নিয়ম জালে আটকে আছে বুয়েট উদ্ভাবিত অক্সিজেট
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের নিয়মের জটিলতা ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অসহযোগিতার কারণে অনুমোদন পাচ্ছে না করোনাকালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) উদ্ভাবিত জীবনরক্ষাকারী যন্ত্র অক্সিজেট।
অক্সিজেট সিপ্যাপ যন্ত্রটি কোনো বৈদ্যুতিক সংযোগ ছাড়াই সাধারণ ওয়ার্ডে মিনিটে ৬০-৬৫ লিটার অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারবে। একটি সম্পূর্ণ অক্সিজেট ব্যবস্থা স্থাপন করতে খরচ হবে ২০-২৫ হাজার টাকা। যা হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলার বিকল্প হিসেবে কাজ করবে। অন্যদিকে একটি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলার সর্বনিম্ন খরচ দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা।
দুই ধাপে ট্রায়াল চালিয়ে যথেষ্ট সফলতাও পাওয়া গেছে অক্সিজেটের।
অক্সিজেটের সার্বিক তত্ত্বাবধায়নের দায়িত্বে থাকা বুয়েটের বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. তওফিক হাসান টেলিফোনে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমরা প্রথমে ঔষধ প্রশাসনের অধিদপ্তরের সঙ্গে মৌখিকভাবে অক্সিজেট বিষয়ে যোগাযোগ করি। তাদের নিয়ম অনুযায়ী কোনো মেডিকেল যন্ত্রের অনুমোদনের জন্যে ফ্যাক্টরি ব্যবস্থা আছে এরকম উৎপাদনকারী কোম্পানি দ্বারা তা তৈরি হতে হবে বলে জানানো হয়। তারা জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি কোনো মেডিকেল যন্ত্রের অনুমোদন দেওয়া সম্ভব নয়।’
তিনি বলেন, ‘পরবর্তীতে আমরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা ৪০ জনের মধ্যে ট্রায়াল চালানোর কথা বলে। ৪০ জনের মধ্যে ট্রায়াল চালালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অনুমোদন দিতে পারবে কি না, এমন প্রশ্ন করলে তারা চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্যে আবার ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কথা জানায়। পরে ওষুধ প্রশাসনে সঙ্গে আবারও মৌখিকভাবে যোগাযোগ করা হলে তারা আগের সিদ্ধান্তই জানিয়ে দেয়।’
‘ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরামর্শে দেশে অক্সিজেট উৎপাদনের অনুমতি পেতে পারে, এমন চার থেকে পাঁচটি উৎপাদনকারী কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা বিক্রি ও মুনাফার কথা বিবেচনা করে আমাদের প্রস্তাবে রাজি হয়নি’, তিনি বলেন।
ড. তওফিক হাসান বলেন, ‘মহামারির এই কঠিন সময়ে পরিস্থিতি বিবেচনায় অক্সিজেটের অনুমোদন দেওয়া হলে সারাদেশে খুব কম খরচে অক্সিজেন সরবরাহ করা যাবে। এমনকি আইসিইউ বেডের ওপরও চাপ কমবে।’
‘জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের সঙ্গে অক্সিজেট নিয়ে বিস্তারিত কথা হয়েছে আমার। যেহেতু এটি মিনিটে ৬০ লিটারের বেশি অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারে, তাই এর জন্যে কোনো ট্রায়াল প্রয়োজন হবে না বলে তিনি জানিয়েছেন’, যোগ করেন ড. তওফিক।
তিনি আরও বলেন, ‘আর অক্সিজেট যেহেতু একটি যন্ত্রমাত্র, তাই এর কোনো ক্ষতিকর দিকও নেই। এই বিষয়টি আমরা যারা ইঞ্জিনিয়ার, তারা বুঝলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আর ওষুধ প্রশাসন কেন মানছে না, তা আমি বুঝতে পারছি না।’
অক্সিজেটের বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের করোনা-বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির অন্যতম সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম টেলিফোনে ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এই মুহূর্তে জরুরি ভিত্তিতে অক্সিজেটের অনুমোদন দেওয়া প্রয়োজন। ওষুধ প্রশাসন কেন অনুমোদন দিচ্ছে না, বিষয়টি আমারও জানতে ইচ্ছে করে।’
‘দেশে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলার অনেক সংকট রয়েছে। গত বছরের মার্চ-এপ্রিলে আমরা হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা কিনতে বলেছিলাম। কিন্তু, এখনো তা কেনা হয়নি’, বলেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক আইয়ুব হোসেন টেলিফোনে ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বিষয়টি আসলে তেমনভাবে আমার জানা নেই। তবে, তারা যদি যথাযথভাবে আবেদন করে, তাহলে আমরা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে দেখব।’
উন্নত বিশ্বেও এমন যন্ত্রের ব্যবহার আছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘তারা জরুরি ভিত্তিতে কোনো উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমাদের কাছে আসলে আমরা বিষয়টি দেখব। যন্ত্রটির উৎপাদন ও কার্যকারিতা সঠিক হলে আমরা অবশ্যই অনুমোদন দেবো। আমরা আমাদের গাইডলাইনের বাইরে যেতে পারি না। আমরা তো আইন দ্বারা সীমাবদ্ধ।’
মহামারির এই পরিস্থিতিতে সরকার কেন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে অক্সিজেট উৎপাদনে এগিয়ে আসছে না, জানতে চাইলে আইয়ুব হোসেন বলেন, ‘সরকার এটি করবে কি না, তা আমি জানি না। তখনো আমাদের অনুমোদন লাগবে। তবে, ওপর থেকে কেউ যোগাযোগ করলে সেটি অন্য বিষয়।’
আজ মঙ্গলবার গণমাধ্যমে পাঠানো ওষুধ প্রশাসনের এক বিজ্ঞপ্তিতে অক্সিজেট বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘বুয়েটের বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট কর্তৃক “অক্সিজেট” নামের মেডিকেল ডিভাইসটির পারফরমেন্স ট্রায়াল অনুমোদনের জন্যে অদ্যাবধি ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে কোনো আবেদন দাখিল করা হয়নি।’
প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘গত ১২ জুন বুয়েটের বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের সহকারী অধ্যাপক ড. তওফিক হাসান ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে তাদের উদ্ভাবিত “অক্সিজেট” নামীয় মেডিকেল ডিভাইসটির বিষয়ে মৌখিকভাবে অবহিত করেন। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর তার সঙ্গে ডিভাইসটি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের জন্যে দেশের মেডিকেল ডিভাইস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান জেএমআই, এএনসি, গেট ওয়েল, ইনসেপ্টা মেডিকেল ডিভাইসের শীর্ষ পর্যায়ের টেকনিক্যাল কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের সম্ভাব্য পথ সুগম করে দেওয়া হয় এবং তাকে ক্লিনিক্যাল পারফরমেন্স ট্রায়াল প্রটোকল অনুমোদন গ্রহণের নিমিত্তে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে আবেদন করার জন্যে পরামর্শ দেওয়া হয়। এখন পর্যন্ত তার আবেদন পাওয়া যায়নি।’
বুয়েট উদ্ভাবিত অক্সিজেট যন্ত্রটি ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদন না পাওয়ায় বিষয়টি গতকাল সোমবার সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অনীক আর হক আদালতের নজরে আনলে তা প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনার পরামর্শ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
অনীক আর হক টেলিফোনে ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বুয়েটের তৈরি যন্ত্রটি জীবনরক্ষাকারী যন্ত্রের বি-ক্যাটাগরিতে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ প্রশাসনের ৫০১ (কে) ধারা অনুযায়ী বি ক্যাটাগরির কোনো যন্ত্র দ্বিতীয় ট্রায়ালের পর বিশেষ কোনো পার্থক্য না হলে অনুমোদন দেওয়া যায়। এক্ষেত্রে তৃতীয় ট্রায়াল না হলে সমস্যা হয় না। আর আমাদের দেশে এই ধারাটি অনুসরণ করা হয়। তাই যন্ত্রটি অনুমোদন দিলে সমস্যা নেই।’
অনীক আর হক জানান, হাইকোর্ট তাকে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, স্বাস্থ্য সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তাকে লিখিতভাবে জানাতে বলেছেন।
Comments