সাহিত্যে নোবেল ২০২১: হারুকি মুরাকামীর জন্য প্রার্থনা
সম্প্রতি আমার প্রথম উপন্যাস 'দুর্দানা খানের চিঠি' প্রকাশিত হইয়াছে। ইহার কালভূমি খ্রিস্টাব্দ ২০২৫। ২০২৫ সালের ৯ই অক্টোবর, বৃহস্পতিবার। সুইডিশ একাডেমি সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী কথাসাহিত্যিকের নাম ঘোষণা করিয়াছে। পুরস্কারটি লাভ করিয়াছেন মার্কিনপ্রবাসী বাঙালি ঔপন্যাসিক জনৈক হুমায়ুন আহমেদ। বঙ্গের আকাশে-বাতাসে আনন্দের ফোয়ারা। সারা পৃথিবী হইতে অভিনন্দন বার্তা আসিতেছে। জাপানি কথাসাহিত্যিক হারুকি মুরাকামীও হুমায়ুন আহমেদকে অভিনন্দন জানাইয়া একটি পত্র প্রেরণ করিয়াছেন। তিনি অগ্রে নোবেল পুরস্কার লাভ করিয়াছেন।
ঘটনা হইল, একুশ শতাব্দীর পৃথিবীর জনপ্রিয়তম কথাসাহিত্যিক মুরাকামীকে অদ্যাবধি নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয় নাই। ২০০৬ সালে তাহার প্রসিদ্ধ উপন্যাস 'কাফকা অন দ্য শোর' প্রকাশিত হইল। ২০০৭ হইতে নোবেল পুরস্কার প্রসঙ্গে তাহার নাম উচ্চারিত হইতে লাগিল। শিকা অদ্যাবধি ছিঁড়ে নাই। ১৩-১৪ বৎসর পার হইয়া গিয়াছে। তাহার আরও ছয়খানি গ্রন্থ প্রকাশিত হইয়াছে। গেল বৎসর বাহির হইয়াছে গল্পসংকলন 'ফার্স্ট পারসন সিঙ্গুলার'।
তাহার জন্ম ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে। তবে বয়স ৭২ হইলেও তাহাকে বাহাত্তুরে ধরে নাই। এই দৌড়বিদের স্বাস্থ্য মাশাআল্লাহ ভালো। নোবেল কমিটি হয়তো ভাবিতেছেন, 'এই ভদ্রলোক শত্রুর মুখে ছাই দিয়া নির্ঘাত আরও এক যুগ বাঁচিয়া থাকিবেন, অতএব ত্বরা কিসে। বরং রুশদেশি লুদমিলা উলতস্কায়াকে বা মারিসি কঁদের কথা আগে ভাবা যাইতে পারে।'
১৯০১ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি কবি স্যুলি প্র্যুদমকে দিয়া সাহিত্যের নোবেল পুরস্কারের গোড়াপত্তন হইল। লেভ তলস্তয় ২০১০ পর্যন্ত বাঁচিয়া ছিলেন, কিন্তু তাহার কথা নোবেল কমিটির মনে তেমন একটা সাড়া জাগায় নাই।
১৯০১ খ্রিস্টাব্দে ২৫ জন কবি-সাহিত্যিক নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন লাভ করিয়াছিলেন। তাহাদের অধিকাংশ নোবেল পুরস্কার লাভ করেন নাই, ব্যতিক্রম কেবল সিয়েনকিভিচ ও মিস্ত্রাল (ফ্রেডেরিক)। ডেনমার্কের জর্জ ব্র্যানডিস ১৯০৩ হইতে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ১৩ বার মনোনয়ন লাভ করিলেও শেষাবধি নোবেল লাভ করেন নাই; ১৯২৭-এ তিনি পরলোকগমন করেন। অ্যাঞ্জেল গিমেরা ১৯০৭ হইতে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ১৭ বৎসরে ১৭ বার মনোনীত হইলেও নোবেল পুরস্কার তাহারে কপালে লেখা ছিল না; তাহার মৃত্যু হয় ১৯২৪-এ। টমাস হার্ডি ১২ দফা মনোনয়ন লাভ করিয়াছিলেন; নোবেল পুরস্কার প্রাপকদের তালিকায় তাহারও নাম উঠে নাই।
১৩ দফা মনোনয়নের পর ইতালীয় গ্রাজিয়া দেলেদা অবশেষে ১৯২৬ সালে নোবেলের ঘণ্টাধ্বনি শুনিতে পাইলেন। বলাবাহুল্য তিনি বিরল সৌভাগ্যের অধিকারিণী। জোহানেস জেনসেন ১৮ বছর মনোনয়নের পর ১৯৪৪-এ নোবেল লাভ করিয়াছেন। অন্যদিকে স্পেনীয় সাহিত্যিক রামন পিদাল (১৮৬৯-১৯৬৮) ২৬ দফা মনোনয়ন লাভ করিলেও নোবেল না পাইয়াই পৃথিবী হইতে বিদায় লইয়াছেন। তাহার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আদ্রেঁ মারলো ২০ বার মনোনয়নক্রমে ১৯৭০-এ ঝোলায় নোবেল পুরিতে পারিয়াছিলেন।
শত শত কবি-লেখক আছেন জীবনে মাত্র একবার মনোনয়ন লাভ করিয়াছেন, কিন্তু নোবেল লাভ করেন নাই। আবার রবীন্দ্রনাথের মতো অনেকে কেবল একবার মনোনয়ন লাভ করিয়াছেন এবং প্রথম চালেই কিস্তিমাত করিয়াছেন। নোবেল লাভের সম্ভাবনা থাকিলে দীর্ঘজীবনের অধিকারী হইলে সুবিধা হয়। সল বিলো'র কথা আলাদা, ১৯৬৭ তে মাত্র ৫২ বৎসর বয়সে প্রথম মনোনয়নেই নোবেল লাভ করিয়াছিলেন।
কথাসাহিত্যিক মাসরুর আরেফিন বিশ্বসাহিত্যের একনিষ্ঠ পাঠক। তিনি সাহিত্যে নোবেলের বিষয়ে হতাশ। তিনি বলিলেন, 'নোবেল কমিটি গত এক যুগ ধরিয়া পুরস্কারের ব্যাপারে একের পর এক হতাশাকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছে। যোগ্যতার পরিবর্তে অন্যান্য নিয়ামক ব্যবহার করিয়াছে। ফলে কেবল তিনি নহেন, বিশ্বব্যাপিয়া সাহিত্যামোদীদের অনেকেই এই বিষয়ে আগ্রহ হারাইয়া ফেলিয়াছেন। আগের উত্তেজনা আর নাই।'
এই বছর কে নোবেল পাইলে আপনি খুশি হইবেন? এই প্রশ্নের উত্তর যেন তাহার ঠোঁটাগ্রে ছিল।
মাসরুর বলিলেন, 'লাসলো ক্রাসনাহোরকাই, জন ব্যানভিল এবং কার্ল ওভে কেনাউসগর, এই ৩ জনের ১ জন।'
তাহার উত্তর শুনিয়া মনে পড়িল, আমি এক যুগেরও অধিককাল আগে প্রথম আলো পত্রিকায় জন ব্যানভিলকে লইয়া আলোচনা লিখিয়াছিলাম।
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লইয়া আন্তর্জাতিক বাজীর প্রচলন রহিয়াছে। ইহাদের মধ্যে ব্রিটেনের লাডব্রোকস্ কোম্পানি বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ। সদ্য প্রকাশিত তাহাদের তালিকার শীর্ষে হারুকি মুরাকামীর নাম দেখিয়া আবারও আশান্বিত হইলাম। মুরাকামীর পরে যাহারা জুয়াড়িদের প্রিয় তাহারা হইলেন যথাক্রমে নগুগি ওয়া থিওনগো, আন কারসন, লুদমিলা উলৎস্কায়া, মার্গারেট অ্যটউড, মারিসি কঁদে, লাসলো ক্রাসনাহোরকাই, জয়েস ক্যারল ওটস, ডন দ্য লিলো প্রমুখ। আগামী ৭ অক্টোবর বাংলাদেশ সময় বিকাল পৌনে ৫টায় নোবেল পুরস্কার ঘোষণা হইবে। তাহার আগে এই তালিকার ক্রমে পরিবর্তন আসিতে পারে। জুয়াড়িদের অনুমান কখনও ঠিক হয়, কখনও ঠিক হয় না। মনে পড়ে ২০১৭ তে বেলারুশিয়ান লেখিকা স্বেতলানা আলেক্সিয়েভিচের ব্যাপারে তাহাদের অনুমান সঠিক হইয়াছিল।
গেল বৎসর কবিতার জন্য লুই গ্লিককে নোবেল দেওয়া হইয়াছে। এই বৎসর কোনো পুরুষকে উপন্যাসের (অথবা ছোটগল্পের) দেওয়া হইবে অনুমান করিলে অযৌক্তিক হইবে না।
কার্ল ওভে কেনাউসগর (জন্ম: ১৯৬৮) কি পাইতে পারেন? নরওয়ের এই লেখক কিছুকাল আগে সুইডিশ একাডেমির নর্ডিক পুরস্কার লাভ করিয়াছেন।
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই (জন্ম: ১৯৫৪) হাঙ্গেরিয় লেখক। তাহার উপন্যাস পড়িবার সুযোগ পাই নাই। উত্তরাধুনিক এই লেখককে নোবেল পুরস্কার দিলে অবাক হইবার কিছু নাই। অদ্যাবধি উত্তরাধুনিকতাবাদী কোনো কথাসাহিত্যিককে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয় নাই।
তবে কি-না ২০০৭ হইতে হিসাব করিলে মারিয়ো বার্গাসের ইয়োসা (২০১০) আর চীনের মো ইয়ানের (২০১২) ব্যতিরেকে গত এক যুগেরও বেশিকাল পরিধিতে সাহিত্যের নোবেল ইউরোপ-আমেরিকার বাহিরে যাওয়ার সুযোগ লাভ করে নাই। ভৌগলিক সাম্যতার প্রশ্ন বিবেচনা করা হইলে জাপানের হারুকি মুরাকামী এই দফা ভাগ্যবান বলিয়া আর্বিভূত হইতে পারেন। একই বিচারে নগুগি ওয়া থিওনগোর ভাগ্যও খুলিয়া যাইতে পারে।
মাসরুর আরেফিনের ইপ্সিত তালিকায় হারুকী মুরাকামীর নাম নাই। মনে হয় তিনি আর মুরাকামীর বিষয়ে আশাবাদী নন। আমি আশাবাদী রহিয়াছি। মুরাকামীর জন্য প্রার্থনা করিতেছি। আশা করি নোবেল কমিটি 'সারপ্রাইজের' নামে এই বৎসর আরেকটি শক্ দিবেন না। বব ডিলান, স্বেতলানা আলেক্সিয়েভিচ, পিটার হানৎকা প্রমুখের নোবেল প্রাপ্তি লইয়া সাম্প্রতিক কয়েক বৎসরে বিশ্বব্যাপী সমালোচনার যে ঝড় বহিয়াছে তাহার নিরিখে হারুকি মুরাকামীকে নির্বাচন করিলে নোবেল কমিটির বিবেচনা বোধের ওপর আন্তর্জাতিক সাহিত্য মহলের আস্থা ফিরিয়া আসিবে। নিশ্চিত বলিতে পারি- মুরাকামীর নোবেল লইয়া কেহ প্রশ্ন তুলিবে না।
Comments