‘আত্মহত্যা করতে চাই’ সংবাদে আমি বিব্রত: আহমদ রফিক

আহমদ রফিক। ছবি: প্রথম আলোর সৌজন্যে

বিশিষ্ট ভাষা সংগ্রামী, খ্যাতিমান রবীন্দ্র গবেষক ও প্রাবন্ধিক আহমদ রফিক কাজের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদকসহ পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। এ ছাড়া কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট তাকে 'রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য' উপাধিতে ভূষিত করেছে।

১৯২৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার শাহবাজপুরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। মাত্র দেড় বছর বয়সে তিনি মেঘনায় নৌকাডুবিতে বাবাকে হারান।

আহমদ রফিক একজন চিকিৎসক। রাজধানীতে থাকেন একাকী। দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ তিনি। তার অসুস্থতা, ব্যক্তিগত বিশ্বাস-অবিশ্বাস নিয়ে কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে।

আহমদ রফিক। ছবি: প্রথম আলোর সৌজন্যে

দ্য ডেইলি স্টার: এখন কেমন আছেন?

আহমদ রফিক: আগের চেয়ে ভালো আছি। তবে, আজকাল শরীর নিয়ে ভালো বোধ করি না। এর মধ্যে ফেসবুকে ভুল একটি তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। আমি নাকি আত্মহত্যা করতে চাই। এমন সংবাদে আমি খুব বিব্রত।

ডেইলি স্টার: এমন খবর কীভাবে ছড়ালো?

আহমদ রফিক: আমার পরিবারের সবাই ৮০ বছরের মধ্যেই মারা গেছেন। আমি ও আমার স্ত্রী নিঃসন্তান। আমার স্ত্রী ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রফেসর। আমাদের যে সঞ্চয় ছিল তা দিয়ে অনেক শিক্ষার্থীকে সাহায্য করেছি। ২০১২ সালের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্র গবেষণা ফান্ডে ৫ লাখ করে ১০ লাখ টাকা দিয়েছি।

এভাবে যদি টাকাগুলো খরচ না করতাম তাহলে আজকে এই কথা আসত না যে অর্থাভাবে আত্মহত্যা করতে যাচ্ছি।

অনেকদিন আগে আমি কলকাতার একটা বই পড়েছিলাম। উপন্যাসটির নাম মনে নেই। তাতে স্বেচ্ছায় মৃত্যু নিয়ে একটা ঘটনা পড়েছিলাম। আমি যেহেতু ডাক্তার, তাই জানি মেডিকেল ইথিকস এবং বিশ্বের গবেষণা কেন্দ্রে টার্মিনাল ক্যান্সার রোগীদের যন্ত্রণা কতটা ভয়ঙ্কর। সেই যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে অনেকে জীবন থেকে মুক্তি নিতে আত্মহত্যা করেন। এর নৈতিকতা নিয়ে বিশ্বে অনেক আলোচনা হয়েছে।

বর্তমানে কঠিন সময়ে রোগীকে সিসিইউ বা আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। যখন বোঝা যায় লাইফ সাপোর্ট দিয়ে কোনো উপকার হবে না এবং সেখানে খরচ অনেক, তখন পরিবারও চায় সেটা খুলে নেওয়া হোক। কিন্তু ব্যবসার জন্য লাইফ সাপোর্ট কন্টিনিউ করে অনেক হাসপাতাল। যখন পরিষ্কার বোঝা যায় কাজ হবে না, সে সময় পরিবার যদি চায়ও নিঃস্ব হওয়ার আগেই লাইফ সাপোর্ট খুলে নেওয়া হোক, তবুও তারা খোলে না। এ বিষয়ে পরিবারের অধিকার থাকা উচিত বা আইন থাকা উচিত।

অনেক বুদ্ধিজীবী মনে করেন, জীবনযাপন অনেক হয়েছে। বয়স ৮০ বা ৮৫ পার হয়ে গেছে, জীবনের ভার আর বহন করতে পারছি না। এই অবস্থা থেকে মুক্তি দরকার। এ রকম কেউ ভাবলে তার অধিকার কতটা? এ বিষয়টি আইনে থাকা উচিত, নাকি উচিত না তা নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা প্রয়োজন। এই আলোচনা কমতে কমতে বন্ধ হয়ে গেছে।

মেডিকেল ইথিকস নিয়ে যারা পড়ালেখা করেন, কথাবার্তা বলেন তারাও এগুলো নিয়ে আর অগ্রসর হননি। বাংলাদেশে এটা নিয়ে কোনো আলোচনাই হয় না। বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা জরুরি। প্রসঙ্গত আমি উদাহরণের দিয়ে সাক্ষাৎকারে যখন আমার নিজের জীবনের কথা বলি, তখন নিজের জীবনের ভালোলাগা-ভালোবাসা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, আশা-হতাশা নিয়ে বলেছি। এটা নিয়ে লিখতে ও পড়তে গুলিয়ে ফেলেছেন অনেকে। এ নিয়ে ফেসবুকে লিখেছে, আমি নাকি অর্থাভাবে আত্মহত্যা করতে চাচ্ছি।

ডেইলি স্টার: এমন ইচ্ছে হয় কখনো?

আহমদ রফিক: না, আমি তেমন কোনো ইচ্ছা পোষণ করি না। যেকোনো যন্ত্র ক্ষয় হয়, একসময় আর চলে না। তেমনি মানুষের জীবনের অঙ্গগুলো। ব্যবহারে ক্ষয় হয়, সেই ক্ষয় হওয়ার ফলে নানা সমস্যা দেখা দেয়। যেমন আমার শরীরের বিভিন্ন ভাইটাল অর্গানে সমস্যা হচ্ছে। চোখের কথা বলতে গেলে, আমি এখন চোখে দেখি না। বিভিন্ন ডাক্তারের কাছে গেছি। কিন্তু কিছু করার নেই সেটা আমিও বুঝি। তাই সেটা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।

ডেইলি স্টার: আপনার স্ত্রী কতো সালে মারা গেছেন?

আহমদ রফিক: ২০০৬ সালে। উত্তরায় নিজের বাসায় থাকি। তার শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। সেদিন আমি তার পাশে বসা, বাসায় আত্মীয়-স্বজনরাও ছিলেন। তিনি চলে গেলেন।

ডেইলি স্টার: রবীন্দ্র গবেষণা ট্রাস্ট ফান্ড কীভাবে ব্যবহার হয়?

আহমদ রফিক: শিক্ষার্থীরা এই ফান্ড থেকে টাকা পায়। রবীন্দ্রনাথের উপর যারা পিএইচডি করছে তাদেরকে ৫০ হাজার টাকা সাহায্য দেওয়া হয়। অনেক পেয়েছে। এর জন্য একটা কমিটি আছে। আমি কমিটির প্রধান। আগে নির্দিষ্ট ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ, পরে ইংরেজি বিভাগ নিয়ে সম্প্রসারণ করা হয়েছে।

ডেইলি স্টার: রবীন্দ্রনাথ নিয়ে তো অনেক কাজ করেছেন।

আহমদ রফিক: হ্যাঁ, অনেক কাজ করেছি। এরমধ্যে রয়েছে 'রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রচিন্তা ও বাংলাদেশ প্রসঙ্গ', 'রহুমাত্রিক রবীন্দ্রনাথ', 'রবীন্দ্রভাবনায় গ্রাম: কৃষি ও কৃষক'। বিশ্বজিৎ ঘোষ বরাবর বলেন, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ মিলে রবীন্দ্রনাথের ওপর আমার কাজ উল্লেখযোগ্য। তিনি আমার রবীন্দ্রনাথ চর্চা কেন্দ্রের একজন প্রধান সদস্য ছিলেন। সঙ্গে ছিলেন রফিকুল্লাহ খান, সৈয়দ মনজরুল ইসলাম, ভীষ্মদেব চৌধুরী ও সৈয়দ আজিজুল হক।

ডেইলি স্টার: রাজনৈতিক কারণে ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন, নাকি সমাজ ও সংস্কৃতির দায়িত্ববোধ থেকে?

আহমদ রফিক: ৫২'র ভাষা আন্দোলনে দুটি বিষয়েরই সমন্বয় হয়েছে। কমিউনিস্ট, জাতীয়তাবাদী, ইসলামপন্থী—সবাই একই ছাতার নিচে চলে এসেছিল। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর স্বতঃস্ফূর্ততা। সাধারণ শিক্ষার্থীরাই ছিল সে সময়ের নায়ক, রাজনৈতিক বা যুব ছাত্রনেতারা নন। সবাই নিজ নিজ প্রেরণায় আন্দোলনে একত্রিত হতো। মোটকথা সমাবেশ পরিচালনায় জন্য কোনো নেতা ছিলেন না।

ডেইলি স্টার: কেউ বলে ভাষা সংগ্রামী, কেউ বলে ভাষা সৈনিক। কোনটা সঠিক?

আহমদ রফিক: প্রথমদিকে ভাষা সৈনিকই বলা হতো। ভাষা সৈনিক বললে, ভাষার দীর্ঘকালের যে সংগ্রাম এখনও চলছে তা বুঝায়। শহীদ দিবস পালনও তো একটা সংগ্রামের অংশ। এক্ষেত্রে ভাষা সংগ্রামী শব্দটা অনেক বেশি ব্যঞ্জন ধর্মী। বাংলা একাডেমি আমার এই প্রস্তাবটা গ্রহণ করেছে। তারা ভাষা সংগ্রামী লেখে, ভাষা সৈনিক নয়।

ডেইলি স্টার: আপনার পড়াশোনা চিকিৎসা বিষয়ে। সাহিত্যিক ও রবীন্দ্র গবেষক হয়ে উঠলেন কীভাবে?

আহমদ রফিক: ছাত্রাবস্থায় আমার স্বপ্ন ছিল ২টি। প্রথমত একটি উচ্চমান সম্পন্ন সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করা। আর দ্বিতীয়টি হলো, একটি ওষুধ তৈরির কারখানা করা। কারণ, আমি লক্ষ্য করেছিলাম ওষুধ তৈরির যত প্রতিষ্ঠান সব অবাঙালিদের হাতে ছিল। বাঙালিদের হাতে কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না। ৭ জন মিলে প্রতিষ্ঠা করলাম ওরিয়ন ল্যাবরেটরি।

আর ষাটের দশকে 'নাগরিক' নামে একটি পত্রিকা বের করি। এটি সম্পাদনা করতে করতে পড়াশোনা, রবীন্দ্রনাথ চর্চা, চিত্রকলা, নৃতত্ত্বসহ বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখি করেই চলছি আজ পর্যন্ত।

ডেইলি স্টার: বাংলাদেশ নিয়ে আপনার স্বপ্ন কী?

আহমদ রফিক: অনেক স্বপ্ন দেখেছি আমি। তবে পঞ্চাশের দশকে সমাজ-রাষ্ট্র পরিবর্তনের যে স্বপ্ন দেখেছিলাম, তিক্ত হলেও সত্য যে, আজও তা সোনার হরিণই রয়ে গেল।

ডেইলি স্টার: জীবন নিয়ে অনুভূতি কী?

আহমদ রফিক: আমি ভাবিনি ৯০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকব। আমার টাকাগুলো খরচ করেছি বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের জন্য। যদি মনে করতাম এতদিন বাঁচবো, এগুলো হয়তো আমি করতাম না। কারো সাহায্য করা দরকার হলে পরে করা যেতো।

আমি সারাজীবনই সম্পত্তির প্রতি অনাসক্ত। অনাসক্তির কারণে অঘটন ঘটবে তা কখনও ভাবিনি। পড়ে গিয়ে আমার কোমরে ফ্র্যাকচার হবে, এতো বড় অপারেশন হবে—এই ঝামেলাগুলো আমার চিন্তায় ছিল না। আত্মীয়স্বজনকে সবসময় সতর্ক থাকতে বলি। অথচ, নিজে সর্তকতা থাকার পরও ওষুধ খাওয়ার কারণে তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় মধ্যরাতে বাথরুমে পড়ে যাই। তাতে জয়েন্টে ফ্র্যাকচার হয়। এটাকে রিপ্লেস করা হলো।

জীবন বড় বিচিত্র। ভালো-মন্দ, আশা-হতাশা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি—সব নিয়েই মানুষের জীবন। তবু মানুষ বেঁচে থাকে পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধের আকর্ষণে। জীবনে প্রাপ্তির সঙ্গে অপ্রাপ্তি তো কম নয়। এই যে ভাষা আন্দোলন করলাম, উচ্চশিক্ষা ও উচ্চ আদালতে বাংলা প্রচলনের জন্য সকাল-সন্ধ্যা স্লোগান দিলাম রাজপথে, কোথায় তা!

বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে একটা চমৎকার সংবিধান উপহার দিলেন। একটা সেকুলার কনস্টিটিউশন। সেই কনস্টিটিউশনকে দুই জেনারেল মিলে নষ্ট করে দিলো। তাদের একজন জিয়াউর রহমান আর একজন হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ।

Comments

The Daily Star  | English

Admin getting even heavier at the top

After the interim government took over, the number of officials in the upper echelon of the civil administration has become over three times the posts.

8h ago