দেশে ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ বেড়েছে

বাংলাদেশে ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ বেড়েছে। ছবি: স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

বাংলাদেশে ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘন সংক্রান্ত অভিযোগের সংখ্যা এক বছরের ব্যবধানে ৬১ শতাংশ বেড়েছে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সুরক্ষা অধিদপ্তরে (ডিএনসিআরপি) ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৪ হাজার ৭৬৪টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এর আগের অর্থবছরে অভিযোগের সংখ্যা ছিল নয় হাজার ১৯৫টি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ডিএনসিআরপি'র কাছে বিভিন্ন বিষয়ে সাত হাজার ৫১৫টি অভিযোগ এসেছিল।

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ডিএনসিআরপি ২০১৩-১৪ অর্থ বছর এখন পর্যন্ত মোট ৪৭ হাজার ৭৩৮টি অভিযোগ পেয়েছে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাবলু কুমার সাহা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, কর্তৃপক্ষ কীভাবে ভোক্তাদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে পারে, সে বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ার কারণেই অভিযোগের সংখ্যা বেড়েছে।

তিনি বলেন, 'আরেকটি কারণ হচ্ছে সাম্প্রতিককালে অনলাইনে বেচাকেনার ক্ষেত্রে প্রতারণার ঘটনা বেড়েছে।'

ছবি: রাশেদ সুমন

এ পর্যন্ত মোট ৪৪ হাজার ৬৩০টি অভিযোগের নিষ্পত্তি হয়েছে এবং ছয় হাজার ৯৩৫টি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।

ভোক্তা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বাজারগুলোতে নিয়মিত অভিযানের সংখ্যা ও কলেবর বাড়ালেও ভোক্তাদের ভোগান্তি বেড়েই চলছে। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা অসংখ্য ব্যক্তি ও সংস্থাকে ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে জরিমানা করেছেন। অভিযোগের মধ্যে আছে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে পণ্য ও ওষুধ বিক্রি করা ও বিভিন্ন সেবা দেওয়া।

অন্যান্য অভিযোগের মধ্যে আছে ভেজাল ও নকল পণ্য, ওষুধ ও খাদ্য বিক্রি করা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি খাবার বিক্রি, ওজন সংক্রান্ত কারসাজি ও খুচরা মূল্য গোপন রাখা।

রাজধানী ঢাকার বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন গত সপ্তাহে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে আমরা বিভিন্ন রকম সমস্যার মুখোমুখি হই এবং ভোক্তা হিসেবে আমাদের অধিকারের লঙ্ঘন হয়।'

তিনি বলেন, 'সম্প্রতি আমি একটি আমদানিকৃত পণ্য কিনতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পণ্যের গায়ে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য উল্লেখ করা ছিল না। আমাকে দোকানদারের নির্ধারণ করা মূল্য পরিশোধ করতে হয়েছে।'

১৯ আগস্ট একটি দৈনিক বাজার নিরীক্ষণ অভিযানে ডিএনসিআরপি'র সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) মাগফুর রহমানের সঙ্গে ছিলেন দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিনিধিরা।

অভিযানের সময় দলটি শাহবাগের বেল ভ্যু ফার্মেসিতে মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ পায়।

বিস্তারিত তদন্তের পর ফার্মেসির মালিক জাফর ইকবালকে ২০০৯ সালের ভোক্তা অধিকার রক্ষা আইনের ৫১ নং ধারায় ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। তাকে একই সঙ্গে সতর্কও করা হয়।

জাফর ইকবাল দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, মহামারির কারণে তাকে হাতেগোনা কিছু কর্মী দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, 'লকডাউন শেষ হওয়ার পর আমি দোকান গোছাচ্ছিলাম। কিন্তু শেলফ থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ সরাতে পারিনি। ভবিষ্যতে আর এরকম করবো না এবং এখন থেকে আরও সতর্ক থাকবো।'

সহকারী পরিচালক আব্দুল জব্বার মণ্ডলের নেতৃত্বে একটি মোবাইল কোর্ট রাজধানীর কারওয়ান বাজারের কাঁচাবাজারে অভিযান চালায়। ওই সময় দ্বিতীয় তলার পলাশ এন্টারপ্রাইজ নামক একটি দোকান পরিদর্শন করে।

দোকানটিতে বিদেশ থেকে আমদানি করা অলিভ ওয়েল বিক্রি করা হচ্ছিল। কিন্তু তেলের বোতলে দাম, মেয়াদ উত্তীর্ণের সময়কাল ও আমদানীকারকের নাম লেখা ছিল না।

দোকানের মালিক হারুন রশীদকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। তিনি জানান, প্রতিটি বোতলের দাম এক হাজার দুইশ পঞ্চাশ টাকা। বোতলের গায়ে প্রয়োজনীয় তথ্য না থাকার জন্য তিনি আমদানীকারককে দায়ী করেন।

আব্দুল জব্বার বলেন, 'আইনের কোনো ধরনের লঙ্ঘন খুঁজে পেলে সংশ্লিষ্ট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়। ব্যবসায়ীরা যাতে নিয়ম মেনে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে, সেটি নিশ্চিত করার জন্য আমরা সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা করছি।'

ডিএনসিআরপি'র নিরীক্ষণ অভিযানের সংখ্যা ২০১০-১১ অর্থ বছরের তুলনায় এখন ৭০ শতাংশ বেশি।

২০২০-২১ অর্থ বছরে ১১ হাজার ৯৫৩টি বাজার অভিযান হয়েছে, যার মাধ্যমে ২২ হাজার ৯৯৬ জন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ১৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

মহাপরিচালক বাবলু কুমার সাহা বলেন, 'আমাদের কাজ হচ্ছে ভোক্তা অধিকারকে সমুন্নত রাখা এবং যে কোন মূল্যে ভোক্তার স্বার্থ রক্ষা করা। আমরা একই সঙ্গে ভোক্তা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকদের মধ্যে আপোষের বিষয়টিকেও প্রাধান্য দিয়ে থাকি।'

তিনি একই সঙ্গে ভোক্তাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দেন এবং বড় আকারের মূল্য ছাড়ের ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানান। এছাড়াও তিনি লেনদেন করার আগে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করে নেওয়ার উপদেশ দেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. মিজানুর রহমান বলেন, 'ব্যবসায়ীরা জানেন তাদেরকে কী ধরনের আইন মেনে চলতে হবে। দেশে সুশাসনের অভাব থাকায় ব্যবসায়ীরা আইন মেনে চলার দিকে নজর দেন না এবং ভোক্তাদের অধিকার রক্ষা করার চেষ্টা করেন না।'

তিনি বলেন, 'বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশনের (বিএসটিআই) মতো সংস্থাগুলো যদি তাদের দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করে, তাহলে এত অভিযোগ আসতো না।'

তিনি আরও বলেন, 'আমাদের দেশের সমগ্র পরিচালন ব্যবস্থাতেই সমস্যা আছে। এই ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। অন্যথায়, ভোক্তাদের দুর্দশা আরও বাড়বে।'

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের সভাপতি গোলাম রহমানের মতে, ব্যবসায়ীদের প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডের তুলনায় অভিযোগের সংখ্যা খুবই কম।

তিনি বলেন, 'আমাদের দেশে ভোক্তারা তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নন। যদি কোনো ভোক্তা প্রতারণার শিকার হন, তিনি সেটাকে ভাগ্যের ফের হিসেবে বিবেচনা করেন।'

গোলাম রহমান বলেন, 'তবে ভোক্তারা ১০ বছর আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি সচেতন। এ বিষয়টি খুবই ইতিবাচক। ভোক্তারা যত বেশি সচেতন হবেন, ব্যবসায়ীরা তত বেশি অসাধু কাজ থেকে বিরত হবেন।'

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

16h ago