‘রডোডেনড্রন’ মানে শেষের কবিতা

স্কুল জীবনের শেষের দিকে এসে যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’ বইটি পড়েছিলাম, তখনও সেভাবে বুঝতে পারিনি উপন্যাসটির মূলভাব। ভীষণ আচ্ছন্ন হয়ে ছিলাম। আর ভালবেসে ফেলেছিলাম অমিত রায় নামের চরিত্রটিকে। তার কথা বলার ঢং, কাব্য গাঁথুনি, কবিতা পাঠ, তার প্রগলভতা সবকিছুই ছিল সেই ৮০ দশকের একজন বাঙালি মেয়েকে প্রেমে পড়ানোর জন্য যথেষ্ট। আর অমিত-লাবণ্যের প্রেমময় অমর কবিতাখানি আমাকে এতটাই মুগ্ধ করে ফেলেছিল যে, বইটি পড়ার পাশাপাশি কবিতাটি পুরো মুখস্থ করে ফেলেছিলাম।

“পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি,

আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী।

রঙিন নিমেষ ধুলার দুলাল

পরানে ছড়ায় আবীর গুলাল,

ওড়না ওড়ায় বর্ষার মেঘে

দিগঙ্গনার নৃত্য,

হঠাৎ-আলোর ঝলকানি লেগে

ঝলমল করে চিত্ত।

নাই আমাদের কনকচাঁপার কুঞ্জ,

বনবীথিকায় কীর্ণ বকুলপুঞ্জ।

হঠাৎ কখন সন্ধ্যাবেলায়

নামহারা ফুল গন্ধ এলায়,

প্রভাতবেলায় হেলাভরে করে

অরুণকিরণে তুচ্ছ

উদ্ধত যত শাখার শিখরে

রডোডেনড্রন গুচ্ছ।”

রডোডেনড্রন
আরও একটু বড় হওয়ার পর বইটি আবার পড়লাম। দ্বিতীয়বার পড়ার পরই অমিত রায়ের প্রতি ভালবাসাটা ফিকে হয়ে গেল। বরং এই চরিত্রটি বেশ অপছন্দই হলো। কিন্তু এই কবিতাটির প্রতি ভালবাসা দিনে দিনে বেড়েই গেছে। দেখতে ইচ্ছে হতো রডোডেনড্রন ফুলটিকে? জানতে ইচ্ছে করতো কেন কবি এই ফুলটির কথা বললেন? কেমন করেইবা পাহাড়ের গায়ে ফুটে থাকে বাহারি রডোডেনড্রন? শিলং জায়গাটিইবা কেমন?

কৈশোরে পড়া কবিতার সেই ‘উদ্ধত রডোডেনড্রন’ ফুলের প্রথম দেখা পেলাম ভুটানে গিয়ে, আমার ৫০ বছর বয়সে এসে। সত্যি, এই ফুলের বড় গাছগুলো যখন অনেক উঁচু পাহাড়ের গায়ে শাখা প্রশাখা মেলে দাঁড়িয়ে থাকে, আর তাতে অসংখ্য লাল টকটকে ফুল ফুটে থাকে, তখনই বুঝতে পারলাম কবি কেন এই ফুলটি সম্পর্কে বলেছিলেন ‘উদ্ধত যত শাখার শিখরে রডোডেনড্রন গুচ্ছ’। কবি শিলং এর পাহাড়ে এই ফুলের দেখা পেয়েছিলেন। কিন্তু আমরা যখন শিলং-এ গিয়েছিলাম, তখনও খুঁজেছি রডোডেনড্রন কিন্তু পাইনি। কারণ শীতে এই ফুল ফোটে না।

রডোডেনড্রন

রডোডেনড্রন পাহাড়ের ফুল। বসন্তের শেষে এর দেখা মেলে। অনেকগুলো রং হয় এর। সাধারণত উচ্চতা ভেদে এই ফুলের রঙের তারতম্য হয়। আমরা পাহাড়ের গায়ে গায়ে যে রডোডেনড্রন গুচ্ছের দেখা পেয়েছি, তার সবই প্রায় লাল বা গাঢ় কমলা। নীচের দিকে পেয়েছি হালকা বেগুনি, গোলাপি রঙের রডোডেনড্রন। নেপালে নাকি রডোডেনড্রন জাতীয় ফুল কিন্তু আমাদের কাছে, মানে রবিঠাকুর পড়া বাঙালিদের কাছে রডোডেনড্রন মানে শেষের কবিতা।

পৃথিবীর আদিমতম ফুল কি তবে ম্যাগনোলিয়া ?

শেষের কবিতার রেশ কাটতে না কাটতেই এই ভুটানেই দেখতে পেলাম এমন একটি ফুল, যার নাম আমরা বহুবার বহুভাবে শুনেছি কিন্তু চোখে দেখিনি। জীবনানন্দের ভাষায় বলতে হয় বহুকাল ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি কিন্তু এবার ভুটানে বেড়াতে গিয়ে দেখা পেলাম সেই ফুলটির, যাকে অনায়াসে বলা যেতে পারে পৃথিবীর আদিমতম ফুল। কারণ প্রায় হাজার হাজার বছর ধরে এই ফুলটি প্রকৃতির বুকে তার অপরূপ রূপ নিয়ে প্রেমের দেবী হয়ে ফুটে আছে। সেই ফুলটির নাম ম্যাগনোলিয়া।

সাদা, হলুদ, গোলাপি, বেগুনি রঙের ম্যাগনোলিয়ার রূপ যেন ছড়িয়ে আছে সারা পাহাড় জুড়ে। শোনা যায় প্রায় ২০০ ধরণের ম্যাগনোলিয়া আছে বিশ্বে। রঙের সাথে জড়িয়ে আছে ফুলটির অর্থ। সাদা ম্যাগনোলিয়া জীবনের নারী মহিমার, শুদ্ধতা আর মর্যাদার প্রতীক। সেই ভিক্টোরিয়ান যুগ থেকে ভালবাসার বার্তা পৌঁছানোর জন্য ব্যবহার করা হতো সাদা ম্যাগনোলিয়া। পুরুষ তার ভালবাসার মানুষটিকে বলতো – “তুমি একটি সুন্দর ম্যাগনোলিয়ার মতই মূল্যবান ও স্নিগ্ধ।”

ম্যাগনোলিয়া

চীন দেশেও নারীর সৌন্দর্য আর কমনীয়তা বোঝাতে প্রতীক হিসেবে চলে আসে এই সাদা ম্যাগনোলিয়া। আমেরিকার দক্ষিণেও বউয়ের হাতে থাকে সাদা ম্যাগনোলিয়া। হলুদ ম্যাগনোলিয়া মানে সূর্য, গোলাপি ম্যাগনোলিয়া নারীর ভালবাসা, হালকা বেগুনি ম্যাগনোলিয়া মানে আনুগত্য। আর তাই রোমানরা একে রাখতো রাজদরবারে।

ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি এসে একজন ফরাসী উদ্ভিদবিদ, নাম পিয়েরে ম্যানগোল এই ফুলটি সম্পর্কে বেশ কিছু অজানা তথ্য দিয়েছিলেন বলে, তার নামানুসারে ফুলটির নাম হয় ম্যাগনোলিয়া। তারা এই ফুলের পাপড়ি থেকে ওষুধ তৈরি করতো। উত্তর কোরিয়ার জাতীয় ফুল এই ম্যাগনোলিয়া।

আমরাও অবশ্য এদেশে ম্যাগনোলিয়া ফুল দেখেছি কিন্তু বাগানে নয়, দেখেছি সাবানের বাক্সের উপর ম্যাগনোলিয়া ফুলের ছবি। এবারই প্রথম চোখে দেখা। তবে অবাক হলাম এটা দেখে যে আমাদের পাহাড়ি এলাকায় বেড়াতে গিয়ে একজন কিছু ফুলের ছবি তুলে এনেছিল, যা দেখতে একেবারে হালকা বেগুনি ম্যাগনোলিয়ার মত। তাহলে কি আমাদের এখানে পাওয়া এই ফুলগুলোও ম্যাগনোলিয়া?

ভুটানের পাহাড়ে পাহাড়ে, বাড়ির সামনে, পথের ধারে বড়, মাঝারি এমনকি ছোট গাছেও ফুটে রয়েছে অজস্র ম্যাগনোলিয়া। কোনটা সাদা, কোনটা গোলাপি, কোনটা হলুদ, কোনটা বেগুনি। হয়তোবা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আরও রঙের ম্যাগনোলিয়া, যা আমরা চিনি না। ধারণা করা হয় শতাব্দীর পর শতাব্দী গড়িয়ে গেলেও টিকে থাকবে ম্যাগনোলিয়া তার অপার সৌন্দর্য নিয়ে।

শেষে বলে নিতে চাই ভুটানকে যদি ফুলের রাজ্য নাম দেয়া যায়, সেটা খুব একটা ভুল হবেনা। শীত বাদ দিয়ে মোটামুটি বছরের আট মাস জুড়েই শুধু ফুলের ছড়াছড়ি। কতরকমের যে ফুল চোখে পড়ল, তা ভাবাই যায়না। পাহাড়গুলো যেন ফুল দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছে প্রকৃতি। এত ফুল, এত সবুজ, এত অকৃত্রিম নীরবতা, এত পাহাড়, নদী, ঝর্ণা সব মিলে এত চোখজুড়ানো রূপ দেখে প্রিয় কবির ভাষায় বলতে চাই --

“আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না;

আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,

পৌঁছে অনেকক্ষণ ব'সে অপেক্ষা করবার অবসর আছে।”

 

ছবিগুলো উইকিপিডিয়া থেকে সংগ্রহ করা

Comments

The Daily Star  | English

Russia warns strike on Iran's Bushehr nuclear plant could cause 'Chernobyl-style catastrophe'

Iran and Israel traded further air attacks on Thursday as Trump kept the world guessing about whether the US would join Israel's bombardment of Iranian nuclear facilities.

18h ago