ভিনদেশে ঈদ

জ্যাকসন হাইটসের ঈদ

যারা ভিনদেশে থাকেন, কিন্তু মন পড়ে থাকে বাংলাদেশে, তাদের জন্য জ্যাকসন হাইটস। যেন মিনি বাংলাদেশ। বাঙালি তার জন্মভূমির স্বাদ পায় এখানে। খাবার-দাবার, পোশাক, মসজিদ-মন্দির, সংগঠন, নিজ জেলার মানুষ সবকিছু মেলে। বরং বাংলাদেশের চেয়ে আরো বেশি। কারণ এক জায়গাতেই এত কিছুর সমাহার বাংলাদেশেও নেই। বাংলাদেশ থেকে কেউ এলে জ্যাকসন হাইটসে একবারের জন্য হলেও ঢুঁ মারে। আবার আমেরিকার অন্যান্য রাজ্য থেকে এলেও। আর ঈদ-রোজার মাসে তো সবাই জ্যাকসন হাইটসমুখী।

দোকানগুলো নতুন পসরা সাজায়। দল বেঁধে নানা বয়সীরা ঈদের পোশাক কেনে। ইফতারের বিভিন্ন খাবার নিয়ে ফুটপাতেই বসে দোকান। যদিও বাংলাদেশের আমেজ পুরোপুরি পাওয়া যায় না। এখানে আজান শুনে ইফতার খোলা কিংবা সেহরিতে ওঠার বালাই নেই। দীর্ঘ সাড়ে ১৬ ঘণ্টা খাদ্য-পানীয় পরিহার করা রোজাদারদের সঙ্গে শহরের মূল স্রোতের জনগণের কোনো সংযোগ নেই। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের জন্য ঈদের কেনাকাটার সেভাবে ব্যস্ততা নেই। নেই ঈদের সালামি কিংবা বকশিশ দেয়ার আবদার। গৃহকর্মীদের ছুটির আবদার। চকবাজারের মতো বিশাল এলাকাজুড়ে বাহারি আয়োজনে ইফতারির কেনাবেচা হয় না এখানে। যা হয়, ক্ষুদ্র পরিসরে। তবু ভিনদেশে সেটাই তো কত বড় পাওয়া। 

জ্যাকসন হাইটসে সবচেয়ে বেশি ঈদের আমেজ মেলে চান রাতে। ফুটপাতে চেয়ার-টেবিল পেতে সবাই হাতে মেহেদির আলপনা আঁকেন। শুধু বাঙালি নয়, অন্যান্য দেশের মুসলমানরাও আসে তাতে যোগ দিতে। কেনা-বেচায় অংশ নেয় ভারতীয়-পাকিস্তানি ও হিসপ্যানিক-চীনারা। তারা ফুটপাতে তাদের দোকান সাজায়। গ্রোসারি শপের কাউন্টারে লম্বা লাইন পড়ে যায়। সবাই ঈদের দিনে রান্নাবান্নার জিনিসপত্র কেনে।

গত বছর চান রাতে জ্যাকসন হাইটসের এক দোকানে ড্রেস কিনতে গিয়েছিলাম। কেনার পর দোকানের মালিক নিজের ঈদের ড্রেস দেখালেন। দুটি ড্রেস। একটা বেশি গর্জিয়াস। দোকানের মালিকান সহাস্যে বললেন, চান রাতে গর্সিয়াস ড্রেসটা পরব। ঈদের দিনের চেয়ে চান রাতে সবার সঙ্গে বেশি দেখা হয়।

জ্যাকসন হাইটসের ৭৪ স্ট্রিটে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে থাকেন শারমিন খান। উনি প্রতি বছর আলাদা করে নতুন জামা কেনেন চান রাতের জন্য। তার ভাষায়, ‘ঈদের দিন তো পরিবার, আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে সময় কাটাই। আর চান রাত হলো বন্ধুদের জন্য।’

দূর-দূরান্ত থেকে বহু মানুষ আসে জ্যাকসন হাইটসের খোলা আকাশের নিচে চান রাত উপভোগের জন্য। উদ্যোগটা মূলত বাংলাদেশিদের। পরে অন্যান্য দেশ, জাতি, ধর্মের মানুষ অংশ নেয়াতে পুরো আয়োজন হয়ে ওঠে বর্ণাঢ্য, জমজমাট।

সেখানে কিছুক্ষণ থাকলে আপনার মনে হবে, এমন প্রাণের স্পন্দন আর কোথায় মিলবে? প্রতিটি শিরায়-উপশিরায়, স্নায়ুতে স্নায়ুতে অনুভব করার মতো! আসল ঈদের দিনের চেয়ে চান রাতের আনন্দ-উত্তেজনা যেন বেশি। ঈদ আসছে... মনের গহিনে ক্ষণে ক্ষণে কে যেন ডেকে বলছে বার বার।

 জ্যাকসন হাইটসের ৩৭ নম্বর অ্যাভিনিউর ৭২, ৭৩ ও ৭৪ স্ট্রিটে মানুষের উপচে পড়া ভিড় থাকে সেই রাতে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পথে পথে ঘুরেও গাড়ি পার্কিং করতে পারে না অনেকে। মধ্যরাত পর্যন্ত দোকানগুলো ক্রেতা-বিক্রেতার দরকষাকষিতে মুখর। নারীরা মেহেদির আলপনায় রাঙিয়ে  নিচ্ছে দুই হাত। ৫ বা ১০ ডলার করে নেয়া হচ্ছে আলপনা আঁকার জন্য। বাড়তি আয় হচ্ছে অনেকের। ভিড় ঠেলে মেহেদি হাতে সতর্কভাবে চলছে কিশোরী-তরুণীরা। যাতে হাতের মেহেদি যেন মুছে না যায়! 

প্রতি বছর চান রাত আর আগের দিন মেহেদির আলপনা আঁকার জন্য টেবিল নিয়ে বসেন রুহি শরীফ। সেবারও বসেছিলেন। গরমে ঘেমে-নেয়ে একাকার। তবু আনন্দ পান। সৃষ্টিশীল কাজ। অর্থ আয়ের কথা ভাবেন না। বলেন, ‘এমন কী আর আয় হয়! তবে ঈদে সবাইকে সাজাতে খুব ভালো লাগে।’

বাংলাদেশে ঈদে ঢাকা ছেড়ে মফস্বলমুখী হয় মানুষ। আর এখানে আমেরিকার বিভিন্ন শহর থেকে নিউইয়র্কে আসে সবাই ঈদ করতে। নিউইয়র্কে এলে জ্যাকসন হাইটসে কি পা না রেখে যায় কেউ! এভাবে আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে। কুইন্সের আরো দুটি বড় এলাকা জ্যামাইকা ও এস্টোরিয়াতেও বাঙালির বসবাস এখন বাড়ছে। সেখানেও সরগরম থাকে ঈদ উপলক্ষে। জ্যামাইকার মুসলিম সেন্টারে গত বছর রোজার ঈদের জামাতে ২০ হাজারের বেশি নারী-পুরুষ আর শিশু অংশ নেয়। জ্যাকসন হাইটস থেকে ব্রুকলিন, ব্রংকস, স্ট্যাটান আইল্যান্ড, ম্যানহাটান সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল উৎসবের রঙ।

চান রাতে কেনাকাটা, মেহেদির আলপনা আঁকার পাশাপাশি বাড়িতে বাড়িতে চলে রান্নাবান্না। সেই রান্নার এমনই সুবাস যে, প্রতিবেশী মেক্সিকান-কলম্বিয়ানরাও ছুটে আসে অতিথি হতে। ফোনে আত্মীয়-বন্ধুদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ আর তাদের ঈদের শুভেচ্ছা জানানোও চলে রান্নার পাশাপাশি। সব কাজ শেষে বাংলাদেশের আপনজনের সঙ্গে কথা বলা। নিউইয়র্কে যখন গভীর রাত, বাংলাদেশে তখন সবে সকাল হলো। বিশেষ দিনগুলোতে অন্য সময়ের চেয়ে আপনজনদের সঙ্গে কথা বলার সময় দীর্ঘ হয়। কেউ ল্যাপটপে স্কাইপি খুলে বসে। ভালোবাসায় আর উষ্ণতায় যেন ছুঁয়ে দিতে চায় হাজার মাইল দূরের মানুষকে।

রাত জাগার ক্লান্তির বেলা করে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। কারণ সকাল আটটা থেকে এখানে শুরু হয় ঈদের জামাত। নিউইয়র্কের বিভিন্ন মসজিদের সামনে রাস্তার ওপর হাজার হাজার মানুষ শরিক হয়েছে ঈদের জামাতে। জ্যাকসন হাইটসের এক ঈদ জামাতে আমিও নিয়মিত অংশ নেই। অথচ বাংলাদেশে থাকাকালে সেভাবে কখনো ঈদের জামাতে যাওয়া হয়নি। 

এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, নিউইয়র্ক শহরে এখন পাঁচ লাখেরও বেশি বাংলাদেশি থাকে। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে চার লাখ মুসলমান। গত ১০ বছরে এখানে বাংলাদেশিদের বৃদ্ধির হার ১৫ থেকে ১৭ ভাগ। সংখ্যাটা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঈদসহ বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব উদযাপনের মাত্রাও বেড়েছে। ভালো আয়, নিশ্চিন্ত জীবনযাত্রা, উৎসব প্রিয় মানুষকে করেছে আরো উন্মাতাল-মাতোয়ারা।

লেখক : নিউয়র্ক প্রবাসী সাংবাদিক

Comments

The Daily Star  | English

Yunus returns home completing 4-day Japan tour

A flight of Singapore Airlines, carrying the CA landed at Hazrat Shahjalal International Airport at 12:15am on Sunday

12m ago