রাশিয়ার আগ্রাসনে ধুঁকছে ইউক্রেনের প্রকাশনা শিল্প
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মারাত্মক প্রভাব পড়েছে ইউক্রেনের প্রকাশনা শিল্পে। এই যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ইউক্রেনের প্রকাশকরা। দেশটির প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান চিতোমোর এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। বই বিষয়ক সাময়িকী পাবলিশার্স উইকলি এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
পাবলিশার্স উইকলির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২৬ মার্চ থেকে ৮ এপ্রিল পর্যন্ত ইউক্রেনের বইয়ের বাজার নিয়ে একটি অনলাইন জরিপ করা হয়। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান চিতোমোর উদ্যোগে আনাস্তাসিয়া জাগোরুই জরিপটি পরিচালনা করে। জরিপে মোট ৮১ জন প্রকাশক অংশ নেন।
জরিপের উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধকালীন অবস্থার সঙ্গে ইউক্রেনের প্রকাশকরা কীভাবে মানিয়ে নিচ্ছেন। জরিপে অংশ নেওয়া ১০ শতাংশ প্রকাশক বলেছেন, তারা তাদের প্রকাশনা কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন। তবে, ৫১ শতাংশ প্রকাশক জানান, তারা প্রকাশনা অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু, কিছু কিছু পরিবর্তন আনতে হয়েছে। যেমন কাজের সময় কমিয়েছেন। জরিপে অংশ নেওয়া ৩৯ শতাংশ প্রকাশক জানান কোনো পরিবর্তন আনেননি।
Burning Ukrainian history books is not denazification. It is the opposite. #RussianAggression pic.twitter.com/vB1E78A8s0
— Melinda Simmons (@MelSimmonsFCDO) May 21, 2022
ইউক্রেনের ক্রিয়েটিভ উইমেন পাবলিশিং জানিয়েছে, যুদ্ধ সত্ত্বেও তারা তাদের সব কার্যক্রম পুনরায় চালু করেছে। তাদের কর্মচারীরা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। কেউ কেউ ইউক্রেনে থেকে গেছেন, আবার কেউ বিদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে, প্রত্যেকে যোগাযোগ রেখেছেন।
অনেক প্রকাশক বলেছেন, তারা স্বাভাবিকভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। বাস্তুচ্যুত কর্মীদের দূর থেকে কাজের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তারা ই-বুক প্রকাশ বাড়িয়েছেন।
ন্যাশ ফরম্যাট পাবলিশিং হাউস চিতোমোকে বলেছে, তাদের সম্পাদনা বিভাগের সদস্যরা ইউক্রেনের বিভিন্ন জায়গা এবং বিদেশ থেকে কাজ করছেন। অনুবাদকসহ বেশিরভাগ ফ্রিল্যান্সার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা বইয়ের শিরোনামে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। কারণ বইগুলো যেন যুদ্ধকাল এবং যুদ্ধোত্তর সময়ে মানুষের মাঝে বিশেষ আগ্রহ তৈরি করে।
অনেক প্রকাশক কেবল আগ্রাসনের আগে শুরু হওয়া কাজগুলো অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু, নতুন করে কিছু শুরু করেননি। মেরিডিয়ান সিজারনোভিটস সাংস্কৃতিক উত্সবের ইয়েভেনিয়া লোপাতা বলেন, আমরা লেখকদের আর্থিকভাবে সমর্থন দেওয়ার উপায় খুঁজছি। যেমন জার্মান-ভাষী পাঠকদের কাছে আমাদের লেখকদের প্রকাশিত বইগুলো তুলে ধরছি। তবে, বেশিরভাগই অনলাইন মাধ্যমে। আমরা ইতোমধ্যে ভিয়েনা ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লায়েড আর্টসের সঙ্গে চুক্তি করেছি। এই চুক্তির আওতায় আমাদের লেখকদের সঙ্গে সাধারণ পাঠকের আলোচনা এবং সাহিত্য ইভেন্টগুলোর সিরিজ চালু করা হবে।
রুশ সেনাবাহিনীর ব্যাপক গোলাবর্ষণের শিকার খারকিভভিত্তিক রানোক পাবলিশিংয়ের প্রকাশক চিতোমোকে বলেন, আমাদের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের জন্য বই প্রকাশ করতে পোলিশ প্রিন্টিং হাউসের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছে। বর্তমানে পোল্যান্ডে অবস্থানরত শিশুদের মাছে এগুলো বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে। খুব শিগগির চেক প্রজাতন্ত্রেও একই কাজ করা হবে।
পশ্চিম ইউক্রেনের শহরগুলোতে অবস্থিত কিছু বইয়ের দোকানের কর্মচারীরা বলেছেন, তারা পুনরায় কার্যক্রম শুরু করছেন। স্টোরি লেভ পাবলিশিং হাউস বুকস্টোরস এবং ক্যাফের লাভিভ আউটলেট চালু থাকলেও কিয়েভ, ওডেসাতে তাদের কার্যক্রম বন্ধ আছে। কেএসডি বুকক্লাবের দোকানও খোলা আছে।
জরিপে অংশ নেওয়া প্রকাশকদের মধ্যে ৫৫ শতাংশ আগের জায়গাতেই আছেন, ৩৬ শংশতাং আংশিকভাবে ইউক্রেনের মধ্যে স্থানান্তরিত হয়েছেন, শতাংশ সম্পূর্ণভাবে ইউক্রেনের মধ্যে স্থানান্তরিত হয়েছেন এবং ২ শতাংশ বিদেশে স্থানান্তরিত হয়েছেন।
ইয়াকাবু পাবলিশিং হাউস কিয়েভের গুদাম থেকে পশ্চিম ইউক্রেনে এক মিলিয়ন বই সরিয়ে নিয়েন। কিন্তু এসিসিএ, আইএসটি এবং ইজাহকসহ আরও বেশ কয়েকটি প্রকাশনার লাখ লাখ বই কিয়েভ এবং খারকিভের গুদামে আটকে ছিল।
ক্লিও প্রকাশনা সংস্থার প্রকাশক বলেন, এই অবস্থায় বই বিক্রি করা সম্ভব নয়। কারণ তাদের ভাড়া করা গুদাম বর্তমানে বন্ধ আছে এবং কিয়েভে এখন কোনো কর্মচারী নেই।
এই যুদ্ধের কারণে বইয়ের বিক্রি আশঙ্কাজনভাবে কমেছে। ৯৫ শতাংশ প্রকাশক জানিয়েছেন, যুদ্ধের প্রথম মাস থেকেই উল্লেখযোগ্যভাবে বইয়ের বিক্রি কমেছে। তবুও ১৭ শতাংশ প্রকাশক এখনো কর্মচারীদের পুরো বেতন দিচ্ছেন, ৫৫ শতাংশ কম বেতন দিচ্ছেন এবং ২৮ শতাংশ প্রকাশক কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছেন না।
বিদেশি সহযোগিতা
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কাজ করতে ২৪.৬ শতাংশ প্রকাশক বিদেশি প্রকাশকদের সহযোগিতা নিচ্ছেন এবং ৫১ শতাংশ নেওয়ার পরিকল্পনা পরিকল্পনা করেছেন। কিন্তু, ২৪.৪ শতাংশ প্রকাশক বলেছেন, কীভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করতে হয় তা তারা জানেন না।
এই সহযোগিতার কিছু অংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দ্বারা এসেছে। ন্যাশ ফরম্যাটের প্রকাশক জানান, যুদ্ধের প্রথম দিন থেকে আমরা বিদেশি লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইউক্রেনকে সমর্থন জানাতে তাদের উত্সাহিত করছি। লেখক রায়ান হলিডে ইউক্রেনকে প্রায় ১৫ হাজার ডলার অনুদান দিয়েছেন। ইউক্রেনের প্রকাশক চাস মাজস্ত্রিভ পোল্যান্ডের ক্রাকোতে তার প্রকাশনার একটি শাখা খুলেছেন। অন্যদিকে রডোভিচ পাবলিশিং হাউস কানাডার প্রকাশকদের সঙ্গে কাজ করছে।
জরিপে অংশ নেওয়া ৮৬.৬ শতাংশ প্রকাশনার কর্মচারীরা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছেন এবং ৩০.৫ শতাংশ কর্মচারী যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন।
মেরিডিয়ান সিজারনোভিটসের লোপাতা চিতোমোকে বলেন, যুদ্ধের শুরু থেকে আমরা বুকোভিনা এবং জাকারপট্টিয়ায় অস্থায়ীভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষের বসতি স্থাপনের আমাদের লেখকদের নিয়ে একটি স্থাপনা করেছি। আমরা প্রতিদিন ইউক্রেনের অন্যান্য শহরের বাস্তুচ্যুত মানুষদের এখানের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করছি। আমাদের সদস্যদের পরিবার রোমানিয়া থেকে মানবিক সহায়তা পরিবহনে সহায়তা করছে।
অন্যান্য প্রকাশকরা বাস্তুচ্যুতদের জন্য তহবিল সংগ্রহ করতে এবং লজিস্টিক প্রচেষ্টায় সহায়তা করছে।
পাবলিশার্স উইকলি বলছে, ইউক্রেনের প্রকাশকদের বেশ কয়েকজন কর্মী নিখোঁজ বা নিহত হয়েছেন। বুক্রেক প্রকাশনা সংস্থার কর্মচারীরা বলেন, দুর্ভাগ্যবশত আমাদের অনেক সদস্যের কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। ২ মার্চের পর থেকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।
সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখা
যুদ্ধ শুরুর পর থেকে অনেক প্রকাশনা অনলাইনে বই বিক্রি শুরু করেছে। অনেকে নির্বাচিত বই বিনামূল্যে পড়ার সুযোগ দিয়েছে।
বেশিরভাগ প্রকাশক জানান, সরকারের উচিত বিদেশের কাছে ইউক্রেনীয় সংস্কৃতিকে উপস্থাপনের দিকে মনোনিবেশ করা। তারা সরকারের সাংস্কৃতিক অনুদান ও ট্যাক্স বেনিফিট চান।
কিছু প্রকাশক বলেছেন, তারা ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগের ব্যাপারে আশাবাদী। যেমন ইন্টারন্যাশনাল রেনাইসাস ফাউন্ডেশন এবং ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক ফর রিকনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট। এছাড়া, বিদেশে বই বিতরণ করতে পারে এমন অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন অনেকে।
প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ঝোরঝ'র প্রকাশক বলেন, আমরা প্রকাশনা শিল্প, আমাদের সংস্কৃতি এবং জনগণকে এভাবে হারাতে পারি না। আমাদের একটি ঐক্যবদ্ধভাবে সাংস্কৃতিক জাতি হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রকাশনা শিল্প নিজে থেকে দাঁড়াতে পারবে না। তাই আমাদের সাহায্য ও বিনিয়োগ প্রয়োজন।
ইউক্রেনীয় প্রকাশকদের জন্য বিদেশি সমর্থনের একটি ফর্ম হলো ইউক্রেনীয় উদ্বাস্তু এবং বিদেশে এমিগ্রেসদের কাছে বই বিতরণ। বুক্রেক প্রকাশনা সংস্থার কর্মচারীরা বলেন, বিদেশে অস্থায়ীভাবে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি এবং ইউক্রেনীয়দের জন্য বই ক্রয় প্রকাশনা শিল্পকে টিকিয়ে রাখবে।
ই-বুকে বিনিয়োগ
জরিপটি ই-বুক এবং অন্যান্য আধুনিক উদ্ভাবনে সমর্থন জানাতে একটি ঐকমত্যও খুঁজে পেয়েছে। যেন ইউক্রেনীয়রা যেখানেই থাকুক না কেন তাদের স্থানীয় ভাষার বইগুলো পড়ার সুযোগ পান। নেবো বুকল্যাব পাবলিশিংয়ের প্রকাশক জানান, ই-বুকের মাধ্যমে প্রকাশনার পোর্টফোলিও সমৃদ্ধি হবে এবং এর মাধ্যমে স্থানান্তরিত হওয়া ইউক্রেনীয়রা বই পড়ার সুযোগ পাবেন।
লরাসের প্রিন্ট ম্যানেজার আনাস্তাসিয়া গুলকো বলেন, এখন এটা পরিষ্কার যে, আমাদের কাজ চালিয়ে যেতে হবে। তাই আমরা ই-বুকে মনোনিবেশ করেছি। আমরা দীর্ঘদিন ধরে এ বিষয়ে পরিকল্পনা করছি। আমরা এমন অংশীদার পেয়েছি যাদের মাধ্যমে বিদেশে ই-বুক পৌঁছে দিতে সক্ষম হব, বিশেষ করে পোল্যান্ডে। তা ছাড়া, যুদ্ধের আগে আমরা যেসব কাজ শুরু করেছিলাম তা চালিয়ে যাচ্ছি- অর্থাৎ, আমাদের ইলেক্ট্রনিক আর্কাইভ সিস্টেমাইজেশন এবং কাগজের বই প্রকাশ। তবে, কিছু কাজ আছে যা বিজয়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তাই আমরা অপেক্ষা করছি।
Comments