়া ফেলে। 'মেটামরফসিস' গল্পটিতে মানুষকে তেলেপোকা বানাইয়া কাফকা সাহেব অদৃষ্টপূর্ব কল্পনাপ্রতিভার স্বাক্ষর রাখিয়াছেন। ইতোমধ্যে বিলম্ব হইয়া গেলেও একটি শান্তিশুভ্র সম্পর্ক এখনো গড়িয়া তোলা অসম্ভব নহে।
পরাক্রমশালী পিতার রূদ্রমূর্তিতে সদা-সন্ত্রস্ত কাফকা চিঠির এক জায়গায় উল্লেখ করিয়াছেন, '... এক ধরনের প্রতিশোধস্পৃহার বশবর্তী হইয়া আমি আপনার আচরণ-স্বভাবের পরিহাসতুল্য ক্ষুদ্র বিষয়াদিও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও অতিরঞ্জন করিতে শুরু করি।' কাফকার পিতা হারম্যান ছিলেন বিশাল মাপের পুরুষ। সামাজিক প্রতিপত্তি অর্জনে তাহার প্রচেষ্টা কাফকার চোখে হাস্যকর প্রতিভাত হইত। বাবাকে লেখা চিঠিতে এই নিয়া ব্যঙ্গ করিতে কাফকা কার্পণ্য করেন নাই। প্রতিটি বিষয়েই কাফকা বাবার আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গী ও ব্যবহার লইয়া পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করিয়াছেন। কাফকার সিদ্ধান্ত: দীনহীন অবস্থা হইতে যাহারা নিজগুণে যশস্বী হইয়া ওঠে তাহাদের আত্মবিশ্বাস আগ্রাসী হইয়া পড়ে। তুলনা করিয়া অন্যকে খাটো প্রতিপন্ন করা তাহাদের অভ্যাসে পরিণত হয়। নিজ পুত্রও এই আগ্রাসন হইতে ছাড় পায় না। হারম্যান কাফকা ইহার ব্যতিক্রম নহেন। কিশোর পুত্রের যেকেনো প্রস্তাব, যেকোনো ভাবনা তুচ্ছ প্রতিপন্ন করিয়া বাতিল করিয়া দিতে তিনি কখনো বিলম্ব করেন নাই।
এই কৌতুকাবহ চিঠিতে কেবল পিতা হারম্যান কাফকারই প্রতিচ্ছবি অঙ্কিত হয় নাই, একই সঙ্গে পুত্র কাফকার একটি আত্মপ্রতিকৃতি ফুটিয়া উঠিয়াছে। কাফকা তাহার বাবাকে বীরোচিত 'খাঁটি কাফকা' এবং নিজেকে 'রোগা-পটকা, দুর্বল, তুচ্ছ' হিসাবে বর্ণনা করিয়াছেন। সর্বত্র এই প্রতিতুলনা চিঠিটিকে আকর্ষণীয় করিয়া তুলিয়াছে।
হাতে লেখা শতাধিক পৃষ্ঠার এই চিঠি ছাড়াও বহু চিঠিতে ও লেখায় কাফকা স্বীয় জীবন, জীবনোপলব্ধি ও দার্শনিক অনুভবের বয়ান দিয়াছেন। অনেক পণ্ডিতের মত এই যে, অতিশয়োক্তি ও অতিরঞ্জিত এই বয়ানের ঘাড়ে চাপিয়া বসিয়া আছে। এই সব পড়িয়া যে বিষণ্ণ কাফকার প্রতিরূপ মূর্ত হইয়া উঠে কাফকা আদৌ তেমনটি নাকি ছিলেন না। এমনকী তাহার ঘনিষ্ঠতম ম্যাক্স ব্রডও নাকি জীবনী লিখিতে গিয়া সঠিক চরিত্রায়ন করিতে পারেন নাই। ঘোড়া চড়িতে, নৌকা বাইতে, সাঁতরাইতে ভালোবাসিতেন কাফকা। প্রাহা শহরের নানা ঘটনায় পুলকিত হইয়া তিনি অনাবিল হাসিতে ভাঙ্গিয়া পড়িতেন। কাফকা পাবে যাইতেন, কাফেতে যাইতেন, জম্পেশ আড্ডায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাইয়া দিতেন। একাধিকবার প্রেমে পড়িয়াছেনও বটে। লিখিয়াছেন আবেগমথিত দীর্ঘ চিঠি। এই সব বাস্তব ছাপাইয়া কাফকার বিষণ্ণ প্রতিচ্ছবিই প্রকাশিত হইয়াছে।
ইহার জন্য কাফকাও দায়ী। স্বভাবী আচরণ যাহাই হোক, কলম হাতে নিলেই সরল বাস্তবকে দুমড়াইয়া অদ্ভুত বক্রতা সৃষ্টির ঝোঁক তাহাকে পরাক্রান্ত করিত। বাবাকে লেখা পত্র পাঠে মনে হইবে জীর্ণ-শীর্ণ এক ভীত-সন্ত্রস্থ কিশোর পরাক্রমী পরিবেশের বিরুদ্ধে অবিরাম সংগ্রাম করিয়া চলিয়াছে। নিজেকে কোনোক্রমে টিকাইয়া রাখাই তাহার একমাত্র লক্ষ্য। অন্যদিকে কিন্তু কাফকা পারিপার্শ্বিক ঘটনাপ্রবাহের প্রভাব হইতে মুক্ত ছিলেন না। স্মরণ করা যাইতে পারে যে কাফকার এই চিঠিটির মাত্র এক বৎসর আগে ওয়াল্টার হ্যানসেন ক্লেভারের নাটক দ্য সান প্রকাশিত হইয়াছে। সেই সময়ে এই নাটকটি 'পিতাদের বিরূদ্ধে প্রতিবাদ' নামে অভিহিত হইয়াছিল।
বাবাকে লেখা চিঠিতে অভিযোগের স্তুপ উপচাইয়া যে গাঢ় বিষণ্ণ সুর বাজিয়া উঠে তাহা মূলত এক পরাক্রান্ত মানুষের চাপা হাহাকার। অদৃষ্ট এই মেধাবী লেখকের প্রতি সহৃদয় হয় নাই। উচ্চাশার বিপরীতে শারীরিক অশক্তি আর জাগতিক অসাফল্য তাহাকে সদা কাবু করিয়া রাখিত। দ্য ট্রায়াল গল্পের নায়ক যেন অসহায় কাফকারই প্রতিবিম্ব বলিয়া প্রতীয়মান হয়। দীর্ঘ ছয় বৎসর রোগে-যন্ত্রণায় ভুগিবার পর ১৯২৪-এ কাফকার জীবনাবসান হয়। তখন তাহার বয়স সবে একচল্লিশ।
লেখালেখি লইয়া চিরকালই নানা মুনির নানা মত। মানুষের জীবনও তাহার ঊর্ধ্বে নহে। যে মানুষ নিজেই নিজেকে সঠিক চিনিতে পারে না অন্যে তাহাকে কী রূপে চিনিবে? সকল জীবনী ও আত্মজীবনীই আসল জীবনের অপভ্রংশ মাত্র। তবু আমরা তাহা পাঠ করিব এবং নিজের মতো করিয়া রসাস্বাদন করিব।
Comments