বারবার কেন আইভীকেই বেছে নেন নারায়ণগঞ্জবাসী
প্রথম দফায় তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন নিজ দল আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা। দ্বিতীয় দফায় ধানের শীষের প্রার্থী। আর তৃতীয় দফায় বিএনপির প্রবীণ নেতা।
এভাবে বার বার প্রতিদ্বন্দ্বী বদলেছে তার। তবে ফলাফল একই থেকে গেছে। রোববার টানা তৃতীয় বারের মতো নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে নির্বাচিত হয়েছেন সেলিনা হায়াৎ আইভী।
আইভীর জয়ের এই ধারাবাহিকতার পেছনের কারণগুলো কী? কেন বার বার তাকেই বেছে নিচ্ছেন দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর ও বাণিজ্যিক মহানগর নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দারা?
এসব প্রশ্নের জবাবে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বাসিন্দা ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, আইভী মেয়র থাকাকালে গত ১০ বছরে নারায়ণগঞ্জে অনেক দৃশ্যমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে তার বিরুদ্ধে তেমন কোনো দুর্নীতি কিংবা অনিয়মের অভিযোগ ওঠেনি।
তিনি বরাবর শহরের দখলদার ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। এমনকি কখনো কখনো দলীয় পরিচয়ের বাইরে গিয়ে 'ন্যায্যতার প্রশ্নে' সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
তাদের ভাষ্য, এসব কারণেই আইভীর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি কখনো। এর বাইরে বিভিন্ন সময়ে নারায়ণগঞ্জে প্রভাবশালী ওসমান পরিবারের বিরুদ্ধে সরব হয়ে, বিশেষ করে আলোচিত তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে অনড় অবস্থানের কারণে তিনি আওয়ামী লীগের বাইরে বাম রাজনৈতিক দল ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকেও পাশে পেয়েছেন।
অর্জন করেছেন মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসা ও আস্থা। তাই বারবার প্রার্থী বদল হলেও ভোটারদের রায় বরাবর আইভীর দিকেই গিয়েছে।
আওয়ামী লীগ নেতা ও নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান আলী আহমেদ চুনকার মেয়ে আইভী চিকিৎসা শাস্ত্রের ডিগ্রি নিয়ে বিদেশে পড়াশোনায় ব্যস্ত ছিলেন। দেশে ফিরে ২ যুগ আগে রাজনীতিতে নামেন তিনি।
রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই তিনি ২০০৩ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান হন।
এরপর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরলে প্রভাবশালী ওসমান পরিবারের সঙ্গে শুরু হয় আইভীর টক্কর। নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগে চুনকার সঙ্গে যে দ্বন্দ্ব ওসমানদের ছিল, তার জের চলতে থাকে আইভী-শামীম ওসমানের মধ্য দিয়ে।
২০১১ সালে পৌরসভা থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন হলে প্রথম ভোটে মেয়র পদে আইভীর প্রতিদ্বন্দ্বী হন শামীম ওসমান।
সেবার দলীয় প্রতীকে ভোট না হলেও আওয়ামী লীগের সমর্থন ছিল শামীমের দিকে। তবে 'বিদ্রোহী' প্রার্থী হিসেবে নারায়ণগঞ্জ সিটির প্রথম ভোটে আইভী লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে হরিয়ে দেন শামীমকে।
এরপর ২০১৬ সালে দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে আইভী প্রায় ৮০ হাজার ভোটে বিএনপি প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেনকে পরাজিত করেন।
সর্বশেষ রোববার নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের তৃতীয় নির্বাচনের ৬৬ হাজারের বেশি ভোটে আইভির কাছে হার মানেন বিএনপি থেকে সদ্য অব্যাহতি পাওয়া প্রবীণ নেতা তৈমুর আলম খন্দকার।
সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় কিংবা স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে ভোটার খরার মধ্যে নারায়নগঞ্জ সিটির রোববারের নির্বাচন ছিল ব্যাতিক্রম। এদিন সকাল থেকেই কেন্দ্রগুলোতে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। ছিল উৎসবের পরিবেশ।
বিকেল ৪টায় ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোটারদের দীর্ঘ সারি দেখা যায়। দিনভর কোনো অনিয়ম, গোলযোগ কিংবা সহিংসতার খবর পাওয়া যায়নি।
তবে ইভিএমে (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) ভোটদানে অনভ্যস্ততার কারণে ভোট গ্রহণের গতি ধীর ছিল বলে জানান প্রার্থী ও নির্বাচনী কর্মকর্তারা।
ইভিএমে ভোট হওয়ায় ফলাফল পেতেও খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি। বিকেল পেরুতেই সমর্থকদের একের পর এক মিছিল এগুতে থাকে আইভীর দেওভোগের বাসভবনের দিকে। সন্ধ্যার পর পর জয়ের আঁচ পেয়ে জয়োল্লাস শুরু করেন তারা।
এ সময় আইভীর বাসভবনের সামনেই কথা হয় তার এক সমর্থক আলী আকবরের সঙ্গে। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'আপার (আইভী) জয় নিয়ে কোনো সংশয় কখনো তৈরি হয়নি। তিনি নারায়ণগঞ্জবাসীর জন্য যা করেছেন, যে সাহস দেখিয়ে গেছেন, যেভাবে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, তাতে জয় তার প্রাপ্য।'
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকাটি পরিচিতি আইভীর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী তৈমুরের এলাকা হিসেবে। সকালে ভোটগ্রহণ শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যে এই এলাকাটির সবচেয়ে বড় কেন্দ্র রেবতী মোহন পাইলট স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে ষাটোর্ধ্ব আয়েশা বেগম নামের এক নারী এই প্রতিবেদককে বলেন, 'ভোট দেওয়ার মতো তো একজনই আছেন। আইভী বেডিরে (মেয়ে) ছাড়া ভোটটা কারে দিমু কন?'
আইভীর জয়ের এই ধারাবাহিকতার বিষয়ে কথা হয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও তানভীর মুহাম্মদ ত্বকির বাবা রফিউর রাব্বির সঙ্গে।
আইভীর টানা জয়ের পেছনে মূলত ২টি কারণ চিহ্নিত করেন রাব্বি। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'তাকে (আইভী) বেছে নেওয়ার মূল কারণ ২টা। সিটি করপোরেশন হওয়ার পর গত ১০ বছরে তিনি শীতলক্ষ্যার ২ পাড়েই দৃশ্যমান উন্নয়নকাজ চালিয়ে গেছেন।'
'আবার মানুষের আর্থ-সামাজিক যে সংকট, সেগুলো তো সিটি করপোরেশন সমাধান করতে পারে না। তবে সিটি করপোরেশনের পক্ষে এ জন্য যতটুকু করা সম্ভব, সে কাজটি আইভী করেছেন।'
রাব্বি আরও বলেন, 'আর দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, আমাদের নারায়ণগঞ্জে দীর্ঘদিন ধরে সন্ত্রাস, হত্যা, চাঁদাবাজি, মাদক-এগুলো ভয়াবহ রকমের বিস্তার রয়েছে। যার বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জের মানুষ অনবরত লড়াই করে যাচ্ছে। এই লড়াইয়ে সেলিনা হায়াৎ আইভী তার নিজ দলের বিরুদ্ধেও সাহসের সঙ্গে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন।'
এ বিষয়ে রফিউর রাব্বির মতো একই মত ব্যক্ত করেন নারায়ণগঞ্জে সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের সদস্যসচিব হালিম আজাদ। তার বক্তব্য, 'আইভীর মতো শামীম ওসমানদের পরিবারেরও একটা ঐতিহ্য ছিল। তার (শামীম ওসমান) বাবা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য, বঙ্গবন্ধুর খুব কাছের লোক। কিন্তু এই পরিবারের পরবর্তী প্রজন্ম সেই ইতিবাচক ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারেনি। তারা প্রাচে র্যের দিকে চলে গেছে, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে পড়েছে।'
এই কবি ও সংগঠকের পর্যবেক্ষণ হলো, আইভীর স্বচ্ছ ভাবমূর্তির পাশাপাশি শামীম ওসমান ও তার ভাইদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এবং ত্বকী হত্যার বিচারের দাবিতে অনড় অবস্থান তাকে আপামর মানুষের কাছে প্রিয় ও আস্থাভাজন করে তুলেছে। প্রতিটি নির্বাচনে যার প্রভাব পড়েছে।
হালিম আজাদ বলেন, 'অনেক ক্ষেত্রে দলীয় পরিচয়ের বাইরে গিয়ে মানুষের পক্ষে থেকে, মানুষের কথা বলে সে (আইভী) নিজের ব্যক্তিত্বকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তার ক্ষমতাকে সে সমাজের মানুষের জন্য কাজে লাগিয়েছে। বাংলাদেশে এরকম নজির তো কম।'
অবশ্য বার বার জয়ের এই 'রহস্যের' বিষয়টি নিজেই খোলাসা করেছেন আইভী। রোববার রাতে জয়ের আভাস নিয়ে তিনি যখন দেওভোগের বাড়িতে সাংবাদিকদের সামনে আসেন, তখন এ রকম এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'জনগণকে আস্থায় আনার জন্যে কখনো মিথ্যা বলিনি, অযথা আশ্বাস দিইনি। সবচেয়ে বড় কথা মানুষকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসেছি, প্রতিবারই রিটার্ন করেছে।'
Comments