জন্মদিনের শ্রদ্ধা 

সাংস্কৃতিক নিবেদিতপ্রাণ সন্‌জীদা খাতুন

ছবি : সন্‌জীদা খাতুন,সংগৃহীত

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পুরোধা ব্যক্তি, বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী, শিক্ষক ও সংগঠক সন্‌জীদা খাতুন। তিনি একজন আলোকোজ্জ্বল ও আলোকবর্তিকা। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তিনি রবীন্দ্রসংগীত শেখা শুরু করেন। ধীরে ধীরে সংগীত শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিতও হয়েছেন। তিনি সংগীতের একজন নিবেদিতপ্রাণ। ছায়ানট এর মতো বৃহৎ সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতাও। 

সন্‌জীদা খাতুন অসামান্য ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথের বাণী প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির চেতনাগত উন্মেষে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকার কথা বলতে গেলে সন্‌জীদা খাতুনের নাম সবার আগে আসবে। তাঁর অসীম সাহস ও দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্বকে কেউ টলাতে পারেনি। বিভিন্ন বাঁধাকে তিনি মেধা দিয়ে পার করেছেন। যে কোন সংকটে তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে কোনোভাবে থামতে দেননি। দেশের একপ্রান্ত থেকে  অন্যপ্রান্তে ছুটেছেন।

আমাদের আত্মবিকাশের প্রেরণা দিয়েছে এবং স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছে বার বার। যার সূচনা হয়েছিল সাংস্কৃতিক সংগ্রাম হিসেবে। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদযাপনের সূত্র ধরে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু এবং স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হওয়ার শক্তি হিসেবে জন্ম হলো 'ছায়ানট'র।

ছায়ানট শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চার একটি ধারক-বাহক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একটি পথিকৃৎ সংগঠন। যে সংগঠন কঠিন সময়ে বাঙালিত্বের কথা বলেছিল, বাঙালি সংস্কৃতির আলাদা ভিত গড়তে চেয়েছিল। সেই ভিত গড়ার ক্ষেত্রে এখন ছায়ানট অনেকাংশে সফল বলা চলে। ছায়ানট এখন বাঙালিত্ব চর্চার এক পীঠস্থান, যে বাঙালিত্বের মধ্য দিয়ে বিশ্বমানবতায় পৌঁছাতে চেয়েছিল ছায়ানট। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ছায়ানটের লক্ষ্য ছিল দেশীয় বৈশিষ্ট্য ও স্বাধীন সত্ত্বা বিকাশে পারঙ্গম হবার জন্য মানুষকে যথার্থ শিক্ষায় সমৃদ্ধ করে তোলা, শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতির সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করে পূর্ণ মানুষ গড়ে তোলার লক্ষ্যে সংস্কৃতি সমন্বিত শিক্ষার বিকাশ ঘটানো। সংস্কৃতি সাধনা ও চর্চার যথাযথ প্রসার ও বিকাশের মাধ্যমে মানুষের প্রতি ভালোবাসা জন্মানোর উদ্দেশ্যে ছায়ানটের সার্বিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে।

সন্‌জীদা খাতুনের ভাষ্যমতে, '১৯৬১ সালে কবি সুফিয়া কামালকে সভাপতি, সায়েরা মহিউদ্দীনকে সহ-সভাপতি এবং ফরিদা হাসানকে সম্পাদক করে ছায়ানটের প্রথম কমিটি তৈরি করা হয়। কমিটির বিভিন্ন পদে ছিলেন-জহুর হোসেন চৌধুরী, সাঈদুল হাসান, মোখলেসুর রহমান, সাইফুদ্দীন আহমদ মানিক, মিজানুর রহমান ছানা, ওয়াহিদুল হক ও আহমেদুর রহমানসহ বেশ কয়েকজন। সরকারি চাকুরে ছিলাম বলে আমি সদস্য হতে পারিনি। অবশ্য প্রতিটি সভায় উপস্থিত থেকে আলোচনায় যোগ দিয়েছি। অনুষ্ঠান পরিকল্পনা আর পরিচালনার দায়িত্বও পালন করে এসেছি।'

বাংলা একাডেমির বারান্দায় ১৯৬৩ সালে সন্‌জীদা খাতুনের উদ্যোগে প্রথম সঙ্গীত শেখার ক্লাস শুরু হয়। এই সময় রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাতেন সন্‌জীদা খাতুন ও ফরিদা মালিক, নজরুল সঙ্গীত শেখাতেন সোহরাব হোসেন, তবলা শেখাতেন বজলুল করিম, বেহালা ও সেতার শেখাতেন মতি মিয়া। ওই বছরই ছায়ানট সঙ্গীতবিদ্যায়তনের জন্ম হয়। ওস্তাদ আয়াত আলী খান সঙ্গীতবিদ্যায়তন উদ্বোধন করেছিলেন, আর বিদ্যায়তনের দ্বারোদঘাটন করেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন। বিদ্যায়তনের প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন ঢাকা বেতারের গুণী যন্ত্রী মতি মিঞা (মতিয়র রহমান খান)।

যে ছায়ানট'এর মাধ্যমে আজ সারা দেশে রবীন্দ্রসংগীতের চর্চা, শিক্ষা ও বিকাশ ঘটছে, সেই ছায়ানট প্রতিষ্ঠা পেয়েছে সন্‌জীদা খাতুনের হাত ধরেই। ছায়ানট'কে বিদ্যায়তন করা হয় নতুন নতুন শিল্পী তৈরির আশায়। বিদ্যায়তনে ভর্তি হওয়া সবাই হয়তো শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কিন্তু তাদের মনে-মননে সাংস্কৃতিক চর্চার বীজটা বপন করা হয়েছে। সৃষ্টির লগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত অসংখ্য শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে।

২.
শুধু রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ পালনই নয় পাকিস্তান আমলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরোধে তিনি 'আমার সোনার বাংলা' গানটি গেয়েছেন সাহসিকতার সাথে। পঞ্চাশের দশকে কার্জন হলের এক অনুষ্ঠানে ঘটে ঘটনাটি। সেদিন সন্‌জীদা খাতুনকে গান গাইতে বলা হয়েছিল। গান গাইতে গিয়ে খুব বিস্মিত হয়ে গেলেন। কী গান গাইবেন? কি ধরনের গান গাইবেন? এইটা বার বার ভাবছিলেন। তখন বঙ্গবন্ধু লোক মারফত বলে পাঠালেন তিনি যেন 'আমার সোনার বাংলা' গানটা গান। এই ধরনের অনুরোধে বেশ ঘাবড়েই গিয়েছিলেন। তখন তাড়াহুড়ো করে গীতবিতান সংগ্রহ করে তিনি গাইলেন 'আমার সোনার বাংলা' গানটি।

বঙ্গবন্ধুর এইভাবে গানটি শুনতে চাওয়ার একটা বিশেষ কারণ ছিল। সেদিন ওই অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর সাথে পাকিস্তানিরাও উপস্থিত ছিল। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের দেখাতে চেয়েছিলেন 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি' এই কথাটি বাঙালিরা কত আবেগ দিয়ে, কত সুন্দর করে উচ্চারণ করে।
রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদযাপনের সময় থেকেই রবীন্দ্র চর্চার বাধাটা জোর পেতে থাকে। ১৯৬১ সালে সন্‌জীদা খাতুন সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করতেন। কাজেই সরকারের অনুগত হয়ে সরকার বিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করা যায় না। কিন্তু তিনি রবীন্দ্র চর্চা থেকে দূরেও সরবেন না। এই সময় বাইরের অনুষ্ঠানে গান গাওয়া খুব কঠিন ছিল।

তখন তিনি রেডিওতে গান গাইতেন। রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে 'তাসের দেশ' নাটক মঞ্চস্থ করা হচ্ছিল। সন্‌জীদা খাতুনকে তখন গান গাইতেই হবে। তিনি গান গাইতে বসলেন ঠিকই কিন্তু মুখের সামনে রুমাল চেপে। যাতে করে তার গলা কেউ চিনতে না পারে। গলা চিনে ফেললে সরকারি চাকরিতে অসুবিধা তৈরি হবে এই আশঙ্কায় তিনি ভিন্ন পথে হেঁটেছিলেন।
১৯৬৭ সালের জুন মাসে পাকিস্তানের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন রেডিও টেলিভিশনে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচারের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করলেন, কারণ এই সঙ্গীত পাকিস্তানের আদর্শের বিরোধী। ১৯ জন বিশিষ্ট নাগরিক এই ফতোয়ার বিরুদ্ধে বিরোধিতা করে বিবৃতি দিলেন। ১৯ জন বিশিষ্ট নাগরিকের মধ্যে ছিলেন সন্‌জীদা খাতুনও। এতে রবীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতকে বাংলাভাষী পাকিস্তানির অবিচ্ছেদ্য অংশরূপে দাবি করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সন্‌জীদা খাতুন এবং ওয়াহিদুল হক সহ কয়েকজনের সক্রিয় উদ্যোগে গড়ে ওঠে গানের দল। এই দলটি মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে ঘুরে বেড়িয়ে যুদ্ধদিনের উদ্দীপক গান এবং রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন।
সন্‌জীদা খাতুনের এক বক্তৃতা থেকে জানা যায়, 'তাদেরকে তখন কলকাতায় পালিয়ে যেতে হয়েছিল। সেখানে গিয়ে 'রূপান্তরের গান' নামের একটি গীতি আলেখ্য তৈরি করেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে, শরণার্থীদের শিবিরে এবং ভারতের বিভিন্ন জায়গাতে সাধারণ মানুষকে আমাদের বেদনার সাথে যুক্ত করার জন্য গানগুলো গাওয়া হত।'

৩.
আজকের বর্ষবরণ বা পহেলা বৈশাখ উদযাপনে আছে আড়ম্বরতা এবং বিশাল আয়োজন। এই আয়োজন, আড়ম্বরতা বিস্তৃতি পেয়েছে ছায়ানট'এর কল্যাণে। বাঙালি সংস্কৃতির জন্য যারা সবসময় লড়াই করেছেন তাদের অনেকেরই নাম ছিল ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের এলেমিনেশন লিস্টে। সন্‌জীদা খাতুনের নামও ছিল তাতে।
সেই সময় ছেলে-মেয়েদের নিয়ে সাভারের একটি গ্রামে মাটির ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি। কারণ দেশের পরিস্থিতি ছিল উত্তাল। সেই সময়ও তিনি ওই গ্রামে বসে পারিবারিকভাবে পহেলা বৈশাখ পালন করেছেন। সকাল বেলা নিজের ছেলে-মেয়েদের নিয়ে গান করেছেন। এইরকম অসম সাহসিকতা একমাত্র তাঁর পক্ষেই দেখানো সম্ভব হয়েছে কারণ ততদিনে রমনার বটমূলে ছায়ানট'এর পহেলা বৈশাখ উদযাপন আনুষ্ঠানিকতা পেয়ে গেছে। আর এই পহেলা বৈশাখ উদযাপন আনুষ্ঠানিকতার শুরুও হয়েছে তাঁর হাত ধরে।

১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ইংলিশ প্রিপারেটরি স্কুলের সঙ্গে মিলে প্রথম বর্ষবরণ শুরু হয়েছিল। সেটা ছিল আসলে ওই স্কুলের বর্ষপূর্তির আয়োজন। সরু একটা গলির ভেতর কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে প্রথম নববর্ষ উদযাপন করা হয়েছিল।
পরবর্তীতে সন্‌জীদা খাতুনের বন্ধুপ্রতিম ড. নওয়াজেশ আহমেদ বললেন, 'এইসব কি হচ্ছে। আমরা কি স্কুলের অনুষ্ঠান দেখতে আসি। আমরা আসি নববর্ষ দেখতে। নববর্ষের একটা বাণী থাকবে। একটা বার্তা থাকবে। এতটুকু জায়গায় এইটা হয় না।'

নওয়াজেশের কথায় রমনার বটমূলে পহেলা বৈশাখ উদযাপন স্থানান্তরিত হল। সেই ১৯৬৭ সাল শুরু করে এখনো পর্যন্ত বাংলা বছরের প্রথমদিনে রমনার বটমূলে ভোরের প্রথম প্রহরে আবাহনী সুরের মধ্যদিয়ে বর্ষবরণের মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়। এই আবাহনী সুরের রেশ মুগ্ধ করে রাখে পুরো দেশবাসীকে।

আজ ৯০ বছরে পা রাখলেন সন্‌জীদা খাতুন। জন্মদিনে জানাই আন্তরিক শ্রদ্ধা। 

Comments

The Daily Star  | English

Admin getting even heavier at the top

After the interim government took over, the number of officials in the upper echelon of the civil administration has become over three times the posts.

7h ago