ডেঙ্গু

‘লোক দেখানো অভিযান-জরিমানায় কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না’

২১ বছরের মধ্যে এ বছর এখন পর্যন্ত তৃতীয় সর্বোচ্চ রোগী শনাক্ত
ডেঙ্গু
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৩১ জন। যা গত ২১ বছরের মধ্যে পঞ্চম সর্বোচ্চ। এর আগে ২০১৯ সালে মারা গিয়েছিল ১৭৯ জন। ২০০০ সালে ৯৩ জন, ২০০১ সালে ৪৪ জন ও ২০০২ সালে ৫৮ জনের মৃত্যু হয় ডেঙ্গুতে।

দেশে ২০১৯ সালে বিগত ২১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক ডেঙ্গু রোগীর মারা গেলেও মৃত্যুহার ছিল শূন্য দশমিক ১৮ শতাংশ। আর এ বছর গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মৃত্যুহার শূন্য দশমিক ৪৩ শতাংশ। যা ২০১৯ সালের তুলনায় শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ বেশি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গত ২১ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

দেশে গত বছর ডেঙ্গুতে সাত জন এবং ২০১৮ সালে ২৬ জন মারা যান।

গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এ বছর দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন সাত হাজার ২৫১ জন, যা ২০০০ সালের পর তৃতীয় সর্বোচ্চ। ২০১৮ সালে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১০ হাজার ১৪৮ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়। ২০১৯ সালে শনাক্ত হয় এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন রোগী, যা ২০০০ সালে দেশে ডেঙ্গু শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ।

দেশে প্রথম ডেঙ্গু ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে ২০০০ সালে। সেবছর থেকেই ডেঙ্গু রোগী ও মৃত্যুর হিসাব গণনা শুরু করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ২০০০ সালে পাঁচ হাজার ৫৫১ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয় এবং মারা যায় ৯৩ জন।

তৌহিদ উদ্দিন আহমেদ, ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী ও অধ্যাপক কবিরুল বাশার। (বাম দিক থেকে)

কীটতত্ত্ববিদ তৌহিদ উদ্দিন আহমেদ টেলিফোনে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের দেশে কার্যকর পদ্ধতিতে মশা নিয়ন্ত্রণ করা হয় না। যে কীটনাশক ব্যবহার করা হয়, সেগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কীটনাশকের কার্যকারিতা নিয়ে নিয়মিত গবেষণা করতে হবে। নতুন নতুন কীটনাশক ও মেশিন নিয়ে আসতে হবে। আমরা এই পরামর্শগুলো দিলেও সিটি করপোরেশন তা শুনছে না।'

তিনি বলেন, 'সিটি করপোরেশন রুটিন ভিত্তিতে কিছু কাজ করে, যা দিয়ে আসলে মশা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। তাদেরকে সারা বছর কাজ করতে হবে। এডিস মশার প্রজনন মৌসুমে তারা কার্যকরভাবে কোনো কাজ না করে এখন লোক দেখানো কিছু কাজ করছে। সঠিক সময়ে সঠিক কাজ না করায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, সঙ্গে মৃত্যুও।'

'ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থাপনার বড় বড় পদে কীটতত্ত্ববিদ প্রয়োজন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে কোনো কীটতত্ত্ববিদ নেই এবং উত্তরে দুই জন থাকলেও যতটুকু জানি তারা অন্য ব্যাকগ্রাউন্ডের। আরও সিনিয়র টেকনিশিয়ান ও দক্ষ জনবল নিয়োগ দিতে হবে। তবেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে', যোগ করেন তিনি।

কীটতত্ত্ববিদ ও বাংলাদেশ প্রাণীবিজ্ঞান সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী টেলিফোনে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সিটি করপোরেশন যদি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করত, তাহলে এই মৃত্যু পরিহার করা যেত। কিন্তু, সিটি করপোরেশন কোনো বিশেষজ্ঞের কথা তেমনভাবে শুনে না। তারা বিভিন্ন সময় আমাদের কাছ থেকে পরামর্শ নেয়। কিন্তু, তা বাস্তবায়ন করে না। ফলে এডিস মশা বেড়েছে এবং ডেঙ্গু রোগী ও মৃত্যু দুটোই বাড়ছে।'

তিনি আরও বলেন, 'আমরা শুধু ৪১টি হাসপাতালের ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা পাই। প্রকৃত সংখ্যাটি আরও অনেক বেশি হবে। কারণ করোনার কারণে অনেকে হাসপাতালে যায় না এবং অন্যান্য হাসপাতালগুলোর তথ্য আমরা পাই না।'

ড. মঞ্জুর আহমেদ বলেন, 'বিভিন্ন বাড়ির বেসমেন্ট, যেসব জায়গায় ভাঙ্গা বেসিন, টায়ার, কমোড রাখা হয়, নির্মাণাধীন ভবন, বিভিন্ন থানায় জব্দ করে রাখা গাড়ি, বিভিন্ন সরকারি অফিসের বিভিন্ন পাত্রে জমে থাকা পানি ও বিভিন্ন নার্সারিতে এডিস মশা বেশি পাওয়া যায়। সিটি করপোরেশন সেসব জায়গায় তেমনভাবে স্প্রে বা ফগিং করে না বলেই এডিস মশার ব্যাপকতা বেড়েছে এবং ডেঙ্গু বেড়েছে।'

'এই মুহূর্তে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে অ্যাডাল্ট মশা মারতে হবে। বেশি করে অ্যাডাল্টি সাইট প্রয়োগ করতে হবে। সিটি করপোরেশনকে আমরা বারবার এই পরামর্শগুলো দিয়েছি। কিন্তু, তারা শুনছে না। তারা লোক দেখানো বিভিন্ন অভিযান আর জরিমানা করা নিয়ে ব্যস্ত। এতে আসলে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না', বলেন তিনি।

কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার টেলিফোনে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সিটি করপোরেশন সারাবছর কাজ করলে এবং এডিস মশার প্রজনন মৌসুমে কার্যকর উদ্যোগ নিলে ডেঙ্গুর প্রকোপ এতটা বাড়ত না। হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরীর পর ঢাকা শহরে আর কেউ কার্যকরভাবে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি।'

'মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত মশক নিধন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সেগুলো হলো—পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা, অন্য জীব দিয়ে এডিস মশাকে নিয়ন্ত্রণ, কীটনাশক হিসেবে লার্ভি সাইট ও অ্যাডাল্টি সাইটের প্রয়োগ এবং জনগণকে এই কাজের সঙ্গে সম্পৃক্তকরণ। এই চারটি পদ্ধতি বছরব্যাপী বাস্তবায়ন করতে হবে। কিন্তু, এমন কোনো পদ্ধতির বাস্তবায়ন আমরা দেখিনি', যোগ করেন এই কীটতত্ত্ববিদ।

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

5h ago