বিধিনিষেধ শিথিলে সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের
করোনাভাইরাস মহামারিতে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে ১ জুলাই থেকে দেশে 'কঠোর' লকডাউন আরোপ করেছিল সরকার। কিন্তু ঈদুল আজহা সামনে রেখে ১৫ জুলাই থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়। এতে দেশজুড়ে কোরবানির পশুর হাটগুলোতে জনসমাগম বাড়ে। লাখো মানুষ ছুটতে থাকেন গ্রামের দিকে।
গত ২৩ জুলাই ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার তার ফেরিফায়েড ফেসবুক পেজে ১৫ জুলাই থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত আট দিনে ঢাকা ছেড়ে যাওয়া মোবাইল অপারেটরদের গ্রাহকের একটি হিসাব তুলে ধরেন। এতে দেখা যায়, ওই আট দিনে এক কোটি চার লাখ ৯৪ হাজার ৬৮৩ সিম ব্যবহারকারী ঢাকা ছাড়েন। আর ঈদুল আজহার পরের দিন ২২ জুলাই ঢাকায় ফেরেন আট লাখ ২০ হাজার ৫১৬ জন সিমধারী।
মোবাইল ফোন অপারেটরদের বৈশ্বিক সংগঠন জিএসএমএর হিসাবে, দেশে মোবাইল সংযোগের সংখ্যা ১৭ কোটির বেশি। এর মধ্যে 'ইউনিক ইউজার' ৫৪ শতাংশ। অর্থাৎ, দেশে প্রকৃত মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা নয় কোটির কিছু বেশি।
অর্থাৎ ঢাকা ছেড়ে যাওয়া সিম সংখ্যার ক্ষেত্রে 'ইউনিক ইউজার' এর হারটি বিবেচনায় নিলে বলা যায়, ঈদের ছুটিতে ঢাকা ছাড়ে প্রায় ৫৬ লাখ ৭০ হাজার মানুষ। আর ফিরে এসেছেন প্রায় চার লাখ ৪৩ হাজার। তবে হিসাবের মধ্যে মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন না এমন ব্যক্তি ও শিশুরা আসেনি।
এদিকে গতকাল রোববার দুপুরে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আয়োজিত ভার্চুয়াল বুলেটিনে অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম জানান, ঈদের বন্ধে পরীক্ষা কম হলেও সংক্রমণের হার কমেনি। বরং গত এক সপ্তাহ ধরেই এটা ৩০ শতাংশের ওপরে ছিল।
এ অবস্থায় বিধিনিষেধ শিথিলের সুযোগে বিপুল সংখ্যক মানুষের ঢাকা ত্যাগ ও ফিরে আসার বিষয়টি সংক্রমণ পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলবে কি না— তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম এবং ডা. আব্দুন নূর তুষারের সঙ্গে।
তাদের আশঙ্কা, বিধিনিষেধের শিথিলতার সুযোগে যেভাবে মানুষ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াত করেছে, তাতে সংক্রমণ আরও ছড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। যা আর কয়েক দিনের মধ্যেই বোঝা যাবে।
একই সঙ্গে তারা বলছেন, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে লকডাউন আরোপ করাই একমাত্র সমাধান না। এ জন্য প্রত্যেক উপজেলাসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতেও ব্যাপক হারে পরীক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। টিকাদান কর্মসূচিকে আরও বেগবান করতে হবে। সেই সঙ্গে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা নিশ্চিতের জন্য এখনই হাসপাতালগুলোতে কোভিড শয্যা বাড়ানোর ব্যবস্থা নেওয়া এবং পর্যাপ্ত অক্সিজেন ও জরুরি ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন তারা।
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, 'সংক্রামক রোগের স্বাভাবিক যে গতি-প্রকৃতি তাতে আমরা ধরেই নিচ্ছি যে সংক্রমণটা ছড়িয়ে যাবে বা গেছে। এটা আর কয়েক দিন পর থেকেই বোঝা যাবে।'
এই অধ্যাপক মনে করেন, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে লকডাউনই একমাত্র সমাধান না। তিনি বলেন, 'আসলে লকডাউন মানে হচ্ছে এক জায়গার মানুষ আরেক জায়গায় যাবে না। অর্থাৎ সংক্রমণ ছড়াবে না। এক জায়গাতেই থাকবে। এটাই হচ্ছে লকডাউনের একমাত্র ফলাফল। তাতে করে ওই নির্দিষ্ট এলাকার সংক্রমণ যে কমে যাচ্ছে, তা কিন্তু না। বরং বাড়তেও পারে।'
তাই লকডাউনের সঙ্গে আরেকটি বিষয় যোগ করার পরামর্শ দিয়ে নজরুল ইসলাম বলেন, 'শুরু থেকেই আমরা এটা অবহেলা করে এসেছি। সেটা হচ্ছে মানুষকে মাস্ক পরতে বাধ্য করা। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বাধ্য করা। এটা করতে পারলে এতদিনে সংক্রমণটা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব ছিল। লোকাল সংক্রমণটাও বন্ধ করা যেত।'
সেই সঙ্গে বিএসএমএমইউর সাবেক এই উপাচার্যের অভিমত, 'সত্যিকার অর্থেই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য পরীক্ষার সংখ্যা ব্যাপকহারে বাড়াতে হবে। যে টেস্টটা এখন হচ্ছে সেটা সার্ভিল্যান্স টেস্ট। সার্ভে করার জন্য এটা করা হচ্ছে। কিন্তু এটাকে ইউনিফর্ম ডিস্ট্রিবিউশনের দিকে নিয়ে যেতে হবে। সেভাবে স্যাম্পল কালেকশন করতে হবে। তেঁতুলিয়া থেকে যতগুলো স্যাম্পল নেওয়া হবে, টেকনাফ থেকেও ততটা নিতে হবে। না হলে সঠিক চিত্র পাওয়া যাবে না।'
অধ্যাপক নজরুল আরও বলেন, 'অ্যান্টিজেন ও পিসিআর টেস্টের জন্য প্রত্যেক উপজেলাতে টেস্টিং সেন্টার করতে হবে। আইসোলেশন সেন্টার করতে হবে। এই অবকাঠামো আমাদের আছে। মানুষ যেন সেখান থেকেই টেস্টের ফলাফল পেতে পারে।'
এ ছাড়া করোনাভাইরাস পরীক্ষার প্রতি সবাইকে আগ্রহী করে তোলার জন্য এবং আক্রান্তদের যথাযথভাবে আইসোলেশন নিশ্চিত করার জন্য উপজেলা ও গ্রাম পর্যায়ে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি ও স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে কমিটি গঠনের জন্যও সরকারকে পরামর্শ দেন এই অধ্যাপক। বলেন, 'এমন ব্যবস্থা থাকতে হবে যাতে উপজেলা থেকেই স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীরা গ্রামগুলোতে গিয়ে আক্রান্ত কিংবা উপসর্গ দেখা দেওয়া ব্যক্তির কাছ থেকে নমুনা নিয়ে আসতে পারে। এ জন্য সেখানে গাড়ির ব্যবস্থা থাকতে হবে। যা কঠিন কোনো বিষয় না।'
এদিকে লকডাউন শিথিলে সংক্রমণ আরও ছড়িয়ে পড়ার একই আশঙ্কা ব্যক্ত করে ডা. আব্দুন নূর তুষার বলেন, 'সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য লকডাউন একটা জরুরি ব্যবস্থা মাত্র। পাশাপাশি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর একবারে যাতে খুব বেশি চাপ পড়ে না যায়, তার একটা ব্যবস্থা। কিন্তু এর দীর্ঘমেয়াদী ও কার্যকর ব্যবস্থা হিসেবে আমাদের চলমান লকডাউনটা পরিপূর্ণভাবে পালন করে গণটিকাদানের গতি বাড়িয়ে দিতে হবে। যত তাড়াতাড়ি যত বেশি সংখ্যক মানুষকে আমরা টিকা দিতে পারব, ততই তাদের নিরাপদ রাখা যাবে।'
ডা. তুষার আরও বলেন, 'আর চেষ্টা করতে হবে যেন একটা নির্দিষ্ট ভ্যাকসিনই যত বেশি সম্ভব মানুষকে দেওয়া যায়। ভ্যাকসিন মিক্স হয়ে গেলে তা দীর্ঘমেয়াদে সমস্যা তৈরি করতে পারে।'
এ জন্য দেশেই ভ্যাকসিন উৎপাদনের ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে ডা. তুষার বলেন, 'কোনো না কোনোভাবে বাংলাদেশে ভ্যাকসিন প্রস্তুতের ব্যবস্থা করাটা জরুরি। ভারতে যেমন সেরাম বানাচ্ছে, আমাদের দেশেও আমরা যদি তেমনভাবে ভ্যাকসিন উৎপাদন করতে পারি, আমরা নিজেরাই সেটা কনজিউম করে নিতে পারব।'
একই সঙ্গে সংক্রমণ পরিস্থিতি আরও বেশি নাজুক হয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকে আব্দুন নূর তুষার হাসপাতালগুলোতে যত দ্রুত সম্ভব কোভিডের শয্যা বাড়ানো, অক্সিজেনের সরবরাহ বাড়ানো এবং কোভিড চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় ওষুধের সংস্থান রাখার তাগিদ দেন।
Comments