১৭ দিনেও হদিস মেলেনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ১৭ ফাইলের

 স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ১৭টি ফাইল হারিয়ে যাওয়ার পর ১৭ দিন পেরিয়ে গেলেও সেগুলোর কোনো হদিস মেলেনি। সেগুলোর ব্যাপারে এখনো অন্ধকারেই রয়ে গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারি তদন্ত কমিটি।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির দাবি, ফাইলগুলো হারানোর সময় সিসিটিভি ক্যামেরা কার্যকর না থাকায় তারা তদন্তে কোনো অগ্রগতি করতে পারেননি। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দাবি করেছে, তারা আইনি জটিলতার কারণে তদন্ত এগিয়ে নিতে পারেনি।

সৃষ্ট পরিস্থিতি সন্দেহ তৈরি করছে যে, মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কেউ এই ফাইল হারিয়ে যাওয়ার ঘটনার সঙ্গে জড়িত হওয়ায় তাকে রক্ষা করতেই তদন্তে অগ্রগতি নেই।

গত ২৮ অক্টোবর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগ থেকে হারানো ফাইলগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ এবং স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের ক্রয় সংক্রান্ত।

গত বৃহস্পতিবার ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটির সদস্য আহসানুল কবির দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঘটনার অনেক আগে থেকেই সিসিটিভি ক্যামেরা অকার্যকর ছিল। আমরা তদন্তে কোনো অগ্রগতি করতে পারিনি। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটতে পারে সেজন্য আমরা কিছু সুপারিশসহ আমাদের প্রতিবেদন তৈরি করেছি।'

তিনি জানান, বৃহস্পতিবার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা ছিল।

তবে, প্রতিবেদনটি জমা দেওয়া হয়েছে কি না তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।

ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের (সিআইডি) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজাদ রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা এখন পর্যন্ত কিছু বের করতে পারিনি। তবে, তদন্ত চলছে।'

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদকারী সিআইডি কর্মকর্তারা বলেছেন যে, তারা মনে করেন ফাইল কেউ চুরি করেছে। কিন্তু মন্ত্রণালয় এখনো কোনো মামলা না করায় তারা পরবর্তী তদন্ত কার্যক্রম এগিয়ে নিতে পারেনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সিআইডি কর্মকর্তা বলেন, 'আপনার বাড়ি থেকে মূল্যবান জিনিসপত্র চুরি হলে আপনি যদি মামলা করতে না চান তাহলে আমরা কী করতে পারি? আমাদের তদন্তের সময় কর্মীদের কেউই মুখ খোলেননি। তদন্তের জন্য তাদের কাউকেই আমরা আটক বা গ্রেপ্তার করতে পারিনি। এটা এখন পুরোপুরি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওপর নির্ভর করছে।'

কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে কি না জানতে চাইলে তিনি জানান, সরকারি প্রটোকলের কারণে এটা এখনও অনিশ্চিত।

'ছায়া তদন্ত' চলাকালীন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অন্তত ৯ জন কর্মী এবং রাজশাহীর একজন ঠিকাদারকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সিআইডি। তবে হারানো ফাইলগুলো বিষয়ে কোনো তথ্য এখনও পায়নি।

মামলা না করা প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) মোহাম্মদ শাহ আলম বলেন, 'আমার মতে মন্ত্রণালয় থেকে মামলা করার দরকার নেই, পুলিশ সাধারণ ডায়েরিকে মামলায় রূপান্তর করতে পারে।'

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ফাইল হারানোর ঘটনায় কী ঘটেছে এবং এত নিরাপদ জায়গায় কেন এমন ঘটনা ঘটল তা জানার অধিকার জনগণের রয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই ঘটনার জন্য প্রাথমিকভাবে দায়ী। এটা দুর্ভাগ্যজনক যে আজ পর্যন্ত এই বিষয়ে কোনো মামলা দায়ের করা হয়নি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এর দায় এড়াতে পারে না। দ্বিতীয়ত, একটি অপরাধ সংঘটিত হওয়ায় পুলিশ নিজেই মামলা করতে পারে, কিন্তু তারাও তা করেননি।'

তিনি বলেন, 'ব্লেম গেম' কোনো সুফল বয়ে আনবে না।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ফাইল হারানোর ঘটনা 'অভ্যন্তরীণ কাজ ছাড়া আর কিছু হতে পারে না'।

তিনি আরও বলেন, 'এত দিন পরেও তদন্তের ফল প্রকাশ না করা এবং কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করা এটাই নিশ্চিত করে যে, ফাইল হারানোর ঘটনাটি ঘটেছে যোগসাজশের মাধ্যমে এবং সম্ভবত ফাইল হারালে লাভবান হবেন এমন কর্মকর্তাদের একটি অংশের এর সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন।'

ইফতেখারুজ্জামান জানান, ফাইলগুলো ক্রয় সম্পর্কিত এবং যারা এগুলো সরিয়েছেন তাদের দুর্নীতি ও নিয়ম লঙ্ঘনের বিষয় জড়িত থাকার সম্ভাবনা থাকায় বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি বলেন, 'ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থতা এমন একটি অশুভ উদ্বেগও উত্থাপন করে যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের একটি অংশ অপরাধীদের বাঁচানোর চেষ্টা করছেন।'

এ বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তিনি বলেন, ফাইল হারানোর ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।

মামলা কেন করা হয়নি জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, 'একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে এবং এটি যেকোনো সময় মামলায় রূপান্তরিত হতে পারে। তবে আমরা তদন্ত প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করছি। দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

১৭টি ফাইল পাওয়া যাচ্ছে না উল্লেখ করে গত ২৮ অক্টোবর রাজধানীর শাহবাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

হারানো ফাইলগুলোর রয়েছে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ, রাজশাহী মেডিকেল কলেজসহ অন্যান্য মেডিকেল কলেজের কেনাকাটাসংক্রান্ত ফাইল, জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিং কর্মসূচি, নিপোর্ট অধিদপ্তরের কেনাকাটা, ট্রেনিং স্কুলের যানবাহন বরাদ্দ ও ক্রয়সংক্রান্ত নথি।

এ ছাড়া নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর এবং চিকিৎসা শিক্ষা অধিদপ্তরের ফাইলও হারিয়েছে।

জিডির তথ্য অনুযায়ী, ফাইলগুলো রাখা ছিল সচিবালয়ের ৩ নম্বর ভবনের ২৯ নম্বর কক্ষে। সেখানে সচিবালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) শাহাদৎ হোসাইনের তত্ত্বাবধানে ক্রয় ও সংগ্রহ শাখা-২ এর কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ওই কক্ষে বসেন সাঁটমুদ্রাক্ষরিক ও কম্পিউটার অপারেটর মো. জোসেফ সরদার ও আয়েশা সিদ্দিকা।

জানা যায়, কম্পিউটার অপারেটর জোসেফ ২৭ অক্টোবর রাতে এই কক্ষের লকারে ফাইলগুলো রেখে গিয়েছিলেন। পরদিন সকালে তালা খুলে দেখতে পান ফাইলগুলো নেই।

ওই দিনই বিকেলে শাহবাগ থানায় সাধারণ ডায়েরি করে মন্ত্রণালয়।

গত ৩০ অক্টোবর স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) মোহাম্মদ শাহ আলমের নেতৃত্বে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটিকে ৫ কার্যদিবসের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়।

৩১ অক্টোবর সিআইডির একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ৬ কর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যায়। পরবর্তীতে রাজশাহীর একজন ঠিকাদারসহ ৪ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে সিআইডি।

অনুবাদ করেছেন আব্দুল্লাহ আল আমীন

Comments

The Daily Star  | English

Nahid warns against media intimidation, vows stern action

The government will take stern action against those trying to incite violence or exert undue pressure on the media or newspapers, said Information Adviser Nahid Islam today

2h ago