৭০ বছরেও অস্ট্রেলিয়ান পার্লামেন্টে বাংলাদেশিদের প্রতিনিধিত্ব নেই

অস্ট্রেলিয়ান পার্লামেন্ট
অস্ট্রেলিয়ান পার্লামেন্ট হাউস। ছবি: সংগৃহীত

অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ীভাবে বাংলাদেশিদের বসবাস প্রায় ৭০ বছর। দেশটির মূলধারার রাজনীতিতে বাংলাদেশিরা সবসময়ই সক্রিয়। এরপরেও এই দীর্ঘ সময়েও ফেডারেল কিংবা রাজ্যের পার্লামেন্টে বাংলাদেশিদের প্রতিনিধিত্ব নেই। অথচ অস্ট্রেলিয়ান পার্লামেন্টে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অধিকাংশ দেশেরই প্রতিনিধি আছে।

অস্ট্রেলিয়ানরা প্রবাসী বাংলাদেশিদের সবসময় রাজনীতি সচেতন জাতি হিসেবে বিবেচনা করেন। সে হিসেবে দেশটির প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলেও তাদের যথেষ্ট গুরুত্ব আছে। 

বেশ কয়েকটি অঞ্চলে দল দুটির সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের মতো দায়িত্বশীল পদেও বাংলাদেশি আছেন। 

অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ে উত্থানের ইতিহাসটিও রাজনৈতিক। 

১৯৭১ সালে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী মাত্র ৫ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত গঠনের জন্য গড়ে তুলেছিলেন 'বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব অস্ট্রেলিয়া।'

তারা অস্ট্রেলিয়ার শপিং সেন্টার, ফেরিঘাট, ট্রেন স্টেশন এবং বাসস্টপেজে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে ব্যানার, ফেস্টুন টাঙিয়েছিলেন। বিভিন্ন দেশের দূতাবাস এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য দেওয়ার জন্য। সে সময় পুরো অস্ট্রেলিয়ার মানুষ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন। 

এরই প্রেক্ষাপটে পাশ্চাত্য ও অন্যান্য উন্নত দেশগুলোর মধ্যে অস্ট্রেলিয়াই প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।

এছাড়া ১৯৭২ সালে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং বীরাঙ্গনাদের চিকিৎসার জন্য যখন বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশে চিকিৎসকরা যান, তখন অস্ট্রেলিয়া থেকেও একদল চিকিৎসক সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশটিতে গিয়েছিলেন। 

ড. রতন কুন্ডু
ড. রতন কুন্ডু। ছবি: সংগৃহীত

অস্ট্রেলিয়ান পার্লামেন্টে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, চীন, আফগানিস্তান, সিঙ্গাপুরসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিত্ব থাকলেও বাংলাদেশের কোনো প্রতিনিধি না থাকার কারণ জানতে চাইলে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী গবেষক ও লেখক ড. রতন কুণ্ডু বলেন, 'উন্নত বিশ্বের রাজনীতি আর তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতির মধ্যে বিস্তর ব্যবধান। অস্ট্রেলিয়ার মূলধারার রাজনীতির জন্য যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা প্রয়োজন, তা আমাদের অপ্রতুল। আর যাদের এ জ্ঞান আছে, তারা রাজনীতি থেকে দূরে।'

'এখানে যারা মূলধারার রাজনীতি করেন তাদের অধিকাংশই বৃহত্তর পরিসরে কাজ করার চেয়ে ছোট বাংলাদেশি কমিউনিটি নিয়ে কাজ করতেই বেশি পছন্দ করেন। স্বাভাবিকভাবেই মূলধারার বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই,' বলেন তিনি।

আবুল হাসনাত মিল্টন
আবুল হাসনাত মিল্টন। ছবি: সংগৃহীত

কলাম লেখক ও শিক্ষাবিদ আবুল হাসনাত মিল্টন বিষয়টি ব্যাখ্যা করলেন ভিন্নভাবে। তার মতে, অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশিরা বসবাস করছেন প্রায় ৭০ বছর ধরে। তবে গত ৩০ বছর ধরে এ সংখ্যাটা বেড়েছে। প্রথম প্রজন্মের অভিবাসীদের নতুন ভূখণ্ডে থিতু হতে হতেই সময় কেটে যায়।

তিনি বলেন, 'এ পর্যন্ত বাংলাদেশিদের অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতিতে অংশগ্রহণ ও রাজনীতিতে ভূমিকা রাখা একেবারেই নগণ্য নয়। আমি আশাবাদী, আমাদের নতুন প্রজন্ম আগামী এক-দুই দশকের ভেতরে সংসদেও প্রতিনিধিত্ব করবে।'

অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন রাজ্যের সিটি কাউন্সিলে কাউন্সিলর হিসেবে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি থাকলেও পার্লামেন্ট মেম্বার হিসেবে কেউ সফলতা পাননি। 

২০০১ সালে ক্যানবেরার ইডেনমনরো থেকে অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেল নির্বাচনে অংশ নেন প্রথম বাংলাদেশি নাজিয়া আহমেদ। এরপর ২০১৬ সালে তৎকালীন ক্ষমতাসীন লিবারেল পার্টি থেকে নির্বাচন করেন শাহে জামান টিটু। ২০২২ সালে নির্বাচনে অংশ নেন সাজেদা আক্তার সানজিদা এবং এনাম হক। তাদের কেউই জয়লাভ করতে পারেননি। 

মোহাম্মদ আব্দুল মতিন
মোহাম্মদ আব্দুল মতিন। ছবি: সংগৃহীত

এ প্রসঙ্গে অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ আব্দুল মতিন বলেন, 'প্রবাসে যেসব বাংলাদেশি রাজনীতি করছেন, মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য ইংরেজি ভাষায় যতটুকু দক্ষতা, ভৌগলিক, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক জ্ঞান থাকা প্রয়োজন, সেটার ঘটতি আছে বলে আমি মনে করি।'

'যাদের এসব যোগ্যতা আছে, তারা রাজনীতিতে এগিয়ে আসছেন না। আর কেউ এগিয়ে এলেও তাকে সহযোগিতা না করে বরং বিরোধিতা করা হচ্ছে,' বলেন তিনি।

জাহাঙ্গীর হোসেন
জাহাঙ্গীর হোসেন। ছবি: সংগৃহীত

অন্যান্য দেশের দ্বিতীয় প্রজন্ম অস্ট্রেলিয়ার মূলধারার রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। অথচ বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে, আগ্রহও দেখা যায় না। এর কারণ জানতে চাইলে বহুজাতিক বাংলাদেশি টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি টেলিওজের সিইও জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, 'এর কারণ হতে পারে নতুন প্রজন্ম আমাদের দেশের নেতিবাচক রাজনীতি দেখে হতাশ হয়েছে। তাদের খুবই বাজে অভিজ্ঞতা রয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'এখনকার নতুন প্রজন্ম অনেক প্রগতিশীল। তারা নিজেদের ক্যারিয়ার রাজনীতিবিদ হিসেবে দেখতে চায় না। আমার মনে হয়ে এজন্য অন্য জাতির ছেলেমেয়েদের তুলনায় আমাদের ছেলেমেয়েদের রাজনীতিতে একটু বেশি অনীহা।'

১৯০১ সালে অস্ট্রেলিয়ার সংবিধানের অধীনে অস্ট্রেলিয়ান পার্লামেন্ট গঠিত হয়। এটি ফেডারেল পার্লামেন্ট বা কমনওয়েলথ সংসদ নামেও পরিচিত। অস্ট্রেলিয়ান পার্লামেন্ট দুই কক্ষবিশিষ্ট। সিনেট এবং প্রতিনিধি পরিষদ। 

সিনেট

অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেল পার্লামেন্টের দুটি কক্ষের একটি হল সিনেট। এটি ৭৬ জন সিনেটর নিয়ে গঠিত। ৬টি রাজ্যের প্রতিটি থেকে ১২ জন এবং মূল ভূখণ্ডের প্রতিটি অঞ্চল থেকে ২ জন প্রতিনিধি এর সদস্য হন। এটি সংসদের অন্যান্য হাউস, হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভের সঙ্গে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা ভাগ করে নেয়।

প্রতিনিধি পরিষদ

প্রতিনিধি পরিষদ বা হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস হলো সংসদের দুটি কক্ষের মধ্যে একটি এবং কখনো কখনো এটিকে 'পিপলস হাউস' বলা হয়। যে দল নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পায় তারা সরকার গঠন করে। বর্তমানে হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভের সদস্য ১৫১ জন, যারা সরাসরি ভোটারদের দ্বারা নির্বাচিত। 

অস্ট্রেলিয়ায় গভর্নর জেনারেল ইংল্যান্ডের রানীর প্রতিনিধিত্ব করেন।

আকিদুল ইসলাম: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী লেখক, সাংবাদিক

Comments

The Daily Star  | English
consensus commission bicameral parliament proposal

Consensus commission: Talks stall over women’s seats, upper house

The National Consensus Commission proposed establishing an upper house comprising elected representatives from each district and city corporation, and suggested abolishing the current system of reserved seats for women in parliament.

4h ago