বর্ষা আলিঙ্গন
আজি ঝরো ঝরো
মুখর বাদল দিনে
জানি নে জানি নে
কিছুতে কেন যে মন লাগে না...
সত্যিই বর্ষায় যখন অঝোরে বৃষ্টি পড়ে তখন মনে হয়, ঝুম ঝুম বৃষ্টি আর তার রিমঝিম শব্দই শুধু মন ভরে শুনতে আর দেখতে থাকি। হাতে এক কাপ গরম কফি কোন কাজে মন বসানো দায়, তাই বলে সময় তো বসে থাকে না। এই অঝোরে বৃষ্টির মধ্যেই আমাদের প্রতিদিনের কাজ সারতে হয়। যদিও ঘর থেকে বেরোতে ইচ্ছে করে না কিন্তু কাজের জন্য ঘরের বাইরে বের হতেই হয়। আর যুদ্ধ করতে হয় পানি-কাদার সঙ্গে। ঘরে বসে বৃষ্টি দেখতে যতই মুগ্ধ লাগে, কাজের জন্য ঘরের বাইরে গিয়ে ততটাই নাজেহাল হতে হয়। দেখা যায় অনেক সময় ছাতা নিয়ে বের হলেও বৃষ্টিতে খানিকটা ভিজে যেতে হয়। আবার গাড়িতে চড়ে গেলেও রাস্তায় জমা পানিতে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছতে হয়। সবকিছু মিলিয়ে বৃষ্টির দিনগুলোতে একটু বাড়তি গুছিয়ে নিতে হয় নিজেকে। যেন সৌন্দর্যের ঘাটতি না হয় আবার অগোছালো না লাগে। অফিসে যারা কাজ করেন সারাদিন, তাদের ব্যস্ত থাকতে হয় কাজের মধ্যেই, বৃষ্টির জন্য অফিসে দেরি করে যাওয়ার উপায় সেই। তাই খেয়াল করে প্রতিদিন সময়মতই ঘর থেকে বের হন। বৃষ্টির দিনগুলোয় আরেকটু আগে বের হওয়ার চেষ্টা করুন। ট্রাফিক জ্যামে সময় নষ্ট হবে না। আবার রিকশা, ট্যাক্সি পেতে সুবিধা হবে।
শুধু সময়মতো অফিসে পৌঁছালেই হবে না। নিজেকে বৃষ্টির দিনের জন্য প্রস্তুত রাখুন। পোশাকের ক্ষেত্রে নজর দিন। রঙের ক্ষেত্রে হালকা রঙগুলোর পোশাক এ সময় না পরাই উত্তম। হালকা তবে উজ্জ্বল রঙ অথবা গাঢ় রঙের পোশাক পরুন, যা ভিজলেও আপনাকে অস্বস্তিতে ফেলবে না। পোশাক পরবেন নিজের পছন্দমতো অবশ্যই। তবে গায়ে লেগে থাকে এমন কাপড় না পরাই ভালো। পরতে পারেন সিল্ক, জর্জেট বা সুতি কাপড়। শাড়ি পরে যেতে চাইলে একটু উঁচু করে পরুন। আঁচল আঁটসাঁট বেঁধে রাখাই ভালো। সুতির শাড়ি আরামদায়ক। তবে জর্জেট শাড়ি, সিল্ক শাড়িতে পানি দ্রুত শুকিয়ে যায়। আপনি সালোয়ার-কামিজ পরেও কাজে যেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে দোপাট্টা খুব ভারী আর লম্বা পরবেন না, স্কার্ফ ব্যবহার করতে পারেন। প্লাজো, ঢিলা সালোয়ার পরুন, যেন হাঁটার সময় উঁচু করে ধরা যায়। চাইলে আপনি প্যান্ট, কুর্তা বা শার্ট, টপস পরতে পারেন। প্যান্ট গুছিয়ে ভাঁজ করে ওপরে থ্রি কোয়ার্টার করে নিতে পারেন। সঙ্গে কালারফুল স্কার্ফ পরলে দারুণ মানাবে। অফিসে যারা কাজ করে তাদের অনেক সময়ই কাজের প্রয়োজনে বাইরে বের হতে হয়। সে ক্ষেত্রে ব্যাগে ছাতা, রেইনকোট রাখুন, যেন প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারেন। বৃষ্টির জন্য একটু বড় ব্যাগ গুছিয়ে নিন। সঙ্গে বাড়তি প্যাকেট রাখুন ভেজা ছাতা, রেইনকোট গুছিয়ে রাখার জন্য। অফিসে কাজ করতে গেলেই যে শুধু নিজের পোশাকের খেয়াল রাখতে হবে তা নয়, স্কুলে বাচ্চাকে আনা-নেয়ার সময় আবার শপিংয়ে গেলেও বর্ষার পোশাকের দিকে খেয়াল করুন। যে পোশাকে আপনি আরাম পান, সে পোশাক পরুন তবে তা যেন আপনাকে বিপদে না ফেলে সেদিকে খেয়াল রাখুন।
বর্ষার দিনে চুলগুলো যেন একটু বেশি নেতিয়ে থাকে, তাই এই সময় চুলের অতিরিক্ত যত্ন নিতে হয়। বেশিরভাগ সময় চুলটাকে বেঁধে রাখার চেষ্টা করুন, কাজের সময় বিরক্ত করবে না। ভেজা চুল থাকলে তা শুকিয়ে বেঁধে নিন। বৃষ্টি ভেজা চুলে বেশি হেয়ার ড্রায়ার ব্যবহার না করাই ভালো। একটু আঠালো লাগে অনেক সময়। স্ক্যাল্প পরিষ্কার রাখুন। চুলের ডগার অংশ ধীরে ধীরে ব্রাশ করুন। বড় দাঁতের চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ান। চুলে জট পাকাবে না। এ সময়টাতে পার্মিং, স্ট্রেটনিং বা হেয়ার কালারের মতো কেমিক্যাল ট্রিটমেন্ট এড়িয়ে চলুন। সহজে ঠিকঠাক করা যায় এমন হেয়ার স্টাইল করুন। চুল ছোট করে কেটে নিতে পারেন। বর্ষার সময় তৈলাক্ত চুল সহজেই নেতিয়ে পড়ে। এই সমস্যার সমাধানে ১৫-৩০ মিনিট লেবুর রস লাগিয়ে রাখুন। তারপর শ্যাম্পু করে নিন। তৈলাক্ত স্ক্যাল্প সমস্যা কম রাখবে। ডিমের সাদা অংশের সঙ্গে অর্ধেক লেবুর রস, নিমপাতার রস ও আদার রস মিশিয়ে চুলের গোড়ায় লাগান। আধাঘণ্টা পর হারবাল শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলুন। চুল ঝলমলে হয়। নেতিয়ে পড়া চুলটাকে সতেজ রাখুন।
বর্ষায় ত্বকের যত্নে আমাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। হতে পারে শীতের মতো অতটা রুক্ষ হয় না ত্বক, তবে ত্বকের ওপর ঝড়-ঝাপটা চলতেই থাকে। কাজের জন্য বা দাওয়াতে ঘর থেকে বের হতে হয়, তখন হালকা সাজ আমরা করে থাকি। নিজেকে গুছিয়ে রাখা গুণ, তবে সেজন্য ত্বকের যত্ন নেয়াও প্রয়োজন। সারাক্ষণ এসির মধ্যে কাজ করার ফলে ত্বকে একটা শুকনো ভাব থাকে। ঘুম থেকে উঠে হালকা কুসুম গরম পানিতে মুখ ধুয়ে নিন। ফেসওয়াশ ব্যবহার করুন। সারাদিন কর্মব্যস্ততার পর ফিরে এসে হাত-মুখ পরিষ্কারভাবে ধুয়ে ক্রিম-লোশন ব্যবহার করুন। ত্বক পরিষ্কার রাখুন। ছুটির দিনগুলোয় সময় নিয়ে ঘরে তৈরি প্যাক লাগাতে পারেন অথবা পার্লারে গিয়ে ত্বক উপযোগী ফেসিয়াল করাতে পারেন। মুখের ত্বকের মতো হাত-পায়ের সমান যত্ন নিতে হয় বর্ষায়। বিশেষ করে পায়ের। হাঁটাহাঁটির ফলে বেচারা পা পানি-কাদার ঝাপটা থেকে রক্ষা পেতে পারে না। আবার বদ্ধ জুতা পরলেও ভেজার হাত থেকে সেখানেও রক্ষা পাওয়ার উপায় নেই। তাই এই সময়টায় সুযোগ পেলে গন্তব্যে পৌঁছে পা ধুঁয়ে ফেলুন টিস্যু দিয়ে মুছে নিন। ভেজা জুতা পরে থাকবেন না। এ থেকে ইনফেকশন হতে পারে। তাই পা শুকনো রাখা প্রয়োজন। দরকার পড়লে অফিসে একজোড়া স্যান্ডেল রেখে দিন বাড়তি।
বৃষ্টির দিন তাই দাওয়াতে যাওয়া যাবে না বা উৎসব বন্ধ থাকবে তা নয়। বর্ষায় সাজুন মনের আনন্দে। হালকা রঙ আমরা প্রতিদিনের কাজে পরতে না পারলেও যে কোনো পার্টিতে আমরা সাদা পরতে পারি। সাদা গোল্ডেন শাড়ি আবার বর্ষার বেলি ফুলের মালা দিয়ে চুল সাজিয়ে হালকা গহনা মার্জিত সাজে আমরা যে কোনো দাওয়াতে নিজের উপস্থিতিতে বাড়তি আনন্দ যোগ করতে পারি। এ সময় সাজসজ্জায় যে মেকআপ ব্যবহার করবেন তা যেন অবশ্যই পানি প্রতিরোধক হয়। না হলে হঠাৎ বৃষ্টিতে সাজ নষ্ট হয়ে যাবে। দিনে হালকা আর রাতে উজ্জ্বল মেকআপ করুন।
বৃষ্টির সময়টাতে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে জুতা-স্যান্ডেলের দিকে। স্যান্ডেল রাবার, স্পঞ্জ বা প্লাস্টিকের হলে ভালো হয়, তাহলে নষ্ট হবে না। সহজে ধুয়ে শুকিয়ে নিতে পারবেন। আর কাদা-পানিতে রাস্তা পিছলা থাকার দরুন ফ্ল্যাট স্যান্ডেল পরুন আর সাবধানে দেখে পা ফেলুন। স্পঞ্জের মধ্যে উঁচু স্যান্ডেল পাওয়া যায় যেগুলো এই বর্ষায় কমফরটেবল।
নিজেকে গুছিয়ে রাখা ছাড়াও নিজের বাড়ির দিকে সমান নজর দিতে হবে। এমনিতেই স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া, ঘরেও বদ্ধ পরিবেশের সৃষ্টি হয়। ঘর অপরিষ্কার থাকলে পোকা-মাকড়ের উপদ্রব আরো বেশি হয়। চারদিকে খাবার ছড়িয়ে রাখবেন না। ডাস্টবিন খুলে রাখবেন না। রান্নাঘরের বেসিনে রাতে হালকা গরম পানি ঢালুন। এতে তেলাপোকা কম হবে। বর্ষায় বিছানা-বালিশে পোকামাকড়ের সমস্যা দেখা যায়। বালিশে তুলা ভরার সময় সামান্য কর্পূর ভরে দিন। পোকামাকড় হবে না। গরমে বালিশ ঠাণ্ডাও থাকবে। বিছানার ম্যাট্রেসের নিচে নিমপাতা রাখুন। পোকা কম হবে। ঘরের আশপাশে ভালোভাবে পরিষ্কার করে রাখুন। দরজা-জানালা খুলে আলো-বাতাস আসা-যাওয়ার ব্যবস্থা রাখুন। বদ্ধ পরিবেশে অসুখ-বিসুখ হতে পারে। ঘরের মেঝে যাতে ভেজা না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। অতি বৃষ্টিতে অনেক সময় বাজার বসে না। তাই ঘরে খাবার মজুদ রাখুন একটু বেশি করে, যেন বের হতে না পারলেও সমস্যা না হয়। শুকনো খাবার রাখুন। তরকারি নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাই আপনি চাইলে হালকা সেদ্ধ করে সংরক্ষণ করতে পারেন। ঘর পরিষ্কার আর তরতাজা খাবার এ সময় আপনাকে সুস্থ রাখবে। বৃষ্টিতে ভেজা যদি প্রতিদিনই কম-বেশি হতে থাকে, তবে ঘরে গরম ভাব নিন। ঠাণ্ডা কাশি দূর হবে। জরুরী প্রয়োজনীয় ওষুধ ঘরে রাখুন। এ সময় ছোট-বড় সবাই সর্দি-কাশি-জ্বরে আক্রান্ত হতে পারে। তাই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী জরুরি ওষুধ ঘরে রাখুন এবং ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে খান। ঘরে যদি গাছ রাখা হয়, তবে তাতে পানি জমে যেন না থাকে, সেদিকে খেয়াল করবেন। ঘরের আশপাশেও যেন কোথায় পানি জমে না থাকে, তা দেখা জরুরি। এ থেকে মশার উপদ্রব হয় এবং তা বিভিন্ন ধরনের অসুখের বিস্তার করে। সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখুন।
বৃষ্টিতে শুধু যে নানা সমস্যাই থাকে তা নয়, সঙ্গে ঘরে খাবারের নানা আয়োজনও দেখা যায়। খিচুড়ি, ডিম ভুনা, ইলিশ ভাজা, গরুর মাংস, বেগুন ভাজা আর নানা রকমের ভর্তার আয়োজন এই বৃষ্টিতে হয়ে থাকে। মজার এই লোভনীয় খাবার বৃষ্টিতে খেতে দারুন লাগে। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা আবহাওয়া থাকার দরুন এ সময়টাতে স্যুপ খাওয়া যেতে পারে। আর বিকেলে চায়ের সঙ্গে নানা মুড়মুড়ে-কুরকুরে হালকা নাস্তা দারুণ লাগে। বৃষ্টি দেখতে দেখতে সবজি বড়া, পেঁয়াজু, চানাচুর মাখানো, মুড়ি মাখানো খেতে দারুণ লাগে। বৃষ্টির দিনে ঘরে বসে থাকতে অনেক সময় ভালো লাগে না, তখন ব্যবস্থা রাখতে পারেন কিছু ঘড়োয়া খেলার। ছোটরা এতে মজা পাবে। সঙ্গে বন্ধুদের খিচুড়ি-মাংস খাওয়ার দাওয়াত দিতে পারেন। একসঙ্গে বৃষ্টি উদযাপন করতে খারাপ লাগবে না। বিকেলে টি-পার্টিও রাখা যেতে পারে।
বর্ষায় ফোটে কদম, বেলি, কামিনী, কৃষ্ণচূড়া আরো অনেক ফুল। চাঁপা, দোলনচাঁপার সুবাস ছড়িয়ে থাকে। বিয়ে-উৎসবে বেলির মালা গুঁজে সাজ পরিপূর্ণ করে না এমন নারীর সংখ্যা কম। নতুন কনেও তার সাজে বাড়তি আবদার রাখে বেলির মালার জন্য। সাদা শাপলায় ভরে থাকে বিল-হাওর, পদ্ম ফোটে তার আকর্ষণীয় রূপ নিয়ে। ফুলে এই জৌলুসে ঢেকে যায় বর্ষার সব কষ্টের দাগ। পানি-কাদা আর অনবরত বৃষ্টির জন্য জীবনযাপন অসহনীয় হয়ে উঠলেও এর মধ্যেই নিজেকে সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখুন। ঘরবাড়ি পরিষ্কার রাখুন। ঘরের কোণাগুলো তো অবশ্যই, আর বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে কোথাও যেন পানি জমে না থাকে। পরিবারকে সুস্থ রাখুন। ব্যাগে জরুরিভাবে ছাতা, রেইনকোট, টিস্যু বা ছোট তোয়ালে রাখুন। চটজলদি মেকআপের উপকরণ রাখতে পারেন। গহনা হালকা পরবেন এবং যা ভিজলে সমস্যা হবে না এমন গহনা পরুন। অনেকেই পায়ে নূপুর পরে থাকেন। এ সময়টাতে পায়ে ময়লা বেশি লাগার আশঙ্কা থাকে, তাই পুঁতি বা যে উপকরণে তৈরি নূপুর নষ্ট হবে না তা পরুন। ফুলের সুগন্ধ আর প্রকৃতির অদ্ভুদ মায়ায় বর্ষাকে ভালোবেসে আলিঙ্গন করুন। সুস্থ সুন্দর থাকুন।
Comments