টিকাপ্রাপ্তি ও ব্যবস্থাপনাই মূল চ্যালেঞ্জ

মাসে এক কোটি ডোজ টিকাদানের পরিকল্পনা
স্টার ফাইল ফটো

দেশে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ ঠেকাতে প্রতি মাসে এক কোটি ডোজ টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে সরকার। গত রোববার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কনভেনশন সেন্টারকে বিশেষায়িত করোনা হাসপাতালে রূপান্তর করার কাজ পরিদর্শন শেষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সাংবাদিকদের এ কথা জানান।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২৪ জুলাই থেকে গতকাল ২৬ জুলাই পর্যন্ত তিন দিনে দৈনিক গড়ে তিন লাখের বেশি মানুষ টিকা নেওয়ার জন্য নিবন্ধন করেছেন। এর মধ্যে গতকাল সোমবার দুই লাখের বেশি মানুষকে প্রথম ডোজের টিকা দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন সাড়ে তিন হাজার মানুষ।

ডা. মুশতাক হোসেন, অধ্যাপক লিয়াকত আলী এবং অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত

এর আগে ২৫ জুলাই পর্যন্ত টিকা নিয়েছেন এক কোটি ১৮ লাখ মানুষ। এর মধ্যে দুই ডোজ টিকা পেয়েছেন ৪৩ লাখ। আর গতকাল পর্যন্ত সব মিলিয়ে নিবন্ধন করেছেন এক কোটি ২৬ লাখের বেশি।

অধিদপ্তর সূত্রে জানান যায়, এ পর্যন্ত সরকারের হাতে এসেছে দুই কোটি ১২ লাখ ডোজ টিকা।

তবে মোট টিকা মজুতের হালনাগাদ তথ্যটি আগে অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে পাওয়া গেলেও এখন তা আর দেখা যাচ্ছে না। 

পরিকল্পনা অনুসারে প্রতি মাসে এক কোটি ডোজ টিকা দিতে প্রতিদিন দরকার হবে তিন লাখ ৩৩ হাজার ডোজের বেশি টিকা। এ অবস্থায় সরকারের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় টিকার যোগান কীভাবে আসবে, একসঙ্গে এত টিকা দেওয়ার ব্যবস্থাপনা কিংবা অভিজ্ঞতা সরকারের আছে কিনা— এমন নানা প্রশ্ন উঠেছে।

বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিকিৎসাবিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদের সঙ্গে।

তারা বলছেন, দিনে তিন লাখের বেশি কিংবা মাসে এক কোটি ডোজ টিকা দেওয়ার সক্ষমতা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আছে। কিন্তু চ্যালেঞ্জ হচ্ছে যথাসময়ে টিকা প্রাপ্তি ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার আওতায় তা প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করা।

এ ব্যাপারে আশাবাদী এই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হলো, সম্ভাব্য সবগুলো উৎস থেকে টিকাপ্রাপ্তির কূটনৈতিক ও প্রশাসনিক তৎপরতা চালিয়ে যেতে হবে। সেই সঙ্গে খুব পরিকল্পিতভাবে শুরুতেই কারা এই টিকা পাবে সেই অগ্রাধিকার ঠিক করার পাশাপাশি এর নিবন্ধন প্রক্রিয়াতেও আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। কাজে লাগাতে হবে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) অভিজ্ঞতা। প্রয়োজনে ব্যাপক এই কর্মযজ্ঞের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে বিভিন্ন এনজিও ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকে।

এ ব্যাপারে আইইডিসিআর-এর উপদেষ্টা ডা. মুশতাক আহমেদ বলেন, 'এক কোটি তো মিনিমাম। জুলাইয়ের শুরুতে লকডাউন শুরুর সময়ে আমরা এটা নিয়ে আলাদা সভা করেছি। হিসাব করে দেখেছি মাসে এর দ্বিগুণ টিকাও দেওয়া সম্ভব যদি আমরা বিভিন্ন এনজিও, রেডক্রিসেন্টসহ অন্যান্য সংগঠনকে কাজে লাগাই।'

ডা. মুশতাকের ভাষ্য, দেশে পরিচালিত ইপিআই কর্মসূচির এই সক্ষমতা আছে। তিনি আরও বলেন, 'এক কোটি থেকে দেড় কোটি টিকা তারা (ইপিআই) প্রতি মাসে দিতে পারে। এখন তো টিকা কেবল হাসপাতালে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু একেবারে গ্রাম পর্যায়ে এই পরিমাণ টিকা দেওয়ার মতো ব্যবস্থা ও অভিজ্ঞতা ইপিআইয়ের আছে। তাদের কর্মী আছে। স্বেচ্ছাসেবী আছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে সেই পরিমাণ টিকাই তো আমাদের কাছে নাই। এখন যা আছে তাতে হয়তো উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত দেওয়া যাবে। তাতেও হয়তো টান পড়ে যেতে পারে।'

এ পর্যায়ে মুশতাক আহমেদ বলেন, 'এখন আমাদের মূল চ্যালেঞ্জটা হচ্ছে টিকাপ্রাপ্তি। ইপিআই যেভাবে টিকাদান কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়ন করে তাতে কীভাবে কমিউনিটি এনগেজমেন্ট করতে হয়, কোন কোন মানুষকে এই কাজে যুক্ত করতে হয়, সব তাদের ছক করা আছে। কিছুদিন আগেই তো হামের টিকা দেওয়া হলো।'

এ ছাড়া বিশেষ তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয় এমন টিকা সম্পর্কে ডা. মুশতাক বলেন, 'এগুলোর ক্ষেত্রে ডিভিশনাল লেভেলের বাইরে যাওয়া যাবে না। ডিভিশনাল লেভেল থেকেই প্রতিদিন গাড়িতে করে বিভিন্ন জায়গায় নিতে হবে। বাংলাদেশের যাতায়াত ব্যবস্থা এখন যেহেতু আগের থেকে ভালো। এই টিকাগুলো অতি শীতল তাপমাত্রা থেকে নরমাল ফ্রিজে রাখলে পাঁচ থেকে সাতদিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। সেক্ষেত্রে তাপানুকূল গাড়িতে যথেষ্ট জ্বালানি থাকতে হবে। পারলে দিনেরটা দিনে দিয়ে ফেলতে হবে। তাহলে নষ্ট হবে না।'

এদিকে টিকাদানের বর্তমান গতি নিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলীর পর্যবেক্ষণ হলো, 'এখন যে গতিতে টিকা দেওয়া হচ্ছে তাতে আমাদের বছরের পর বছর লেগে যাবে। কাজেই টিকার যে উদ্দেশ্য, হার্ড ইমিউনিটি অর্থাৎ সংক্রমণ প্রতিরোধ করা, সেখান থেকে আমরা বহু দূরে আছি।'

তবে দ্রুত প্রয়োজনীয় সংখ্যক টিকা পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী এই অধ্যাপক বলেন, 'যদি ভালোভাবে চেষ্টা চলে তাতে এ বছরের মধ্যে ১০ কোটি টিকা আসতে পারে। এটা এখন অসম্ভব কিছু নয়। যেহেতু সোর্সটা মাল্টিপল। এটা নির্ভর করছে বিভিন্ন কূটনৈতিক ও প্রশাসনিক তৎপরতার ওপর।'

এই চিকিৎসাবিজ্ঞানীর ভাষ্য, 'এর মধ্যে পাঁচ কোটি টিকাও যদি আমরা দিতে পারি, তা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের নিচে থাকলেও এর একটা প্রভাব থাকবে। কারণ টিকার উদ্দেশ্য কেবল হার্ড ইমিউনিটি গ্রো করা কিংবা সংক্রমণ বন্ধ করা নয়। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে ভালনারেবল গ্রুপের মৃত্যু ও রোগের তীব্রতা কমিয়ে আনা। এভাবে যখন হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার ওপর চাপ কমে তার একটা সুবিধা পাওয়া যায়। কোনো দেশে দেখা গেছে টিকার হার ৩০, ৪০ কিংবা ৫০ শতাংশ। কিন্তু তার একটা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব কাজ করেছে।'

এ বছরের মধ্যেই দেশের ১২ থেকে ১৩ কোটি মানুষকে টিকা দিয়ে দিতে পারলে আসল উদ্দেশ্য সফল হতো মন্তব্য করে অধ্যাপক লিয়াকত আরও বলেন, 'এখন আমাদের যদি ১০ কোটি টিকাও আসে তাহলে এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব অসাধারণ হবে। সেক্ষেত্রে আগে খুব পরিকল্পিতভাবে অগ্রাধিকার গ্রুপগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে। এতে প্রথমেই থাকবে বয়স্ক মানুষ, কলকারখানার শ্রমিক ও শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষক, কর্মচারী আর অভিভাবকদেরও পারলে টিকা দিয়ে ফেলতে হবে। কারণ তারা সবসময় শিক্ষার্থীদের টাচে থাকবেন। সুতরাং একই সঙ্গে সবাইকে যদি পরিকল্পনায় না নেওয়া হয় তাহলে সেটা ব্যাকফায়ার করবে। তাই এটা একটা প্যাকেজ আকারে ভাবতে হবে।'

অধ্যাপক লিয়াকতের বক্তব্য, 'এভাবে সুনির্দিষ্ট একটা পরিকল্পনার ভিত্তিতে একেকটা অগ্রাধিকার গ্রুপ চিহ্নিত করার মাধ্যমে টিকাদান কর্মসূচিটা এগিয়ে নিতে পারলে যদি তার আওতায় পাঁচ কোটি মানুষও আসে, তার পরোক্ষ প্রভাবটা অনেক বেশি হবে।'

এর বাইরে মাসে এক কোটি ডোজ টিকা দেওয়ার পরিকল্পনার প্রসঙ্গে অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, 'এটা অসম্ভব না। আমাদের প্রায় ৫০০টা উপজেলা। প্রত্যেক উপজেলায় ৩০ থেকে ৪০ জন করে স্বাস্থ্য সহকারী আছেন। আমাদের ১৫ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক আছে। আছে চার হাজার ৫০০ ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্র। এগুলোকে যদি কাজে লাগানো যায়, পাশাপাশি নিবন্ধনটা যদি ঠিকমতো করা যায় তাহলে সম্ভব।'

এই পরিমাণ টিকা দেওয়ার জন্য বিদ্যমান নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় কাজ হবে না মন্তব্য করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক এই পরিচালক বলেন, 'এখন যে পদ্ধতিতে মানুষ রেজিস্ট্রেশন করছে তাতে হবে না। স্বাস্থ্য সহকারীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সবার নাম তালিকাভুক্ত করতে হবে। আলটিমেটলি আমাদের বাচ্চাদেরও টিকা দিতে হবে। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে গবেষণা শুরু হয়ে গেছে। সুতরাং আজ হোক, কাল হোক এই কাজটিও আমাদের করতে হবে। তাই সবার তালিকা বানানোটা জরুরি।'

তালিকা তৈরির জন্য অধ্যাপক বে-নজির আহমেদের পরামর্শ হলো, এই কাজে স্বাস্থ্য সহকারীদের পাশাপাশি এনজিও, স্বেচ্ছাসেবী, ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য, চেয়ারম্যানদের যুক্ত করতে হবে।

সব মিলিয়ে এই অধ্যাপকের বক্তব্য, 'এ সব প্রস্তুতির পাশাপাশি টিকা যাতে আসে তার সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। ইপিআই কর্মসূচিকে যথেষ্ট তহবিল দিতে হবে টিকা পরিবহন, স্বেচ্ছাসেবীদের সম্মানীর জন্য। এগুলো ঠিক না থাকলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যাবে না।'

Comments

The Daily Star  | English

Lower revenue collection narrows fiscal space

Revenue collection in the first four months of the current fiscal year declined by 1 percent year-on-year

10h ago