রণক্লান্ত অ্যাডগার অ্যালান পো

লেখকদের জীবনেও কি দুঃখকষ্ট থাকে? এই প্রশ্ন করলে বেশিরভাগ মানুষই জানা উত্তর ঘুরপাক খাবে। সবারই ধারণা লেখক মানেই বিত্ত, বৈভবে চলা মানুষ। তার জীবনে দুঃখকষ্ট নেই। তিনি আনন্দ, উল্লাস, উৎসবে জীবনযাপন করেন। পাঠকের এই ধারণা বা মিথ হয়ে যাবে অ্যাডগার অ্যালান পো সম্পর্কে জানলে।

অ্যাডগার অ্যালান পো'র সাহিত্য নিয়ে আলোচনা হলেও তার জীবন নিয়ে কম মানুষ জানেন। তার যাপিত জীবন সত্যি বিস্ময়কর। প্রতিটি পদে তিনি জীবনকে শানিত করেছেন এবং নিজেও শানিত হয়েছেন। জীবনকে যাপন করতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পড়েছেন। এই যাপন কি খুব কষ্টের? এই যাপন কি খুবই দুরূহ? অ্যাডগার অ্যালান পো'র জীবনী তাই মনে করিয়ে দেয়।

ছেলেবেলা থেকে যতটা কষ্ট পেয়েছেন, দারিদ্র্যতার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন, নিদারুণ বেদনা বইয়ে বেড়িয়েছেন তা হতবাক করার মতো। তিনি একজন ইংরেজ কবি, লেখক, সাহিত্য সমালোচক এবং ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম বিজ্ঞান কল্পকাহিনী ও গোয়েন্দা গল্পের স্রষ্টা। তার লেখা গল্প, উপন্যাস এবং কবিতার ভৌতিকতা এবং রহস্যের আবহাওয়া আজও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। গোয়েন্দা গল্পে তিনি যে পথ দেখিয়েছেন- তা এখনো অনুসরণীয়।

অ্যাডগার অ্যালান পো, নাম শুনলেই দৃশ্যপটে ভেসে আসে অন্ধকারাচ্ছন্ন কোনো পরিবেশ, আলো-আঁধারি স্তিমিত সন্ধ্যা, কালো কাক, ভয়, কালো বিড়াল, থ্রিলার, মৃত্যুসহ অনেক বিষয়। এসব ভেসে আসে কারণ তার সাহিত্যে এসব উপাদান ছিল। লেখায় এসব উপাদান ঘুরে ফিরে এসেছে।

১৮০৯ সালের ১৯ জানুয়ারি বোস্টনে এলিজাবেথ আর্নল্ড পো এবং ডেভিড পো জুনিয়র অভিনয়শিল্পী দম্পতির পরিবারে জন্ম নেন অ্যাডগার অ্যালান পো। পরিবার ছিলো সংস্কৃতিমনা ও সাহিত্য অনুরাগী। ইংরেজি ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক এবং বিশ্বের অগ্রণী নাট্যকার উইলিয়াম শেকসপিয়ারের 'কিং লিয়ার' থেকে এলিজাবেথ আর্নল্ড পো এবং ডেভিড পো জুনিয়র তাদের ছেলের নাম রাখেন অ্যাডগার।

আনন্দমুখর পরিবেশে জন্ম হলেও সেই আনন্দ স্থায়ী হয়নি বেশিদিন। মাত্র ৩ বছরের মাথায় মারা যান তার মা। মায়ের স্মৃতি গড়ে ওঠার আগেই তিনি মা'কে হারান। তাদের সমাজব্যবস্থা কিন্তু আমাদের মতো নয়। আত্মনির্ভরশীল সমাজ ব্যবস্থায় সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। নিজের লক্ষ্য গোছানোতে ছুটতে থাকে। মায়ের মৃত্যুর পর অ্যালান পো'র বাবা তাকেসহ তার ৩ ভাইবোনকে ফেলে চলে যান।

এরপর জন অ্যালান নামের একজন ধনী তামাক ব্যবসায়ী অ্যাডগার অ্যালান পোসহ সবাইকে দত্তক নেন। শুরু হয় নতুন জীবন। ছোটবেলা থেকেই পো লেখাপড়ায় বেশ মেধাবী ছিলেন। পো চাইতেন লেখাপড়া করতে কিন্তু তার দত্তক বাবা জন অ্যালান চাইতেন, ছেলে বড় হয়ে তার মতো ব্যবসায়ী হবে। এই দ্বন্দ্ব চলতে থাকে।

দ্বন্দ্বের মাঝেও পো তার পড়ালেখা থামাননি। অল্প বয়সেই পো ইংরেজ কবি লর্ড বায়রনের বিশেষ ভক্ত হয়ে ওঠেন এবং তার মাঝে লেখক হওয়ার স্বপ্ন জেগে ওঠে। এরমধ্যে পো'কে অনেক কঠিন সময় পাড়ি দিতে হয়। ১৮২৬ সালে পো রিচমন্ড ছেড়ে ভার্জিনিয়া আসেন। ভার্জিনিয়া আসেন 'ইউনিভার্সিটি অফ ভার্জিনিয়ায়' পড়তে। এখানে তাকে ভয়াবহ অর্থ সংকটে পড়তে হয়।

জন অ্যালান যে টাকা পাঠাতেন তা দিয়ে টিকে থাকা দায় হয়েছিল। পো তখন জুয়া খেলা শুরু করেন। জুয়া খেললে অনেক টাকা পাবেন এটা ছিল তার বিশ্বাস। কিন্তু টাকা পাওয়া তো দূরের কথা পো আরও নিঃস্ব হয়ে যান। একদিকে দরিদ্রতা অন্যদিকে ভয়াবহ শীত। এই দুইয়ের মাঝে পো দিন পার করছেন। শীত থেকে বাঁচতে যে কাঠ কিনতে হবে সেই টাকাও তার ছিল না, তাই তিনি আসবাবপত্র পোড়ানো শুরু করেন।

পো'র জীবনী নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার মতো। ছন্দে ছন্দে নতুন দিক উন্মোচিত করে। সেই উন্মোচনে সত্য রূঢ়, যাপন বিলাসিতা নয় কাম্য। নজরুলের মতো বলতে হয়,

'আমি    সন্ন্যাসী, সুর-সৈনিক,
আমি    যুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক।
আমি    বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস,
আমি    আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ!'

পো'র একদিকে দেনা বাড়তে থাকে, অন্যদিকে দারিদ্র্যের লজ্জা এবং জন অ্যালানের প্রতি ক্ষোভ বাড়তে থাকে। দরিদ্রতা, লজ্জা, ক্ষোভে পো তখন বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেন। ভার্জিনিয়া ছেড়ে রিচমন্ড ফিরে আসতে বাধ্য হন। টিকে থাকার জন্য নতুন অভিসন্ধি খুঁজতে থাকেন।

সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছিল আরও হৃদয়বিদারক ঘটনা। ফিরে এসে তিনি দেখেন তার প্রেমিকা সারাহ'র বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ক্ষুব্ধ মন নিয়ে তিনি আবার বোস্টন ফিরে যান। নজরুলের মতো বললে বলতে হয়,

'আমি    অভিমানী চির ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়
চিত      চুম্বন-চোর কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম প্রকাশ কুমারীর!
আমি    গোপন-প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল-ক'রে দেখা অনুখন,
আমি    চপল মেয়ের ভালোবাসা, তা'র কাঁকন-চুড়ির কন-কন!'

প্রেমিকা বিদায়ের শোক তিনি শক্তিতে রূপান্তরিত করেন। বোস্টনে এসে তিনি একটি বায়রনিক কবিতার ছোট বই প্রকাশ করেন। তখনো দরিদ্রতা তার পিছু ছাড়ে না। অর্থ লাভের আশায় তিনি আর্মিতে যোগ দেন। সেখানেও বেশিদিন টিকতে পারলেন না। বের হয়ে তিনি নিউইয়র্ক চলে আসেন। এখানে তিনি প্রচুর ইংরেজি সাহিত্য ও কবিতা পড়া শুরু করেন। এই সময় শুরু করেন ছোটগল্প লেখা।

১৮৩৩ সালে তার 'মিস ফাউন্ড ইন অ্যা বটল' বইটি প্রকাশিত হয়। বইটি 'বাল্টিমোর উইকলি' থেকে ৫০ ডলার পুরস্কারও জেতে। এরমধ্যে পো তার কাজিন ভার্জিনিয়া ক্লেমকে বিয়ে করেন। বিয়ের পরও পো'র জীবন থেকে দরিদ্রতা যায়নি। কষ্ট ভুলতে তিনি একসময় মদ খাওয়া শুরু করেন। মদ্যপ হওয়ার কারণে তার চাকরি চলে যায়।

অ্যাডগার অ্যালান পো'র জীবনের কষ্ট লিখতে গিয়ে বারবার আমার কবি জীবনানন্দ দাশ, চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটক বা উপমহাদেশের অন্যতম শক্তিমান অণুগল্পকার সাদাত হোসেন মান্টোর কথা মনে পড়ছে। তাদের জীবনে দরিদ্রতা ছিল নিত্যসঙ্গী। দারিদ্রতা দূর করার জন্য তারা অনেক চেষ্টা করেছেন কিন্তু দারিদ্রতা তাদের ছাড়েনি। তারা এতটাই আত্মপ্রত্যয়ী ছিলেন যে, দারিদ্র্যতার কাছে হার মানেননি। তারা তাদের সৃষ্টিকর্ম চালিয়ে গিয়েছেন যেমন অ্যাডগার অ্যালান পো চালিয়ে গিয়েছেন। এরা কেউ সৃজন, সৃষ্টি থেকে সরে আসেননি বরং রূঢ় সময়কে নিজেদের সৃজনে নিয়ে এসেছেন।

১৮৩৮ সালে পো'র 'দ্য ন্যারেটিভ অফ আর্থার গরডন প্যম' বইটি প্রকাশিত হয় এবং ১৮৩৯ সালে তিনি ফিলাডেলফিয়ায় 'বার্টনস জেন্টেলম্যানস ম্যাগাজিন'-এ সহসম্পাদক নিযুক্ত হন। এসময় তার 'টেলস অফ গ্রোটেক্স অ্যান্ড অ্যারাবস্ক' বইটিও প্রকাশিত হয়।

১৮৪০ সালে তিনি সহসম্পাদকের চাকরি ছেড়ে দেন। তখন 'গ্রাহামস লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলম্যান' থেকে গোয়েন্দা উপন্যাস 'দ্য মার্ডার ইন দ্য রিউ মর্গ' প্রকাশিত হয়। এটি ইতিহাসের প্রথম গোয়েন্দা উপন্যাস।

১৮৪৩ সালে তার 'দ্য গোল্ড বাগ' গল্পটি ফিলাডেলফিয়ার 'ডলার নিউজপেপার' থেকে ১০০ ডলার পুরস্কার জেতে। জেতার পর তার জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। ১৮৪৪ সালে তিনি নিউইয়র্কে ফিরে আসেন। ১৮৪৫ সালের ২৯ জানুয়ারি 'আমেরিকান রিভিউ' থেকে তার কালজয়ী কবিতা 'দ্য র‍্যাভেন' প্রকাশিত হয়। 'দ্য র‍্যাভেন' তাকে রাতারাতি খ্যাতি এনে দেয়। এরপর বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি বেশকিছু ছোটগল্প এবং আরও কিছু বিখ্যাত লেখা প্রকাশ করেন। ভৌতিক এবং রহস্য গল্পের জন্য তার খ্যাতি বাড়তে থাকে। একদিকে খ্যাতি অপরদিকে মদ্যপ অবস্থা সমানভাবে চলছে। সেই অবস্থায় ১৮৪৯ সালের ৭ অক্টোবর অ্যাডগার অ্যালান পো'র আকস্মিক মৃত্যু হয়। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যেন তার বিদ্রোহী মন শান্ত হয়। থেমে যায় ছুটে চলা।

পো'র মৃত্যু বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। কীভাবে তিনি মারা গেলেন তা এখনো রহস্যময়। কেউ বলেন, তিনি নির্বাচনী সংহিসতার শিকার। কেউ বলেন, তাকে খুন করা হয়েছে। কেউ বলেন, তিনি নিজেই সন্ত্রাসী হামলার শিকার। কেউ বলেন, তিনি মদ্যপ অবস্থায় অপরের সঙ্গে সংঘর্ষের শিকার। তবে, যে কারণেই তার মৃত্যু হোক না কেন- মৃত্যুর রহস্য এখনো উদঘাটিত হয়নি।

আরও বিস্ময়কর হলো, পো'র সৎকার অনুষ্ঠানে মাত্র ৭ জন মানুষ উপস্থিত ছিলেন। এরকম সৎকার কি একজন শক্তিমান সাহিত্যিকের কাম্য? কখনোই নয়। তিনি যখন মারা যান তখন তিনি খ্যাতিমান এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তাহলে কেন তার সৎকারে বেশি মানুষ অংশ নেয়নি? এর উত্তর অজানা। সৎকারের ঘটনা মনে করিয়ে দেয় জীবনানন্দ দাশের সৎকারের ঘটনা। তার সৎকার অনুষ্ঠানেও গুটিকয়েক মানুষ উপস্থিত ছিলেন। আরও বিস্ময়কর হলো, জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুও রহস্যময়। তবু এতসব রহস্যের আড়ালে সংগ্রামমুখর জীবনের জন্য, বেঁচে থাকবেন রণক্লান্ত হিসেবে।

বিনয় দত্ত, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

Comments

The Daily Star  | English

Teknaf customs in limbo as 19 mt of rice, authorised by AA, reaches port

The consignment of rice weighing 19 metric tonnes arrived at Teknaf land port on Tuesday evening with the documents sealed and signed by the Arakan Army

7h ago