শনিবারের চিঠির নীরদ চৌধুরী
নীরদচন্দ্র চৌধুরী ইংরাজিতেই লিখিতেন। ভালো ইংরাজি লিখিতে পারেন বলিয়া তাহার বেশ খানিকটা আত্মতৃপ্তি ছিল। তবে তাহার বাংলা রচনার কথাও উল্লেখযোগ্য। তাহার প্রথম বাংলা বই 'বাঙালী জীবনে রমণী' প্রকাশিত হইয়াছিল ১৯৬৮ সালে। দিল্লীবাসী নীরদ চৌধুরীর বয়স তখন প্রায় ৭১ বৎসর। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখিয়াছেন, 'এ পর্যন্ত আমি বাংলা বই লিখি নাই, এই আমার প্রথম বই। পঞ্চাশ বৎসর বয়সে ইংরেজিতে প্রথম বই লিখিতে আরম্ভ করিয়াছিলাম, সত্তর বৎসর বয়সে বাংলায় লিখিলাম।' বাংলায় লেখা তাহার কয়েকটি বই বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে তাহাকে প্রচণ্ড ভাবে জনপ্রিয় করিয়া তুলিয়াছিল। এইগুলি হইল আত্মঘাতী বাঙালি, আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ, আমার দেবোত্তর সম্পত্তি, আজি হতে শতবর্ষ আগে, আমার দেশ আমার শতক।
এক অর্থে মনে হইতে পারে যে বিখ্যাত হওয়ার পরই তিনি বাঙলা ভাষায় লিখিতে আরম্ভ করিয়াছেন, কিন্তু ঘটনা তাহা নহে। শুরু হইতেই বাংলা সাহিত্যে তাহার অবদান রহিয়াছে: আজ হয়তো বিষয়টি অনালোচিত—কিন্তু নীরদ চৌধুরী স্বয়ং সজনীকান্ত-খ্যাত শনিবারের চিঠি পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করিয়াছেন এবং ইহাসহ আরো কয়েকটি সাহিত্য পত্রিকায় বেশ কিছু সমালোচনা ও গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখিয়াছেন।
১৩৩৪ সালের ভাদ্রে মাসিক শনিবারের চিঠির সূচনা; শনিমণ্ডলীতে নীরদচন্দ্র চৌধুরীর যোগদান হইলো এই পর্যায়ে। কৈশোরের শিক্ষক মোহিতলাল মজুমদারের আহব্বানেই তিনি শনির আসরে যোগ দিয়াছিলেন। প্রথমে তিনি কয়েকটি 'সাহিত্য প্রসঙ্গ' লিখিয়া আনিলে তা' শনিমণ্ডলীর সবাইকে বিস্মিত ও মুগ্ধ করিল।
মাসিক শনিবারের চিঠিতে নীরদ চৌধুরীর প্রথম রচনাটি 'প্রসঙ্গ-কথা' শিরোনামে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় সংখ্যায় (কার্তিক, ১৩৩৪)। এই নিবন্ধে তিনি লিখিলেন, 'প্রায় পঞ্চাশ বৎসর আগে বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা সাহিত্যের একটি পরিচয় দিয়াছিলেন। আজকালকার দিনে বঙ্কিমচন্দ্রের মতামত উদ্ধৃত করিতে যাওয়া বিপজ্জনক। এ দেশের 'স্কুল-বয়' সাহিত্যিকদের একটি কাগজ হইতে জানিতে পারিলাম যে, যে বয়সে Sainte Beuve, Matthew Arnold প্রমুখ মূর্খ সমালোচকেরা B-a বে B-y বাই পড়িত সেই বয়সে তাহাদের Scott, Jane Austen, Dickens, Thackeray হজম হইয়া গিয়াছে। পরিণত বয়সে তাহারা এই শিশু-সাহিত্যের মধ্যে পড়িবার মতো কিছু পান নাই। যাহারা প্রথমভাগ পড়িবার বয়সেই Dickens, Thackeray হজম করিতে পারিয়াছেন, তাহারা জননীর গর্ভে থাকিতেই বঙ্কিমচন্দ্রকে গণ্ডুষ করিয়া ফেলিয়াছেন একথা মনে করা অস্বাভাবিক নয়। আমাদের জঠরে অগ্নি-বৈশ্বানর বসিয়া নাই। আমাদের হজম করিবার ক্ষমতা নিতান্তই কম। সুতরাং আমরা বঙ্কিমচন্দ্রকে শ্রদ্ধার সহিতই উদ্ধৃত করিব।'-এই উদ্ধৃতি হইতে নীরদ চৌধুরীর তীর্যকদৃষ্টি, রসবোধ এবং সাবলীল লেখনীশৈলীর পরিচয় পাওয়া যায়। তবে বলা দরকার, যৌবনের এই ক্ষুরধার মেজাজ পরিণত বয়সে কোমল হইয়াছিল।
'শনিবারের চিঠি'তে এরূপ ব্যঙ্গাত্মক রচনার জন্যে তিনি 'বলাহক নন্দী' ছদ্মনাম ব্যবহার করিতেন। প্রতিমাসেই তিনি 'প্রসঙ্গ-কথা' শিরোনামে নিয়মিত লিখিতে শুরু করেন। যুক্তি, কৌতুক, ব্যঙ্গ আর পাণ্ডিত্য 'প্রসঙ্গ-কথা'কে রীতিমতো মনোগ্রাহী করিয়া তোলে। অগ্রহায়ণের (১৩৩৪) 'প্রসঙ্গ-কথা'য় তিনি লিখিলেন, 'বাঙালী লেখকদের ইন্দ্রিয় পরতন্ত্রতা furtive sheepish জাতীয়। সমাজ-সংস্কার ও বিপ্লববাদের বেনামী অশ্লীলতা অপেক্ষা বিদ্যাসুন্দরের খোলাখুলি কথা অনেক ভাল ছিল। ...আমরা সর্বদাই দেশের নৈতিক উন্নতি-অবনতির দিকে চক্ষু ফিরাইয়া রহিয়াছি, ভাষার দিকে কাহারো খেয়াল নাই। ...বাণীর এই সকল একনিষ্ঠ সেবক ও বরপুত্রদিগকে সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করিতে পারি কি, তাহারা idiom ও syntax--এর উপরে এত বিরূপ কেন? কাব্য ও উপন্যাস বিংশ শতাব্দীর সরস্বতীরই প্রিয় পুত্র ও প্রিয় কন্যা তাহা জানি, কিন্তু ব্যাকরণও যে সরস্বতীরই সন্তান—অন্ততঃ সপত্নী সন্তান—এ কথাটা কি তাহারাও স্বীকার করেন না?' সমসাময়িক লেখকদের ভাষার ব্যাপারে অন্যত্র লিখিয়াছেন, 'আমাদের সাহিত্যিকরা যদি অশ্লীলতার জাতি মারিতে চান, তবে মারুন। সহ্য না করিয়া কি করিব?... কিন্তু ছাপার অক্ষরে ভাষা ও ব্যাকরণ ভুল যে বড় বাজে!'
মাসিক 'শনিবারের চিঠি'র পৌষ (১৩৩৪) সংখ্যার 'প্রসঙ্গ-কথা'য় তিনি সমসাময়িক সাহিত্য বিচার প্রসঙ্গে বিতৃষ্ণা ব্যক্ত করিয়াছিলেন। তিনি লিখিয়াছিলেন, 'আমারই এক এক সময় মনে হয়, তরুণ-সাহিত্য রসাতলে যাউক। যাহাদের পড়িয়া আনন্দ পাইয়াছি, তাহাদের-সম্বন্ধেই কিছু বলি। কিন্তু যে সাহিত্য জুতোর পেরেকের মতো পায়ের তলায় নিদারুণভাবে প্রতি মুহূর্তে ফুটিতেছে, তাহাকে কি ভোলা সহজ?' অতি-আধুনিক বাংলা সাহিত্য পছন্দ না-হইলেও তাহা পাঠের ও আলোচনার পক্ষে এ ভাবেই যুক্তি খাড়া করিয়াছেন নীরদ চৌধুরী। পরবর্তীকালে অবশ্য এমতরূপ ব্যাখ্যা দিয়াছিলেন যে সময়াভাবই পঠন-পাঠনের বিষয়ে বাছাইপ্রবণতার মূল কারণ। তবে প্রুফ দেখিতে হইত বলিয়া অনেক নবীন লেখকের লেখাও পড়া হইয়া যাইত। এভাবেই তিনি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প-উপন্যাসের সঙ্গে পরিচিত হইয়াছিলেন।
মাঘ ১৩৩৪ হইতে নীরদ চৌধুরী শনিবারের চিঠির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করিয়াছেন। সেই সময় 'শনিবারের চিঠি'র সম্পাদক পদের জন্যে নীরদ চৌধুরীকে স্থান দেওয়া খুবই কৌশলী পদক্ষেপ হইয়াছিল। কেননা 'শনিবারের চিঠি'র বিরুদ্ধপক্ষ কথায়-কথায় আধুনিক ইয়োরোপীয় সাহিত্যের দোহাই দিতেন। তাহাদের সমুচিত জবাব দেওয়ার জন্যে যে পাণ্ডিত্য ও পড়াশোনা থাকা দরকার নীরদ চৌধুরীর তাহা ছিল। রেফারেন্স ও ক্রস-রেফারেন্স দিয়া শত্রু পক্ষকে কুপোকাৎ করিতে তাহার সমকক্ষ কেহ সেইকালে ছিল না। তাহার পক্ষেই অকাতরে লেখা সম্ভব ছিল, 'আগুন, প্রতিভা ও সর্পশিশু বয়সের অপেক্ষা রাখে না ... কবি-প্রতিভার বিকাশ যে কত অল্প বয়সে হইতে পারে তাহা আমরা শেলী, ভিক্টর হুগো ও শ্রীযুক্ত বুদ্ধদেব বসুর দৃষ্টান্ত হইতেই জানিতে পারিয়াছি। ... যাহারা তরুণ বয়সে লিখিয়া থাকেন তাহারা হয় 'জিনিয়াস' নয় জ্যাঠা। ...'
নীরদচন্দ্র চৌধুরীর লেখনী সম্পর্কে সজনীকান্ত দাস যাহা লিখিয়াছেন তাহা প্রণিধানযোগ্য: 'নীরদচন্দ্র চৌধুরী বিচিত্র মানুষ। বেঁটে খাটো মানুষটি অথচ বিদ্যার জাহাজ। সাত সমুদ্র তেরো নদীর খবর তাহার নখাগ্রে ছিল, ফরাসী সাহিত্যের তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ ভক্ত এবং সারা পৃথিবীর সামরিক বিদ্যার তিনি ছিলেন মনোয়ারী জাহাজ। তাহার ভালো-লাগা এবং মন্দ-লাগা গুরু মোহিতলালের মতই অতি স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট ছিল; একটু খামখেয়ালি প্রকৃতির ছিলেন, বিপুল সমারোহে কাজ আরম্ভ করিয়া শেষ করিতে জানিতেন না, গাছে উঠিয়া নিজেই মই ফেলিয়া দিতেন।'
বস্তুত প্রতিপক্ষকে উপযুক্ত জবাবের ঘায়ে ধরাশায়ী করিবার ব্যাপারে নীরদ চৌধুরীর জুড়ি ছিল না। একবার প্রগতিতে ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় আত্মপক্ষ সমর্থন করিতে গিয়া লিখিলেন: 'আমাদের রচনাভঙ্গির জন্য continental লেখকদের প্রভাব, বিশেষ করে হামসুন ও গোর্কির প্রভাব দায়ী।' আর যায় কোথায়, নীরদ চৌধুরী অচিরাৎ লিখিলেন, 'তাই বলুন। শুধু ইংরেজি ও বাংলা জানার ফলেই আমরা ইংরেজি লিখিতে বাংলা লিখি, বাংলা লিখিতে গিয়া ইংরেজি লিখি। ইহার পর যদি কাহারও নরওয়েজিয়ান ও রুষভাষা জানা থাকে, তবে তাহাদের ভাষা espernato-এর মতো তিলোত্তমা হইয়া উঠিবে!'
বিশ শতকের প্রথমভাগে বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার সূত্রপাত হইয়াছিল প্রধানত ইয়োরোপীয়, বিশেষ করিয়া, ইংরেজি সাহিত্যের অনুকরণে। কল্লোলের যুগে কথাসাহিত্যে পশ্চিমী প্রভাব বেশ প্রকট হইয়া উঠিয়াছিল। জীবন বাস্তবতার নামে যৌন প্রসঙ্গ গল্প-উপন্যাসের অন্যতম প্রধান উপজীব্য হইয়া পড়িয়াছিল। ফলে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও গোষ্ঠীর মধ্যে সাহিত্যে শ্লীলতা-অশ্লীলতার বিরোধ বেশ জমিয়া উঠে। নানা যুক্তিজাল বিস্তার করিয়া, প্রগতিতে দাবি করা হইলো, 'সাহিত্যে অশ্লীলতার স্থান আছে।' এই দাবির সমর্থনে একদিকে কালিদাস অন্যদিকে শেক্সপীয়র হইতে উদাহরণ দেয়া হইল। ইহার প্রত্যুত্তরে নীরদ চৌধুরী লিখলেন: 'আজকালকার সাহিত্যিকদের ও তাদের বিদ্রোহ-বায়ুগ্রস্ত পৃষ্ঠপোষকগণের ধারণা ছিল যে অশ্লীলতা আছে, এমন কি ভারতচন্দ্রেও অশ্লীলতা আছে, তখন তাহারা স্বপক্ষে এতগুলি বড় নজির পাইয়া আহ্লাদে আটখানা হইয়া মৌলিকতার মায়া একেবারে কাটাইয়া ফেলিলেন।' অতঃপর নবীন কথাসাহিত্যিকদের বিভিন্ন রচনা হইতে রসালো অংশের উদ্ধৃতি দিয়া নীরদ চৌধুরী মন্তব্য করিলেন, 'ইহাদের অশ্লীলতা করিবার আকাক্সক্ষা আছে, অথচ অশ্লীলতা করিবার সাহস ও বৈদগ্ধের অভাব।'
নীরদ চৌধুরী অনেক ক্ষেত্রে বেনামে লিখিয়াছেন। 'শ্রীযুক্ত প্রমথ চৌধুরী পেন্সিল ড্রয়িং: তাহার 'কালি-কলমের পেশা'র' পঞ্চবিংশতি বর্ষ পূর্ণ হওয়া উপলক্ষে' নীরদ চৌধুরীর এইরূপ একটি বেনামা রচনা। প্রমথ চৌধুরীর ন্যায় সম্মানিত ব্যক্তি সম্পর্কে এরূপ ব্যাজস্তুতিমূলক প্রবন্ধ সঙ্গত কারণেই সে-সময় বিক্ষোভের শোরগোল তোলে। রচনাটি হইতে খানিকটা উদ্ধৃতি দিলে বিষয়খানা খোলাসা হইবে: 'প্রমথ বাবুর জীবন একটা ট্র্যাজেডি। প্রমথবাবু 'পলিটিকস, ইকনমিক্স, শিক্ষা, সমাজ, হিন্দুধর্ম, ইসলামধর্ম ইত্যাদি যে কোন একটা অথবা সব কটা নিয়ে অতি গম্ভীর ও অতি রাগত ভাবে নানারূপে প্রভুসম্মত বাণী ঘোষণা' করিতে পারেন না, ইহাই তাহার জীবনের সব চেয়ে বড় ট্র্যাজেডি নয়। তাহার জীবনের ট্র্যাজেডি ইহাই যে এই বৈদগ্ধ্য-বর্জিত বাংলা দেশে জন্মগ্রহণ করার ফলে অতি ক্ষুদ্র বিষয়ে তাহার অতি তুচ্ছ রসিকতাকেও লোকে গুরু-গম্ভীর দার্শনিক তত্ত্ব বলিয়া ভুল করিয়া বসে। আমরা বিষবৃক্ষের ফলের কথা শুনিয়াছি। কিন্তু বিষবৃক্ষের কি ফুল ফোটে না? প্রমথবাবু বৈদগ্ধ্য বিষবৃক্ষের ফুল।'
তৎকালীন সাহিত্য মহলে প্রমথ চৌধুরী যথেষ্ট সম্মাননীয় ব্যক্তি ছিলেন। ফলে এই নিবন্ধ প্রকাশের পরে সর্বস্তরে তীব্র সমালোচনার ঝড় উঠিয়াছিল: 'বাংলার কথা' পত্রে ২২ বৈশাখ ১৩৩৫ সংখ্যায় লেখা হইলো: 'প্রবন্ধ লেখক অতিশয় কৃশ, সুতরাং তাহার রুচি নীচ হওয়াই স্বাভাবিক। 'আত্মশক্তি'র ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৫ সংখ্যায় লেখা হইলো, 'লেখক অতিশয় বেঁটে বলেই এমনটি সম্ভব হইয়াছে।'
এই সব অগ্রাহ্য করিয়া 'শনিবারের চিঠি'র জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৫ সংখ্যায় নীরদ চৌধুরী 'পুনশ্চ' লিখিলেন, 'প্রমথবাবুর যে বৈশিষ্ট্য সকলের আগে লোকের চোখে পড়ে সেটা তাহার রচনার গুণ অথবা দোষ নয়, তাহার টেম্পেরামেন্টের বিশেষত্ব। ... কিন্তু আমাদের দেশে, আমাদের কালে, প্রমথবাবুর চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যের এই উগ্র ও অবিরত আত্মপ্রকাশ ও তাহার ইনটেলেকচুয়াল ফ্রিভোলিটি—শিক্ষা, সাহিত্য ও 'কালচারে'র পক্ষে একটা গুরুতর অনিষ্টকর ব্যাপার হইয়া দাঁড়াইয়াছে; ইহাই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।' এইখানে বলিয়া রাখা জরুরী যে, শনিমণ্ডলীর পাকে-চক্রে পড়িয়া প্রমথ চৌধুরীকে হেনস্তা করিলেও কাহারও নিন্দা করা ব্যক্তি নীরদ চৌধুরীর অভ্যাস ছিল না। বাস্তবিক কাহারো সঙ্গে বিরোধ হইলে তিনি মনে পুষিয়া রাখিতেন না, দ্রুত তাহা ভুলিয়া যাইতেন।
বাংলায় লিখিতে গিয়া 'শনিবারের চিঠি'র কারণে অনেক হালকা ওজনের ব্যাঙ্গাত্মক রচনা লিখিলেও নীরদ চৌধুরী কিছু সমালোচনা ও গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ লিখিয়াছিলেন। এরূপ একটি প্রবন্ধ হইল 'বর্তমান ভারতের সংস্কৃতি'। ইহা ১৩৪৩-এ শনিবারের চিঠির ফাল্গুন সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এতে লিখিলেন: '...আমার মনে হয়, ১৯১০-১১ সন হইতে ১৯১৮-১৯ সন পর্যন্ত আমাদের জাতীয় জীবনে একটা মোড় ফিরিবার কাল। যে প্রথম উদ্যম ও উৎসাহ একশত বৎসর ধরিয়া প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ধারার সংমিশ্রণে একটা নূতন সাহিত্য, চিত্রকলা, দার্শনিক চিন্তা ও ধর্মসাধনা গড়িয়া তুলিয়াছিল তাহা যেন এই কয় বৎসরের মধ্যে অবসাদের লক্ষণ প্রদর্শন করিতে আরম্ভ করিল। প্রকৃতপ্রস্তাবেও এই যুগের পর বর্তমান ভারতে সত্যকার কোন সৃষ্টি হইয়াছে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। গণিত, রসায়ন, বা পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণা করিয়া যাহারা এ যুগে খ্যাতি অর্জন করিতেছেন তাহাদের কথা এখানে ধরিতেছি না, কারণ তাহাদের এই সকল কার্যকলাপ এতটা বিশিষ্ট ও বিচ্ছিন্ন যে সমগ্র জাতীয় জীবনের সহিত উহাদের সম্পর্ক কি, এমন কি সম্পর্ক আছে কি নাই, এখনও তাহা বুঝিবার সময় হয় নাই। কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে দেখিতেছি, এই যুগের পর আমাদের অসামান্য ব্যক্তিরা নিজেদের অনুকরণ করিতেছেন ও সামান্য ব্যক্তিরা অপরের অনুকরণ করিতেছে। এই বিচারহীন অনুচিকীর্ষা আজ এত দূর গড়াইয়াছে যে আমাদের সংস্কৃতিসৃষ্টির চেষ্টা আমাদের জীবনের সত্যকার প্রবাহ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া সম্পূর্ণ কৃত্রিম ও বাহ্যিক একটা ব্যাপার হইয়া দাঁড়াইয়াছে।'
এই প্রবন্ধ পড়িয়া বুঝা যায় যে জীবনের শুরুতেই নীরদ চৌধুরী একজন বৈজ্ঞানিকের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়া ইতিহাস পর্যালোচনায় ব্রতী হইয়াছিলেন। তাহার প্রায় সব রচনাতেই একজন ইতিহাসবেত্তা নীরদ চৌধুরীর সক্রিয়তা জাজ্জ্বল্যমান। এমনকি যখন আত্মজীবনী The Autobiography of an Unknown Indian লিখিতেছেন, তখনো একজন ঐতিহাসিকেরই দায়িত্ব তিনি পালন করিতেছেন বলিয়া সংশয় থাকে না। বস্তুত নীরদ চৌধুরীর রচনা কেবল ভারতের অতুলনীয় ধাতের ইতিহাসই নয়, তাহা ইতিহাসের একটি যৌক্তিক এবং সুখপাঠ্য অনুবাদও বটে।
নীরদ চৌধুরী শুরু হইতে সাধু ভাষাতেই লিখিতেন। এবং শেষ পর্যন্ত সাধুভাষাতেই তাহার আস্থা অটুট ছিল। তিরিশের দশকের পর দীর্ঘকাল নীরদ চৌধুরী বাংলায় আর লেখেন নাই। এই প্রসঙ্গে তিনি বন্ধু ও বিশিষ্ট সাংবাদিক, শংকর ঘোষকে বলিয়াছিলেন, 'আমি বাঙলা লেখা ছেড়ে দিয়েছি কেন জানেন? বাংলায় এখন ক্রিয়াপদের অন্তে অন্তে বিভক্তি, কারক ইত্যাদির সূচক ইনফ্লেকশনগুলি লোপ করে এমন এক ভাষার সৃষ্টি করেছে যা আমার মোটেই পছন্দ নয়। ওই রকম বাঙলায় আমি লিখতে চাই না।' ইহার পরে সত্তরের ঘরে পা দিয়া যখন 'বাঙালী জীবনে রমণী' লিখিতে শুরু করেন, তখন নীরদ চৌধুরীর মনোভাব অনুকল ছিল না।
নীরদ চৌধুরী তাহার ইংরেজি ও বাংলা লেখার মধ্যে চমৎকারভাবে তুলনা করিয়াছেন। অক্সফোর্ডে তাহার বাড়িতে একটি কলমকরা রোডোডেনড্রন গাছ ছিল। এটিতে দুইরকমের ফুল হইতো। কলমের হতো গাঢ় রঙের, গোড়ার ফুল একটু ফ্যাকাশে। নীরদ চৌধুরী লিখিয়াছেন, তাহার ইংরেজি লেখা ওই কলমের ফুলের মতো, আর বাংলা লেখা মূলাংশের ফুলের মতো—একটু ফ্যাকাশে।
কিন্তু নীরদ চৌধুরীর সঙ্গে আমরা সম্পূর্ণ একমত নই; আমরা দেখি তাহার 'কলমকরা' ইংরেজি যেমন উজ্জ্বল বর্ণের তেমনি 'মূলাংশে'র বাংলা রচনাও কোন অংশে অনুজ্জ্বল নয়। চিন্তার তী²তায়, প্রকাশভঙ্গির সাবলীলতায়, ভাষার গতিশীলতায়, শব্দচয়নের যাথার্থ্য, তাহার বাংলা অনবদ্য। সেই সঙ্গে হাস্য-কৌতুক ও ব্যঙ্গরসের অঢেল মিশেল তাহার রচনাকে করিয়াছে মনোগ্রাহী ও আকর্ষণীয়।
Comments