মরমী মনের মানুষ
কোনো এক মার্চের সকাল। গ্রামে গেছি বেড়াতে। সকালে, বেলা বাড়ার আগেই, হাঁটতে বেরিয়েছি। শহরের পার্কে কেডস পরে হাঁটার চেয়ে গ্রামের মেঠোপথে ঘাসের ওপর দিয়ে খালি পায়ে হাঁটার আনন্দ বহুগুণ বেশি। ক্যালেন্ডারে যদিও ফাল্গুন মাস, তবু শীতের আমেজ কাটেনি তখনও। শিশিরভেজা ঘাসের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে দেখি, মৃদু কুয়াশামাখা সেই ভোরে নিজের ফসলি-মাঠের এক প্রান্তে সুদূরে চোখ মেলে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি।
একা। উদাসীন। অদ্ভুত এক কোমল আলো খেলা করছে তার মুখমণ্ডলে। অনুমতি ছাড়াই পেছন থেকে একটা ছবি তুললাম। তারপর, তার ধ্যান ভাঙার পর গল্প করলাম দীর্ঘক্ষণ।
সারাজীবন অন্যের জমি বর্গা নিয়ে ফসল ফলিয়েছেন তিনি, নিজের জীবনে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি, তবু আক্ষেপ নেই। এটুকুই করার ছিল, এই চাষবাসের কাজটুকু, সে কাজে ফাঁকি দেননি কখনো, এমন করেই ভাবেন তিনি।
কিছুই সঞ্চয় করতে পারেননি, না এ কালের জন্য, না পরকালের জন্য। তবু তার মনে হয়, এই কৃষিকাজটুকুই জগতের উদ্দেশ্যে নিবেদিত তার সেবা। যদিও নিজের জমি নয়, তবু ফসল ফলানোর কাজটি তো করেছেন, সেই ফসলে অনেকের খাদ্য-সংস্থান হয়েছে, শুধু মানুষের তো নয়ই, আরও অনেক পশু-পাখি-কীট-পতঙ্গের।
এই তো, এটুকুই তার করার ছিল, আর কিছু করার যোগ্যতা তো খোদা তাকে দেননি। তবু, বয়স হয়েছে বলে, চলে যাবার কথা মনে হয় মাঝে-মাঝে, আর তখন এসে দাঁড়ান মাঠের পাশে। ভাবেন, তার অজস্র সবুজ-সজীব সন্তান দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে, তিনি না থাকলেও ওরা জন্ম নেবে অন্য কারো যত্নে-মমতায়, অনন্তকাল ধরে...
তার কথা শুনে মন ভরে যায়। জীবনকে কতভাবেই না দেখা যায়, উপলব্ধির কত অযুত-নিযুত পথ খোলা আছে মানুষের সামনে, ভাবি বসে বসে। আমরা, মানে নাগরিক মানুষরা তো এমন করে ভাবি না। জীবনকে আমরা অর্থহীনই ভাবি, বৈষয়িক সাফল্য অর্জন ছাড়াও জীবনের যে অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে, মানুষ হয়ে জন্মানোর যে সুনির্দিষ্ট কারণ থাকতে পারে, সবারই যে কিছু না কিছু করার আছে, এ রকম করে ভাবি না আমরা।
অথচ কত ব্যস্ততা আমাদের, এক মুহূর্তের অবসর নেই, অবিরাম দৌড়ে চলেছি, কিন্তু কিসের জন্য এই দৌড় তাও জানি না।
আমাদের প্রায় সব কাজই নিজের জন্য, বড়জোর নিজের পরিবারের জন্য। আমরা সাফল্য চাই, সম্পদ চাই, অর্থ-বিত্ত-খ্যাতি-প্রতিষ্ঠা চাই এবং সেসব পাওয়ার জন্য জীবন বাজি রাখি, দিনরাত ছুটে বেড়াই, কিন্তু কখনোই তার মতো করে ভাবি না, এই কাজগুলো জগৎ সংসারের জন্য আমার নিবেদন, আমার সেবা। কত পার্থক্য এই দুই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির ভেতরে!
শহরে ফিরে আসি যথারীতি। শহর মানেই ঘড়ি ধরে চলা দৌড়ঝাঁপের জীবন। খুব তাড়া সবার, আমারও, যেন এই মুহূর্তে অমুক কাজটি না করা হলে বিশ্বসংসারের বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যাবে! বুঝতেই চাই না, এসব কিছু না।
একমাত্র নাগরিক মানুষ ছাড়া জগতের আর কিছুই ঘড়ি ধরে চলে না, তাতে কি জগতের কোনোকিছু থেমে থাকে? কিন্তু উপায়ও নেই, আমিও সেই নাগরিক মানুষদেরই একজন, নগরের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য যে একদিন নিসর্গের কোল ছেড়ে চলে এসেছিল।
এখন নাগরিক বাস্তবতা না মেনে উপায় কী? কিন্তু হাঁপিয়ে উঠি অল্পদিনেই। এখনো পুরোপুরি নাগরিক হয়ে উঠতে পারিনি যে! আর যখন কিছুতেই বইতে পারি না এই তাড়ার যন্ত্রণা, এই অহেতুক নাগরিক ব্যস্ততার ভার, তখন ফের ছুটে যাই গ্রামে, দু-চারদিনের বিশ্রামের জন্য।
এবারও দেখা হয় তার সঙ্গে। ততদিনে ফসল-শিশুরা পূর্ণবয়স্ক, ফসলের ভারে নুইয়ে পড়েছে নরম-কোমল ধানগাছগুলো, পাক ধরেছে ধানে, তবে কাটার সময় হয়নি তখনো। আর কয়েকদিন পর সোনালি রঙের ধানে ভরে উঠবে এই মাঠ, সেই রূপ এমনই মনকাড়া যে চোখ ফেরানো দায়। একদিন দেখি বিকেলবেলায় তিনি দাঁড়িয়ে আছেন মাঠের পাশে, চোখে স্নেহ আর মায়া, মুখমণ্ডল জ্যোতির্ময়, এক অপূর্ব আলো খেলা করছে সেখানে, যেন সন্তানের পরিণত হয়ে উঠতে দেখার আনন্দে ভরে আছে তার মন। সেদিনও কথা হলো অনেক। ধানগুলো এবার ঘরে তুলবেন তিনি, জানেন না এবার ঠিকমতো দাম পাবেন কি না, সাধারণত পান না। মালিককে ভাগ দিয়ে তার ভাগে যেটুকু থাকে, তাতে লাভ হয় সামান্যই।
তবু কেন এই কাজটিই করেন? ওই যে, এটুকুই তার করার কথা ছিল। আর কিছু করার যোগ্যতা তাকে দেয়া হয়নি, সে কথা বললেন আবার। তাই আফসোসও নেই, অল্পতেই খুশি। এই ধান থেকেই চাল হবে, মানুষ খাবে। তার আগেই কিছু খেয়েছে পাখি ও কীটপতঙ্গরা, পাকতে পাকতে আরও খাবে। কিছু চুরি করে নিয়ে যাবে ইঁদুরের দল নিজেদের সঞ্চয়ের জন্য। তাদের গোপন ঘরে জমা হয়ে থাকবে ধান। ধান গাছ থেকে হবে খড়, সেগুলো খাবে গরুরা। কতজনের 'রিজিক' যে আছে এখানে, কে জানে!
জানতে চাইলাম, এই যে পাখিরা খায়, ইঁদুরেরা চুরি করে, এত কষ্টের ফসল আপনার, খারাপ লাগে না? হেসে বললেন, খারাপ লাগবে কেন? ওরা আর কতটুকুই বা খায়? আর আমি তো কেবল চাষ করি, ফসল তো দেন খোদা, সেই ফসলে তার সব সৃষ্টির 'হক' আছে!
কথা শুনে আবারও চমকিত হই। কী অদ্ভুত সুন্দর চিন্তা। জগতের সব পশুপাখি-কীটপতঙ্গ আর মানুষ, সবই তার কাছে 'খোদার সৃষ্টি', সবারই অধিকার আছে, 'হক' আছে, কোনো পার্থক্য নেই সেই অধিকারে। ভাবি, এই মরমী মনটা আছে বলেই মানুষটির কোনো তাড়া নেই এবং অল্পতেই সন্তুষ্ট হতে জানেন তিনি। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, খেয়ে বা না খেয়ে বা আধপেটা খেয়ে অবিরাম পরিশ্রম করে ফসল বুনেছেন। কখনো ঘড়ি ধরে কাজে যাননি, ঘড়ি ধরে ঘরেও ফেরেননি। তারপর, ফসল বোনা শেষ হলে তা ছেড়ে দিয়েছেন প্রকৃতির হাতে। নিজে যত্ন করেছেন বটে কিন্তু তারচেয়ে বেশি নির্ভর করেছেন প্রকৃতির ওপর। তিনি জানেন, আপনাআপনিই ফসলেরা বেড়ে উঠবে প্রকৃতির মায়া-মমতায়, যত্ন-ভালোবাসায়। কত নিশ্চিত নির্ভরতা!
প্রকৃতির সঙ্গে কী সুন্দর অলিখিত দিব্যকান্তি সম্পর্ক! ফসল কবে পাকবে সেজন্য তাড়াহুড়া করেননি। এখনো করছেন না। যখন পেকে উঠবে, তখন আবার তার পরিশ্রম বাড়বে। কেটে বাড়ি আনতে হবে, ঝাড়াই-মাড়াই করতে হবে, শুকাতে হবে, সেদ্ধ করতে হবে। আরো কত কি!
দিনরাতের হিসাব থাকবে না তখন। কিন্তু সেই ব্যস্ততার ভেতরেও ঘড়ি দেখবেন না তিনি, কাজ করবেন অনেক। কিন্তু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকবেন না। আমাদের মতো মানে শহুরে মানুষের মতো, ঘড়ি ধরে চলার মানুষই নন তিনি এবং তারা কৃষিজীবীরা, যদিও জগতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি অর্থাৎ খাদ্য উৎপাদনের কাজ করে চলেছেন তারা নিঃশব্দে, নীরবে, ধ্যানমগ্ন হয়ে।
ঘড়ি দেখে চলেন না বলেই তাদের তাড়া নেই। ঘণ্টা-মিনিটের হিসাব দূরে থাক, দিন-সপ্তাহও গুরুত্বপূর্ণ নয় ততটা, বরং তাদের হিসাবে থাকে মৌসুম। একেক মৌসুমে একেক ফসল, একেক প্রস্তুতি। মাঝে মাঝে ভাবি, পৃথিবীতে কতরকম ধর্মঘট হয়, কর্মবিরতি হয়। সারা পৃথিবীর কৃষকরা যদি মাত্র এক মৌসুমের জন্য ধর্মঘট করতেন, যদি ফসল না ফলাতেন, তাহলে সারা পৃথিবীতে দুর্ভিক্ষ লেগে যেত, না খেয়ে মারা যেত অধিকাংশ মানুষ। তখন কোনো একনায়কের রক্তচক্ষু দেখে খাদ্য এসে হাজির হতো না কারো খাবার টেবিলে।
একনায়কদের নির্দেশে মানুষকে মেরে ফেলা যায় হয়তো, ধ্বংস করা যায় নিসর্গকে, প্রকৃতিবিরুদ্ধ নানা মেগা-প্রকল্পও বাস্তবায়িত হতে পারে তাদের ইচ্ছায়, কিন্তু ফসল ফলানো? সেটা একনায়কের নির্দেশে হয় না। ফসল ফলানোর জন্য, খাদ্যের জোগানের জন্য চির অবহেলিত কৃষকই ভরসা। কৃষকের পরিশ্রম, কৃষকের ধ্যানমগ্নতা, কৃষকের যত্নআত্তি আর প্রকৃতির সঙ্গে তাদের নিবিড় মায়াময় সম্পর্ক ছাড়া ফসলের জন্ম হয় না।
গ্রামে গেলে সাধারণত আমি কাজের চাপ এড়িয়ে চলি, এমনকি নেট সংযোগও বন্ধ থাকে অধিকাংশ সময়। ঘুরে বেড়াই যত্রতত্র। সবচেয়ে প্রিয় জায়গা নদীর পাড়। একটা শীর্ণ নদী আছে বাড়ির পাশেই, দিনভর সেখানে মৃদু কোলাহল থাকলেও শেষ বিকেলে এবং সন্ধ্যায় সেখানে নেমে আসে গভীর নির্জনতা। এতটাই গভীর যে তখন নিজের ভেতর ডুব দিতে ইচ্ছে করে। দু-চারজন মানুষ তখনো থাকে নদীর পাড়ে, ধীর-শান্ত-নীরব, তাদের চোখেমুখে তখন অপরূপ এক উদাসীনতা খেলা করে। সেই মুহূর্তে তাদের সঙ্গে যদি কথা বলা যায়, মেলে জীবনের অদ্ভুত সব দর্শন।
তেমনই এক ঘটনা বলি এবার। তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। নদীতে এক জেলে জাল পেতে বসে আছেন। সারাদিনই থাকেন, থাকেন রাতেও। আলো ছিল না তখন। তবু একটা ছবি তুলতে ইচ্ছে হলো। ভর সন্ধ্যায় নদীর ঘাটে কেউ নেই, কেবল তিনি বসে আছেন জাল ফেলে। একা। ছোট্ট একটা ডিঙ্গি নৌকায় তার বসবাস, দিনে তো বটেই, রাতেও। একা। প্রায় দেখা যাচ্ছিল না তাকে, মনে হচ্ছিল মুছে যাবেন এখনই। একটা নাগরিক সহানুভূতি প্রায় জেগে উঠছিল তার জন্য। কিন্তু মনে হলো, একটু আলাপ করা যাক।
ভয় লাগে কি না, জিজ্ঞেস করলে তিনি জানালেন, নদীতে তো ভয় পাওয়ার মতো কিছু থাকে না, ভয় লাগবে কেন? কী খান, রান্না করেন কোথায় জানতে চাইলে বললেন, বাড়ি থেকে দুপুরে খাবার নিয়ে আসেন। ওই খাবারেই তিন বেলা চলে যায়। বাড়িও নদী থেকে অনেকখানি দূরে। প্রতিদিন খাবার নিয়ে আসার মতো অবস্থা থাকে না বাড়ির লোকজনের। যেদিন খাবার আসে না, সেদিন নৌকাতেই মাটির চুলায় দুটো চাল ফুটিয়ে নেন, একটু ডাল রান্না করেন, ওতেই চলে যায়। জানালেন, মাছ ওঠে খুবই কম। তাও ছোট মাছ, তাদের ভাষায় 'গুড়া মাছ'।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলামও অনেকক্ষণ। একেক বার দু-তিনটে বা একটা, এমনকি কখনো কখনো ওঠেও না। 'দিন-রাত নদীতে থাকেন, মাছও তেমন নাই, আপনার পোষায়?' এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, 'মালিক দেয়।' প্রথমে বুঝতে পারিনি, তাই আকাশের দিকে আঙুল তুলে ফের বললেন, 'মালিক দেয়, মালিকই চালায়া নেয়।'
তার কথা শুনে মনে হলো, মানুষটির কোনো অভিযোগ নেই। নদীতেই বসবাস, ছোট্ট একটি নৌকায়, দিনরাত্রি একাকার, জাল ফেলে বসে থাকেন, মাছ ওঠে কি ওঠে না, তবু সেই কৃষক ভাইটির মতো তারও কোনো তাড়া নেই, অভিযোগ নেই, হাহাকার নেই। কারণ, তিনি তার 'মালিকের' প্রতি কৃতজ্ঞ, সামান্য দানেই সন্তুষ্ট।
মনে হলো, বাংলার মানুষের মরমী মন যারা চেনেনি, তারা বাংলার কিছুই চেনেনি।
Comments