ক্ষমতা বনাম ভাগ্যের জোর
লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সের অধ্যাপক কীথ ডাউডিং তাত্ত্বিক রাজনীতি লইয়া মাথা ঘামাইতে ভালবাসেন। তিনি সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ডিশটিংগুইশড প্রফেসর। সেইখানে ছাত্র ঠ্যাঙ্গানো তাহার কাজ নহে, যদিও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাহাকে যে সম্মানজনক পদ দিয়াছে তাহার পোশাকি নাম 'অধ্যাপক' বটে। কালের অভিশাপে ছাত্র ঠ্যাঙ্গানোর পাঠশালা হইয়া দাঁড়াইলেও গোড়ায় বিশ্ববিদ্যালয় ছিল জ্ঞান প্রজননের কারখানা: অধ্যাপকবৃন্দ পড়িবেন, গবেষণা করিবেন ও লিখিবেন ; তন্মধ্যে ফুরসৎমত ছাত্রদের সম্মুখে হাজির হইয়া বক্তৃতা দিবেন।
প্রয়াত অর্থনীতিবিদ আবু মাহমুদ ছিলেন এই ঘরানারই শিক্ষক। কিথ ডাউডিং এইরূপ একজন শিক্ষক প্রতীয়মান হয়। তবে তাহার আরেকটি প্রবণতা লক্ষ্য করি তাহা হইল প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব লইয়া টানা-হ্যাঁচড়া করা। এই কাজটিতে তিনি বিশেষভাবে পারঙ্গম।
নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ কেনেথ অ্যারো (১৯২১-২০১৭) তাহা 'ইমপসিবিলিটি' তত্ত্বের জন্য সেই ১৯৫১ সন হইতে বিখ্যাত। ইহা তাহার কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির পিএইচডি অভিসন্দর্ভের মূল ভাষ্য। জটিল গাণিতিক প্রমাণে সিদ্ধ তত্ত্বটির সারকথা হইল গণতান্ত্রিক সমাজে সকল মানুষের বিবিধ পছন্দ-অপছন্দের সমন্বয়ে সমাজের জন্য এমন কোন সামষ্টিক পছন্দক্রম (প্রেফারেন্স প্যাটার্ন) প্রণয়ন করা সম্ভবপর নহে যাহা প্রয়োগ করিলে কাহারও তিলমাত্র ক্ষতি না-হইয়া অন্যান্যদের কল্যাণ সাধন সম্ভব। বলিলে অত্যুক্তি হইবে না যে এই তত্ত্বের খাতিরেই ১৯৭২ সালে মাত্র ৫১ বৎসর বয়সে তিনি নোবেল পুরস্কারের দাবীদার হইতে সক্ষম হইয়াছিলেন। এত অল্প বয়সে আর কাহারো ভাগ্যে নোবেলের শিকা ছিঁড়ে নাই।
অ্যারোর ইমপসিবিলিটি তত্ত্বটি কালানুগ্রহে একটি অবিসংবাদিত তত্ত্বে পরিণত হয়। ১৯৯৭-এ কীথ ডাউডিং কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতির বার্ষিক অধিবেশনে উপস্থাপিত একটি প্রবন্ধে দাবী করিয়া বসিলেন এই বিষয়ে কেনেথ অ্যারো প্রদত্ব গণিতভিত্তিক জটিল তত্ত্ব-প্রমাণের আদৌ প্রয়োজন নাই। তিনি প্রাঞ্জল ভাষায় বুঝাইয়া দিলেন কী করিয়া খানিক তলাইয়া চিন্তা করিলে অনুধাবন করা সম্ভব যে সমাজের বিভিন্নরূপ মানুষের পছন্দ-অপছন্দের ভিত্তিতে সার্বজনীন একটি সামষ্টিক চাহিদা তালিকা প্রণয়ন একটি অসম্ভব প্রকল্প। ইহার জন্য জটিল কি সরল, কোনো রূপ অংক কষিবার আবশ্যকতা নাই।
অশেষ হাততালি পড়িল। সম্মেলন শেষ হইল। কিন্তু এই প্রবন্ধ ছাপিতে ইংরেজিভাষী কোন প্রফেশনাল জর্নাল রাজী হয় না। কীথ ডাউডিং স্বয়ং জর্নাল অব থিয়োরেটিক্যাল পলিটিক্স-এর সম্পাদক এবং কমপক্ষে এক ডজন উঁচু মানের জার্নালের সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য ; তবুও না। সবাই মুচকি হাসিয়া বুঝাইয়া দেয়: "হ্যাঁ, অধ্যাপক ডাউডিংয়ের কথা সত্য মানি তবে তালগাছটা অ্যারো সাহেবেরই থাকুক।" অবশেষে, প্রায় এক যুগ পরে একটি ফরাসী জার্নাল প্রবন্ধটি পত্রস্থ করিতে সম্মত হয়। ফরাসীরা দিলদরাজ এই বিষয়ে সন্দেহ নাই। অ্যা
সম্প্রতি তিনি দুইটি কাজ করিতেছেন : একটি হইল অমর্ত্য সেনের দর্শন-তত্ত্ব-বিশ্বাস লইয়া সুপরিসর আলোচনা ; বিশেষ করিয়া সেন মহাশয়ের 'ক্যাপেবিলিটি ' তত্ত্ব তাহার বিশেষ লক্ষ্যবস্তু। তাহার প্রস্তাব 'ক্যাপেবিলিটি'-র পরিবর্তে 'এবিলিটি' অথবা 'ক্ষমতা' শব্দটি ব্যবহার করিলে বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্তের তারতম্য হইবে না। গ্রন্থটি শীঘ্র প্রকাশিত হইবে আশা করা যায়। আগ্রহী পাঠক নোবেল বিজয়ী এই অর্থনীতিবিদের সামগ্রিক চিন্তা-চেতনার একটি পরিচয়ও এই গ্রন্থে লাভ করিবেন। তবে অমর্ত্য সেন মহাশয় বড়সড় ধাক্কার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করিতে পারেন। তাহার 'ক্যাপেবিলিটি' তত্ত্বের ভিত্তিমূলে কোন গোঁজামিল বা ফাঁক-ফোকর আছে কি-না অধ্যাপক কিথ ডাউডিং তাহার চুলচেরা বিচার না-করিয়া ছাড়িবেন না ─ সন্দেহাতীতভাবে এমত অনুমান করা চলে।
দ্বিতীয় প্রকল্পটি হইল ব্রিটিশ মন্ত্রীরা কেন, তথা কোন পরিস্থিতিতে পদত্যাগ করেন ─ বিশ্লেষণ করিয়া তাহার একটি তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা প্রদান। ডারইউন সাহেব 'ন্যাচরাল সিলেকশান'-এর তত্ত্ব বিক্রি করিয়া পয়সা না কামাইলেও অমরত্ব অর্জন করিয়াছেন। কিথ ডাউডিং তদ্রুপ 'পলিটিক্যাল সিলেকশান' এবং তদসঙ্গে 'ডিসিলেকশান'-এর একটি তত্ত্ব তালাশ করিতেছেন বলিয়া প্রতীয়মান হয়। কালে কালে সমাজে কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ক্ষমতাবান হইয়া ওঠে ('সিলেকশান'), আবার কালক্রমে কিংবা রাতারাতি ঘটে নির্মম ক্ষমতাচ্যূতি ('ডিসিলেকশান')। এই রাজনৈতিক নির্বাচনের একটি গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা উদ্ভাবনই কিথ ডাউডিংয়ের অভীষ্ট।
'ক্ষমতা', বা আরো নির্দ্দিষ্ট করিয়া বলিতে গেলে 'রাজনৈতিক ক্ষমতা', রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কীথ ডাউডিং-এর গবেষণার প্রিয় বিষয়। সুনির্দ্দিষ্টভাবে বলিতে গেলে তাহার মূল প্রশ্ন হইল সমাজে ক্ষমতা ও প্রভাবের উৎস কী। এই বিষয়ে তাহার প্রথম গ্রন্থ র্যাশনাল চয়েসএ- পলিটিক্যাল পাওয়ার প্রকাশিত হয় ১৯৯১ সালে। পরবর্তীতে ওপেন ইউনিভার্সিটি প্রেসের 'কনসেপ্টস ইন সোশ্যাল সায়েন্স' গ্রন্থমালায় পাওয়ার শিরোনামে দ্বিতীয় বইটি লেখেন কীথ ডাউডিং। ২০১৭ তে ম্যানচেষ্টার ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশ করিয়াছে কীথ ডাউডিং প্রণীত "পাওয়ার, লাক এ- ফ্রিডম"। দর্শন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে 'ক্ষমতা' বিষয়ক আলোচনায় অধ্যাপক ডাউডিং কী নতুন মাত্রা যোগ করিয়াছে তাহার উপর কিঞ্চিৎ আলোকপাত করাই অত্র আলোচনার মামুলি উদ্দেশ্য।
২
বিতর্ক আদিগুরু অ্যারিস্তোতল মহাশয়ের আমলে শুরু হইলেও 'ক্ষমতা'র ঘ্রাণ কীসে নির্ভুল শনাক্ত হইবে এই বিষয়ে অদ্যাবধি ঐকমত্য সম্ভব হয় নাই। নানা মুনির নানা মত। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, রাজনীতি-দার্শনিক, ব্যবস্থাপনাবিশারদ, সমাজতত্ত্ববিদ, নৃবিজ্ঞানী, নারীবাদী চিন্তাবিদ, একেক শাখার গুরু একেক দৃষ্টিকোণ হইতে আজো বিষয়টি লইয়া গবেষণা করিয়া যাইতেছেন।
কথায় আছে বাঙ্গালী 'শক্তের ভক্ত নরমের যম'। ইহা বাঙ্গালীর ক্ষমতা বটে ; সে একদিকে শক্তের পদলেহন করিতে পারে, অন্যদিকে সুবিধা দেখিলে দুর্বলের ওপর চড়াও হইয়া বসে। কিন্তু এই দৃষ্টিকোণ হইতে 'ক্ষমতা' বিচার্য নহে। বরং 'বন্দুকের নল নহে, জনগণই ক্ষমতার উৎস', এই তত্ত্ব যিনি আপ্ত করাইয়াছেন তিনি, ভুল হউক আর শুদ্ধ হউক, ক্ষমতার অন্তত: একটি শর্ত নিরূপণ করিয়া দিয়াছেন। তদ্রুপ আমাদের কবি জীবনানন্দ দাশও সুবিনয় মুস্তফীর আশ্চর্য ক্ষমতা'র কথা ভাবিয়া বিস্মিত হইয়াছিলেন :
"সুবিনয় মুস্তফীর কথা মনে পড়ে এই হেমন্তের রাতে।
এক সাথে বেড়াল ও বেড়ালের-মুখে-ধরা ইঁদুর হাসাতে
এমন আশ্চর্য শক্তি ছিল ভূয়োদর্শী যুবার। ..."[সুবিনয় মুস্তফী, মহাপৃথিবী, ১৩৬১]
বিজ্ঞ পাঠক প্রশ্ন উত্থাপন করিতে পারেন 'ক্ষমতা' এবং 'শক্তি' এক কথা হইল কি-না। পদার্থ বিজ্ঞানের পরিভাষায় ইহাদের অর্থভেদ থাকিলেও জীবনানন্দ এই ক্ষেত্রে প্রভেদ করিয়াছেন বলিয়া মনে হয় না। পাঠকের হয়তো স্মরণ আছে: ইংরেজিতে আমারা যাহাকে 'পাওয়ার' বলি, ফরাসী দার্শনিক মিশেল ফুকো মহাশয় সেই অর্থে pouvoir শব্দটি ব্যবহার করিয়াছেন কি-না কিংবা তদপরিবর্তে puissance শব্দটি উপযুক্তর হইত কি-না এই বিষয়ে অদ্যপি তর্ক বহাল আছে। উপস্থিত তাহা প্রাসঙ্গিক নহে। তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কিথ ডাউডিং মহোদয় রাজনৈতিক ধারণাসমূহের সংজ্ঞার্থ নিরূপণে সতর্কতা অবলম্বন প্রয়োজন বলিয়া বিবেচনা করেন। কারণ, তিনি দেখিয়াছেন, সঠিকভাবে সংজ্ঞার্থ নিরূপিত না হইলে অহৈতুক ক্যাচাল ঘনাইয়া উঠে, তাত্ত্বিকদের মধ্যে অনাবশ্যক দ্বন্দের সৃষ্টি হইয়া থাকে। আর যাহা হউক, আপেল আর কমলার তুলনা কোনো কাজের কথা নহে।
বলাবাহুল্য, সুবিনয় মুস্তফীর উপর্যুক্তরূপ 'আশ্চর্য শক্তি' রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কিথ ডাউডিং-এর বিচার্য নহে। তাহার বিষয় হইল সমাজের রাজনীতি এবং রাজনীতি মানেই কিঞ্চিৎ ভাগ-বাটোয়ারার প্রশ্ন। অর্থাৎ কে কী পাইল, কখন পাইল, কী করিয়া পাইল, এই সবই হইল প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। বলিতে হয়, এই সকল লাভ-অলাভের প্রশ্ন বরিশালের কবি জীবনানন্দ দাশের মাথায়ও কিঞ্চিৎ ঘুরপাক খাইয়াছিল। 'লঘু মুহূর্ত' কবিতাটি ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে "নিরুক্ত" পত্রিকায় পৌষ ১৩৪৮ সংখ্যায় মুদ্রিত হইয় ছিল। কবি তাহার "সাতটি তারার তিমির" কাব্যগ্রন্থে ইহা গ্রন্থিত করিয়াছিলেন (প্রকাশকাল ১৯৪৮)। দিনশেষে তিন ভিখিরী ও এক ভিখিরিনীর কবিতাটি শুরু হইয়াছে এই ভাবে: "এখন দিনের শেষে তিনজন আধো আইবুড়ো ভিখিরির অত্যন্ত প্রশান্ত হ'ল মন"।
তাহাদের অভিযোগ: 'ভিখিরিকে একটি পয়সা দিতে ভাসুর ভাদ্র-বৌ সকলে নারাজ।' কিন্তু বেন্টিক্ স্ট্রিটের হাইড্যান্ট হইতে চায়ের মগে জল মিশাইলে তাহাদের আলোচনা এই প্রশ্নে তুঙ্গে উঠিল যে:
কী ক'রে ধর্মের কল নড়ে যায় মিহিন বাতাসে;
মানুষটা ম'রে গেলে যদি তাকে ওষুধের শিশি
কেউ দেয়— বিনি দামে— তবে কার লাভ—
এই নিয়ে চারজনে ক'রে গেল ভীষণ সালিশী।
অসহায় রোগী শেষনিঃশ্বাস ত্যাগের পর তাহাকে মাগনা ঔষধ গছাইয়া দিয়া কাহার কী লাভ ─ এই জটিল প্রশ্নের উত্তর অদ্যাবধি কেহ দিতে পারে নাই।
মহামানবের সাগরতীর ভারতবর্ষের বন্দনা করিতে গিয়া সেই কবে, ১৯১০-এ কবিগুরু কহিয়াছিলেন "দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে"। তাহার পরামর্শ কে বা কাহারা কানে তুলয়াছিল তাহা বলিতে পারিব না;─ কিন্তু সন্দেহ নাই আধুনিক পৃথিবীর ক্ষমতাবিন্যাস অনেকাংশে দেওয়া-থোওয়ার পাকেচক্রে বাঁধা। জীবনানন্দের ভিখিরীরাও এই সব "দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে'র জটিল গণিত লইয়া চিন্তামগ্ন:
নদীর জলের পরে ব'সে যেন, বেন্টিক্ স্ট্রিটে
তাহারা গণনা ক'রে গেল এই পৃথিবীর ন্যায়-অন্যায়;
চুলের এঁটিলি মেরে গুনে গেল অন্যায় ন্যায়;
কোথায় ব্যয়িত হয় ─ কারা করে ব্যয়;
কী কী দেয়াথোয়া হয় ─ কারা কাকে দেয়;─
সুভাষ মুখোপাধ্যায়রা এই কবিতা পড়িয়াছিলেন কিনা কে তাহার সাক্ষ্য দিবে? তবে কে কাহাকে কেন স্বাধীনতা পুরস্কার দিয়াছে এই প্রশ্ন সম্প্রতি জাতিকে চিন্তার মহাসমুদ্রে নিক্ষেপ করিয়াছে।
৩
তবে 'কে লাভবান হইল' এই প্রশ্নের উত্তর হইতে ক্ষমতাধরকে সর্ব্বদাই শনাক্ত করা যাইবে এইরূপ সরল সিদ্ধান্ত প্রমাদের কারণ হইতে পারে কেননা কিথ ডাউডিং লক্ষ্য করিয়াছেন ক্ষমতার জাদুকাঠি নাই এমন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকেও লাভবান হইতে দেখা যায়। তিনি আরো লক্ষ্য করিয়াছেন এইরূপ ক্ষেত্রে সামাজিক আবহাওয়া অনুকূল হওয়া আবশ্যক।
গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় জনগণ ক্ষমতার উৎস হইতে পারে এই অর্থে যে আধুনিক সভ্যতা তাহাকে ভোটাধিকার দিয়াছে যাহা প্রয়োগ করিয়া জনগণ পছন্দমাফিক স্বীয় শাসক নির্বাচন করিতে পারে। পারে, কিন্তু তাই বলিয়া জনগণের সকল সদস্যই ভোট কেন্দ্রে গিয়া ভোট প্রদান করে না। প্রশ্ন উঠিতে পারে, যে-নাগরিক ভোটাধিকার প্রয়োগ করিল না তাহাকে ক্ষমতাবান বলা যাইতে পারে কি-না। আরো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হইল ভোট দিলেই কি তাহাকে সত্যিকার অর্থে ক্ষমতাবান বলা যাইবে? কেননা ফলেন পরিচয়তি। ফলই যদি না ফলিল তবে ক্ষমতার বড়াই করিয়া কী লাভ। মোদ্দাকথা, ক্ষমতার সফল প্রয়োগেই ক্ষমতার প্রকৃত অস্তিত্ব।
'অধিকার' ক্ষমতা কিনা তাহা লইয়া তর্ক করাই যায়। 'অধিকার' থাকা এবং প্রয়োগ করিবার অবারিত সুযোগ থাকিলে 'অধিকার' আর ক্ষমতা সমার্থক গন্য হইতে পারে। এই বিবেচনায় নাগরিকের ভোটাধিকার যে একটি 'ক্ষমতা' তাহা মানিয়া লইতে হয়। কিন্তু ১৫ কোটি মানুষের দেশে একজন মাত্র ভোটারের একটি মাত্র ভোটের ওজন যে তুচ্ছাতিতুচ্ছ তাহাও ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। আমি যাহাকে ভোট দিলাম সে যদি না জিতে তবে আমার ভোট মাঠে মারা যায়। তবে 'ভাগ্যে থাকিলে' আমি যাহাকে ভোট দিব সে জিতিবে, আমার ক্ষমতার প্রমাণ মিলিবে। নৌকামার্কায় ভোট দিয়া যদি একজন ভোটার দেখিতে পায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতা লাভ করিল, তখন সেই ভোটারকে 'সৌভাগ্যবান' বলা যাইতে পারে। অন্যদিকে ধানের শীষে ভোট দিয়া যদি কেহ দেখে যে বিএনপি নামক পার্টিটি সরকার গঠন করিতে পারিয়াছে তখন সেই ভোটারকে 'সৌভাগ্যবান' বলা সঙ্গত হইবে।
সুতরাং দেখা যাইতেছে যে ক্ষমতার সহিত ভাগ্যযোগও আবশ্যক। গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ভাগ্যের এই অনিবার্য ভূমিকার প্রতি কিথ ডাউডিং আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছেন।
জনপ্রিয় ধারণা এই যে বিনা চেষ্টায় মানুষ যাহা অর্জ্জন করিয়া ফেলে কেবল তাহাই ভাগ্যপ্রসূত ; বিপরীতে স্বীয় ,আকাঙ্ক্ষাক্রমে কিছু অর্জ্জনের সামর্থ্যই 'ক্ষমতা'। তবে এই সামর্থ্যের উপাদান কী তাহা প্রশ্নযোগ্য বিষয়। সামাজিক ক্ষমতার নিয়ামক কী-কী তাহার একটি ফিরিস্তি আরেক নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ হরসানয়ি সাহেব প্রদান করিয়াছেন। জন হরসানয়ি'র মতে ক্ষমতাধরের চারিটি সম্পদ থাকিতে হইবে যথা: তথ্য, বৈধতা, অন্যকে 'নি:শর্তভাবে' প্রভাবান্বিত করিবার যোগ্যতা এবং সেই সঙ্গে অন্যকে 'শর্তসাপেক্ষে' প্রভাবান্বিত করিবার সামর্থ্য।
প্রভাব বিস্তার হইল অন্যের সিদ্ধান্তগ্রহণকে নিয়ন্ত্রণ করা। যখন তাহা ভয় দেখাইয়া বা উৎকোচ প্রদান করিয়া কিংবা উভয় পদ্ধতি অবলম্বন করিয়া সাধিত হয় তখন তাহা হইল 'শর্তসাপেক্ষ সামর্থ্য'। অনেক দেশে পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা যথাযথ তদন্তের পরিবর্তে আসামীকে অত্যাচার করিয়া তথ্য সংগ্রহ করে বা স্বীকারোক্তি আদায় করে। আমরা ইহাকে ক্ষমতার অপব্যবহার বলিয়া থাকি।
অন্যদিকে সমাজে এমন অনেক নেতার আবির্ভাব ঘটে যাহাদের ভয়ও দেখাইতে হয় না উৎকোচও প্রদান করিতে হয় না ; অথচ মানুষের পছন্দ-অপছন্দের ওপর তাহারা ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করিতে সক্ষম হন। ইহা একটি বিরল যোগ্যতা বটে।
যাহা হউক, হরসানয়ি বর্ণিত উক্ত চারিটি নিয়ামক ক্ষমতা'র জন্য যথেষ্ট কি-না কিথ ডাউডিং তাহা বিবেচনা করিবার প্রয়াস পাইয়াছেন। তিনি দেখিতে পাইতেছেন, এই চারিটি শর্ত পূরণ হইলেই সফলতা আসিবে এই রূপ আশা করা যায় না। অন্য দিকে এই চারিটি শর্তের কোনোটির ঘাটতি থাকিলেই ব্যর্থতা অপরিহার্য তাহাও বলা যায় না। তিনি 'ভাগ্যগুণের' উদাহরণ দিয়াছেন। তাহার মতে ফলাফলে নিয়ামক কেবল ক্ষমতা নহে, বাস্তবে ভাগ্যও নিয়ামকের ভূমিকা পালন করিয়া থাকে।
একজন রাষ্ট্রনায়ক বা রাজনৈতিক নেতার ক্ষেত্রে জনখ্যাতি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই কিথ ডাউডিং হরসানয়ি'র ফিরিস্তিতে পঞ্চম একটি নিয়ামক যোগ করিয়াছেন যাহা হইল 'জনখ্যাতি' (ইংরেজিতে রেপুটেশান)।
কোনো কোনো দেশে এই রূপ উদাহরণ রহিয়াছে জনসাধারণ ট্র্যাফিক আইন অমান্য করিতে তৎপর। কারণ তাহারা পুলিশকে গ্রাহ্য করে না। পুলিশের স্থলে সেনাবাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করা হইলে চিত্রটি বদলাইয়া যায়। জনসাধারণ ট্র্যাফিক আইন মান্য করিতে তৎপর হইয়া ওঠে। ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণ করিতে পুলিশের ও সেনাবাহিনীর ক্ষমতার মধ্যে কোনো তারতম্য নাই; তারতম্য জনখ্যাতিতে। ঐ সকল দেশের জনসাধারণ মনে করে আইনভঙ্গ করিলে পুলিশের ছাড় পাওয়া যাইবে কিন্তু সেনাবাহিনীর সদস্যরা কোনোরূপ খাতির করিবে না। এইরূপ ধনাত্মক জনখ্যাতির বলেই সেনাবাহিনী ফলপ্রসূ হইয়া থাকে।
প্রশ্ন হইল, 'ভাগ্যে'র সহিত 'জনখ্যাতি'র সম্পর্ক কী। কিথ ডাউডিং 'জনখ্যাতি'-কে সৌভাগ্যের অন্যতম একটি উৎস হিসাবে বিবেচনা করিয়াছেন। এই তত্ত্বের তাৎপর্য এই যে চেষ্টাক্রমে জনখ্যাতি অর্জ্জন করিয়া একজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ক্ষমতার ফল ভোগ করিতে সক্ষম। উপর্যুক্ত 'পলিটিক্যাল সিলেকশান' এবং তদসঙ্গে 'ডিসিলেকশান' এর অন্যতম নিয়ামক হইল জনখ্যাতি। এইরূপ বদ নজীর রহিয়াছে যে কোনো কোনো দেশে রাজনৈতিক শক্তি জনখ্যাতি অর্জনের পরিবর্তে জনসাধারণের ক্ষমতা খর্ব করিবার চেষ্টা করিয়া থাকে। ইহা সংশ্লিষ্ট জাতির দুর্ভাগ্য বটে। এই সব দেশে ভোটাধিকার প্রয়োগ করিয়া ক্ষমতার পালাবদল ঘটানো সম্ভবপর হয় না। অথচ গণতন্ত্রের প্রায়োগিক সংজ্ঞা হইল জনগণের ইচ্ছামাফিক সরকার বদলের সুযোগ।
প্রশাসন বা ব্যবস্থাপনার মৌলিক সমস্যা হইল নিয়ন্ত্রণের সমস্যা বা প্রবলেম অফ কন্ট্রোল। অধীনস্থদের সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করা প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিকে প্রদত্ব ক্ষমতার উপর নির্ভর করে না। একটি প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তি যদি যোগ্য, দক্ষ ও সৎ হিসাবে সুনাম অর্জন করিয়া থাকেন তবেই তাহার পক্ষে অধীনস্থদের সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করিয়া প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভবপর হইয়া উঠে।
একই সূত্রে কিথ ডাউডিং আরো একটি অভিনব ধারণার অবতারণা করিয়াছেন আর তাহা হইল সিস্টেমেটিক লাক বা 'ধারাবাহিক সৌভাগ্য'। ধারণাটি কিছুটা অদ্ভূত প্রতীয়মান হইলেও ইহার স্বাভাবিক অস্তিত্ব পর্যবেক্ষণের ব্যাপার মাত্র। 'ধারাবাহিকভাবে সৌভাগ্যবান' সেই ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিশেষ প্রচেষ্টা না-করিয়াও যাহারা ক্ষমতার ফল ভোগ করিয়া থাকে। অনুকূল বা সহায়ক সামাজিক আবহাওয়ার কারণেই তাহা সম্ভবপর হইয়া থাকে। উদাহরণস্বরূপ কোনো কোনো দেশের আইনসভার নারী সদস্যদের কথা উল্লেখ করা যাইতে পারে। সাধারণ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ না-করিলেও তাহাদিগকে সংসদের সদস্যপদ প্রদান করা হয়; কেননা সমাজ মনে করে সংসদে নারীদের যথেষ্ট প্রতিনিধিত্ব থাকা দরকার অথচ সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে ঐরূপ 'যথেষ্ট' প্রতিনিধিত্ব অর্জ্জন করা সম্ভব নহে। ঐ সব দেশের নারী রাজনীতিকরা তাই ডাউডিং কথিত ধারাবাহিক সৌভাগ্যের অধিকারিণী।
উল্লিখিত গ্রন্থটিগুলিতে অধ্যাপক কিথ ডাউডিং 'ক্ষমতা' সম্পর্কিত তাত্ত্বিক ধারণা ও বিতর্কসমূহের একটি সংক্ষিপ্ত জরীপ উপস্থাপনার সঙ্গে-সঙ্গে 'ক্ষমতা' ও 'ভাগ্যে'র যোগসূত্র নিরূপণ করিয়াছেন। ভাগ্যের উপর এই আলোকপাত সমাজের ক্ষমতা কাঠামোর প্রকৃত চারিত্র্য অনুধাবন করিতে সাহায্য করিবে।
Comments