আরবিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জীবনী

‘হাসিনা: হাকাইক ওয়া আসাতির’ ও ‘শেখ হাসিনা: যে রূপকথা শুধু রূপকথা নয়’ বই দুটি। ছবি: সংগৃহীত

পূর্বে ওমান থেকে শুরু করে পশ্চিমে মরক্কো পর্যন্ত সুবিস্তীর্ণ অঞ্চলে যে আরবি ভাষাভাষীরা রয়েছেন, তাদের জন্য বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উত্থান নিয়ে আরবি ভাষায় রচিত একটি বইয়ের প্রয়োজনীয়তা দীর্ঘদিন ধরে অনুভূত হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

বহু গোত্রে বিভক্ত আরব জাতি নানাবিধ ভৌগোলিক সীমারেখা দিয়ে বিভাজিত হওয়া সত্ত্বেও যে ইসলাম ধর্ম তাদেরকে একসূত্রে গ্রন্থিত রেখেছে তা এতদঞ্চলের অধিকাংশ মানুষের প্রাণের ধর্ম হিসেবে বিবেচিত। এই দেশে মুসলিম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১৪৮ মিলিয়নের কাছাকাছি, যা সুবিস্তীর্ণ আরব অঞ্চলে বসবাসরত আরবি ভাষী মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক।

অধিকন্তু, বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি প্রত্যক্ষ করেছে হিন্দু-মুসলিম বিরোধ ও তার ভিত্তিতে ভারতের বিভাজন। পরবর্তীতে নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে 'মুসলিম' পরিচয়টিও বাঙালিকে পাকিস্তানের আধিপত্যের নিষ্পেষণ থেকে রক্ষা করতে পারেনি। আরবি হরফে লিখিত হয় এই অজুহাতে পাকিস্তানের সংখ্যালঘু জনগণের একটি হিন্দুস্তানি ভাষাকে (উর্দু-হিন্দি ভাষাকে হিন্দুস্তানি ভাষাই বলা হতো) পাকিস্তানের মুসলিম নাগরিকদের অন্যতম প্রধান কথিত ভাষা বাংলার বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিলে এই জাতি তা মেনে নেয়নি। তারা শিরদাঁড়া উঁচু করে বিরুদ্ধাচরণ করলে পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে বাঙালিদের বিরোধ বাধে। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বাঙালি জাতিসত্তার উন্মেষ পর্ব।

'মুসলিম মুসলিম ভাই ভাই' বলে তার আড়ালে বাঙালি জাতিকে অবদমিত করে রাখার যে হীন চক্রান্ত তার মুখোশ পুরোপুরি উন্মোচিত হয় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে এবং পরে সত্তরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বিজয়ী বাঙালি জাতির প্রতিনিধি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাঙালি জাতির পশ্চিম পাকিস্তানি মুসলিম ভাইদের টালবাহানায়। যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠলে ১৯৭১ সালে আরব বিশ্বের সংবাদমাধ্যমে নানা ছলাকলায় বাঙালি জাতিকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় গাদ্দার ও বিশ্বাসঘাতক জাতি হিসেবে।

দীর্ঘ সংগ্রামের পথ-পরিক্রমায় অহিংসপন্থা অবলম্বন করেও বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান আরব বিশ্বে পরিচিতি পান বিদ্রোহী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে। আরব বিশ্বের সামনে তাকে এভাবে উপস্থাপন করাটা ছিল পাকিস্তানের একপ্রকার চক্রান্ত। যার ফলে পরবর্তীতে আরব বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়।

অনেক আগেই আরবদের অবশ্য কর্তব্য ছিল এই বানোয়াট কথা পুনর্বীক্ষণ করা এবং ঘটে যাওয়া প্রকৃত ঘটনার আলোকে আরবদের সামনে তাদেরই মুসলিম ভাই বাঙালিদের ইতিহাসের সত্যকে তুলে ধরা। মিশরীয় সাংবাদিক মোহসেন আল-আরিশি এই গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রকৃত সত্যকে তুলে ধরার প্রয়াসে আরবি ভাষায় ৩০৪ পৃষ্ঠার একটি বই রচনা করেন। বইটির নাম 'হাসিনা: হাকাইক ওয়া আসাতির'। আরবি থেকে বঙ্গানুবাদ করে অনুদিত বইটির নামকরণ করা হয়েছে 'শেখ হাসিনা: যে রূপকথা শুধু রূপকথা নয়'।

বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলিকে মিশরের রূপকথার সঙ্গে তুলনা করেছেন লেখক। এর মাধ্যমে আরবদের ইঙ্গিত করছেন, রূপকথার গল্প তো আপনারা সচরাচর শুনে থাকেন, চলুন রূপকথার গল্পকেও হার মানায় অথচ বাস্তব পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া এমন একটি গল্প শুনি আজ।

লেখক নাটকীয় আবহ তৈরি করে চরিত্রের মনস্তত্ব ব্যাখ্যা করেছেন তার এই বর্ণনায়। এজন্য তিনি কাহিনীর বর্ণনায় গতি এনেছেন। ছায়াছবির মতো অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে পাঠক যেন বিস্ময়াভিভূত হয় সেজন্য ঘটনার আকস্মিকতা ও চমৎকার অকল্পনীয় উপমার সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন।

ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোর মুখে কাল্পনিক সংলাপ তুলে দিয়ে তিনি যেন উপন্যাস রচনা করতে চেয়েছেন। সর্বোপরি, লেখক তার প্রত্যয়কে বর্ণনা করেছেন মিশরীয় রূপকথায় জারিত হয়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার চোখে এমন একজন যিনি তৎকালীন ও পরবর্তীকালে বিশ্বনন্দিত নেতাদের মধ্যে অন্যতম, যিনি এক মিশন নিয়েই এই পৃথিবীতে এসেছিলেন। অধিকার বঞ্চিত এতদঞ্চলের বিপুল সংখ্যক বাঙালিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে কী করে বলিষ্ঠ ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে মোকাবিলা করা যায়। তার আহ্বানে এ দেশের মানুষ মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে, বাঙালিদের অনন্য ভূখণ্ড বাংলাদেশের জন্ম হয়।

লেখকের ভাষায় এই জন্ম সাধারণ জন্ম নয়, পবিত্র উত্থান। পবিত্র উত্থানের মতো এমন অসংখ্য শব্দ, যা মুসলিম সমাজে প্রচলিত, সেগুলো ব্যবহার করে লেখক মুসলিম সমাজের আবহ দিয়ে বাংলাদেশের জন্মসংক্রান্ত ঘটনাবলিকে বিশেষায়িত করেছেন। জীবনের নানাবিধ ঘটনার বর্ণনায় ও চরিত্রের বৈশিষ্ট্য প্রতিষ্ঠায় প্রাসঙ্গিকভাবে পবিত্র কোরানের আয়াত সংযুক্তকরণ এই বইটির আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এই পবিত্র উত্থানের পর বিশ্বাসঘাতক সেনা অফিসারদের বুলেটের আঘাতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন। এমন একটি ঘটনার বর্ণনায় তিনি গ্রিক পুরাণের কাহিনীতে ভাগ্যের যেমন হাত তেমন হাত উক্ত ঘটনায় আছে বলে উল্লেখ করেন। গ্রিক বিয়োগান্তক নাটকের মতোই দেখেন তিনি ওই ঘটনাকে। ভাগ্যক্রমে তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেঁচে যান। এখানে এসে তিনি আত্মার অবস্থান্তরপ্রাপ্তির কথা বলেন। তার মতে পিতার আত্মা কন্যার শরীরে প্রবেশ করে। কারণ, যে মিশন নিয়ে পিতা এই পৃথিবীতে এসেছিলেন তা সমাপ্ত করার দায় তো কন্যার।

ইসলাম ধর্মের ওয়ারিসি সূত্রকে তিনি এর সঙ্গে বর্ণনায় নিয়ে এসেছেন। সবচেয়ে বড় কথা, কন্যা পিতার অসমাপ্ত কাজ শেষ করবে, এমনটা যেন ইসলামি সমাজ ভাবতেই পারে না। লেখক এখানে যুক্তি দিয়েছেন— না, কন্যারা ধীরস্থির মেধাসম্পন্ন এবং ইতিহাসের নানা ঘটনা বলে, কন্যারা কিংবা নারীরা পুরুষদের চাইতেও সিদ্ধান্ত গ্রহণে ও কার্যসাধনে পটু। স্বামী-পিতা-পুত্র যখন বিপদাক্রান্ত তখন নারীরাই তাদের উদ্ধার করে।

উদাহরণস্বরূপ, তিনি মিশরীয় রূপকথার ওসিরিস পুরাণের প্রসঙ্গ টেনেছেন এবং তুলনা করে দেখিয়েছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নানা পর্যায়ে পুরুষের বিপদে নারীর এগিয়ে আসা কীভাবে প্রাচীন পুরাণের কাহিনীকে ছাড়িয়ে গেছে। আর, এসব ক্ষেত্রে নারীদের নেতৃত্ব দিয়েছেন পিতার জীবিতাবস্থায় তার ছত্রছায়ায় থেকে ও পিতার অনুপস্থিতিতে তারই নির্দেশিত পথে চলে পিতার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা।

বইটির অধিকাংশ বর্ণনায় বঙ্গবন্ধু নিজেই প্রধান, উজ্জ্বল-উদ্ভাসিত। তার অসমাপ্ত কাজ তিনি জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনাকে দিয়ে যাবেন এমনটা গ্রন্থের শুরু থেকেই ইঙ্গিতে বর্ণিত। প্রকৃতপক্ষে, পিতার পরম্পরা কন্যার ওপর যে বর্তায়, কন্যার অবস্থান পৃথিবীর অন্য দেশের তুলনায় বঙ্গদেশে যে সুমহান— সেটাই লেখক বলতে চেয়েছেন।

তার জন্ম থেকে বর্ণনা শুরু হয়ে ১৯৯৬ সালের ক্ষমতায় আরোহণ পর্যন্ত ঘটনাবলি একজন ভিনদেশির চোখে অবাক বিস্ময়ে অবলোকিত হয়েছে। তার কাছে মনে হয়েছে– আমি বাস্তব দেখছি না, মিশরীয় রূপকথার চাইতে উচ্চস্তরের রূপকথা দেখছি। বিস্ময়ের ঘোরের মধ্যে লেখক এ দেশের ইতিহাসে ভ্রমণ করেছেন এবং এই গ্রন্থ রচনা করেছেন। অন্যদিকে ব্যাজস্তুতির দ্যোতনাও এতে আছে, যে ব্যাজস্তুতি ইতিহাসের কাছ থেকেই মানুষের শেখা।

ইসফানদিয়র আরিওন: বহুভাষিক, অনুবাদক এবং বাংলা একাডেমির অনুবাদ, পাঠ্যপুস্তক ও আন্তর্জাতিক সংযোগ বিভাগের সহপরিচালক

Comments

The Daily Star  | English

People will have to take to the streets for voting rights: Fakhrul

People will have to take to the streets like they did on August 5 to realise their voting rights, said BNP Secretary General Mirza Fakhrul Islam Alamgir today

43m ago