‘মা বলতেন, যদি মরতেই হয় তবে বীরের মতো মরবে’
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অন্যতম স্মরণীয় ও দুর্ধর্ষ যুদ্ধ সিলেটের কানাইঘাট যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে সিলেটের একাংশ জুড়ে কানাইঘাট। ৪ নম্বর সেক্টরের অধীনে এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ৪ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা। এই যুদ্ধের অংশ নিয়েছিলেন মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক।
মুক্তিযুদ্ধের আগে ওয়াকার হাসান ছিলেন রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ও তার মামা ঢাকা থেকে পায়ে হেঁটে ও লঞ্চে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পৌঁছে ৯ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ওয়াকার হাসান অংশ নিয়েছিলেন বিখ্যাত কানাইঘাট যুদ্ধে। যে যুদ্ধে অসীম বীরত্ব দেখিয়েছিলেন তিনি ও তার প্লাটুন।
এ ছাড়া, তিনি অংশ নিয়েছিলেন হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়ায় চা বাগানের দুর্ধর্ষ এক অ্যামবুশে। দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ওয়াকার হাসান বর্ণনা দিয়েছেন দুঃসাহসিক কানাইঘাট যুদ্ধ ও তেলিয়াপাড়া চা বাগানের বিখ্যাত সেই অ্যামবুশের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আহমাদ ইশতিয়াক।
আপনি ছিলেন প্রথম ওয়ারকোর্সের প্রশিক্ষণার্থী। তারও আগে যুদ্ধ করেছেন হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়ায়। কানাইঘাটে এলেন কীভাবে?
ওয়াকার হাসান: আমার মা ছিলেন টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অধ্যাপক। ২৬ মার্চ সকালে ঢাকার ভয়াবহ অবস্থা দেখার পর বাসায় ফেরার পথে আমার মা আমাকে বলেন তোমাদের মতো যারা তরুণ তাদের কী করা উচিত? তখন আমি বললাম আমরা প্রতিশোধ নেবো। তিনি বললেন, 'আমি তো তোমার কাছে এটাই শুনতে চাচ্ছি। প্রতিশোধ নিতে হলে তোমাকে যুদ্ধ করতে হবে। আর যুদ্ধটা ফ্যান্টাসি না। তুমি তোমার মস্তিষ্কে ধরে রাখো—'আমি যুদ্ধ করবো। সবচেয়ে বড় হলো তোমাদের সাহস।'
তখন আমি সায় দিতেই মা বললেন, 'আমার ৩টা কথা তুমি মনে রেখো। যদি যুদ্ধে যাও তবে বীরের মতো যুদ্ধ করবে। যদি তোমাকে মরতেই হয় তবে বীরের মতো মরবে। বুলেটটা যেন তোমার পেছনে না লাগে। আর যদি যুদ্ধ শেষে ফিরে আসতে হয়, তবে বীরের মতো ফিরে এসো।'
আমার মামা ছিলেন পাকিস্তান নৌবাহিনীতে। তার নাম সোলায়মান। তিনি ও আমি হেঁটে হেঁটে ঢাকা থেকে বের হয়ে গেলাম। গুলিস্তান হয়ে কাঁচপুরে নদী পার হয়ে চলে গেলাম নরসিংদী। ওখান থেকে লঞ্চে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসে পৌঁছালাম ৯ এপ্রিল। ওখানে একটা কমিউনিটি সেন্টারে রিক্রুট হচ্ছিল। ওখানে যোগ দিলাম। তবে আমরা আলাদা হয়ে গেলাম। কারণ তখন ৩ ভাগ করা হচ্ছে সবাইকে।
মামা যেহেতু আগেই নৌবাহিনীতে ছিলেন তিনি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তাই তিনি একভাগে, একভাগে আমার মতো ছাত্ররা আর বাকিরা অন্যভাগে। তারপর আমাদের মোট ৩০ জনকে একটি বাসে উঠিয়ে তেলিয়াপাড়ায় পাঠানো হলো।
তেলিয়াপাড়া পৌঁছে বাস থেকে নেমে দেখি বহু সেনা। জিজ্ঞেস করলাম এরা কারা। বললো সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। আমাকে কোথায় পড়ো জিজ্ঞেস করতেই আমি বললাম। তারপর বললো এদিকে এসো। তখনো সেক্টর গঠন হয়নি। এটি ছিল ওয়্যারজোন। এটি ছিল মেজর শফিউল্লাহর নেতৃত্বে। শফিউল্লাহ সাহেব আমাদের সাথে কথা বললেন।
আমার মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ডেকে বললেন, তোমরা তো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ো। তোমাদের এতো ট্রেনিং লাগবে না। তোমরা খুব সহজেই কৌশল রপ্ত করতে পারবে। আর যুদ্ধ হলো একটা আর্ট। তারপর আমাকে ১০ জনের একটা সেকশন দেওয়া হলো। ৪ দিনের ট্রেনিং দেওয়া হলো আমাদের। ৪ দিন পরে আমাকে একটা প্লাটুনের দায়িত্ব দেওয়া হলো।
ওখানেই প্রথমে আমরা যুদ্ধ করলাম। যুদ্ধের আগে মেজর শফিউল্লাহ এলেন। বললেন, 'আমাদের এখানে আমাদের তেমন কোনো কার্যক্রম নেই। লোকজন যেন বুঝতে পারে এরকম একটি আক্রমণ করা যাক। কী করা যায়?' তখন লেফটেন্যান্ট হেলাল মোর্শেদকে মেজর শফিউল্লাহ বললেন, 'তোমরা একটা পরিকল্পনা করো না কেন অ্যামবুশের?'
তখন হেলাল মোর্শেদ আমার মতো ৫ জন ছাত্রকে দিয়ে ৫টি দল তৈরি করলেন। এটি এপ্রিল মাসের ২১/২২ তারিখের কথা। তারপর আমরা রেকিতে বের হলাম। কোন জায়গায় অ্যামবুশ করলে আমরা বড় ধরনের আঘাত করতে পারবো।
আমরা একটা পাহাড়ি রাস্তা দেখে ঠিক করলাম। রাস্তাটা এমন ডান পাশ দিয়ে গেলে বামপাশ সরাসরি দেখা যায় না। কিন্তু আমরা যারা পজিশনে থাকবো আমরা তাদের দেখবো। আমরা যখন রেকি করতাম দেখতাম ঠিক সকাল ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে পাকিস্তানিদের ৪-৫টা ট্রাক সিলেট থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে যায়।
বেশ কয়েকদিন যাবত আমরা রেকি করতে গিয়ে আড়াল থেকে দেখলাম। তখন আমরা নিশ্চিত হলাম এটি প্রতিদিনই যাচ্ছে। তারপর ঠিক হলো কোথায় আমরা অ্যান্টি পার্সোনাল মাইন পাতবো। ওরা মাইনে এসে পড়লে আমরা অতর্কিত হামলা করবো।
এটি কি তেলিয়াপাড়া চা বাগানের পাশে বিখ্যাত সেই অ্যামবুশ?
ওয়াকার হাসান: হ্যাঁ ওটাই। তো যেদিন আমরা অপারেশন করবো সেদিন ভোরবেলা আমরা অ্যামবুশের জন্য পজিশন নিয়ে নিলাম। আমাদের অবস্থান ছিল রাস্তা থেকে ১০ ফুট উপরে। পাহাড়ি রাস্তা বলে তারা জোরে চালাতে পারে না গাড়ি।
সেদিন ৯-১০ টার মধ্যে তারা এলো না। আমরা ভাবলাম কি হলো আজ এলো না আজকেই আমরা পরিকল্পনা করলাম অথচ আজকেই এলো না। আমাদের পরিকল্পনার কথা কি জেনে গেল নাকি! কারণ তাদের সবদিকেই গুপ্তচর থাকে।
ঠিক তখন অবজারভেশন পোস্টে থাকা আমাদের দুজন সংকেত দিলো ওরা আসছে। কারণ পাহাড়ের কারণে আমরা দেখতে পাচ্ছি না। তাই তাদের সামনে আরেক পাহাড়ে রাখা হয়েছে যেন তারা দেখতে পায়। ঘড়িতে তখন সময় বেলা ১১টা।
ওরা বললো ৫টা ট্রাক আর একটা জিপ আসছে। আমাদের সিদ্ধান্ত হয়েছিল মাইনটার উপর দিয়ে যাওয়ার সময় মাইন বিস্ফোরণ হলে লেফটেন্যান্ট হেলাল মোর্শেদ প্রথমেই ফায়ার শুরু করবেন। তারপর আমরা শুরু করবো।
মাইনের ওপর দিয়ে জিপটা চলে গেল। জিপের মধ্যে একজন অফিসার। আমরা দেখতে পাচ্ছি। আমরা তখনো ফায়ার করলাম না। কারণ তখনো মাইনটা বিস্ফোরিত হয়নি।
এরপর একটা এক টনের ট্রাকও চলে গেল। চাকাটা মাইনের উপর পড়লো না। তারপর এলো বড় একটি ট্রাক। ওই ট্রাকে ৩০-৪০ জন পাকিস্তানি সেনা ছিল। বাজ পড়ার শব্দের মতো বিকট শব্দে একটি মাইন বিস্ফোরিত হলো।
ঠিক একই সময় আরো ২টা মাইন বিস্ফোরিত হলো। আমরা দেখলাম ট্রাকটা ১০-১৫ ফিট উপরে উড়ে গেছে। আমার মনে হয় না এই ট্রাকে কেউ বাঁচতে পেরেছে।
এরপর পেছনে ছিল একটা বাস। ওখানে পাকিস্তানি সৈন্যরা। তখনই আমাদের ২ পাশ থেকে প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ শুরু হলো। এর পেছনে আরেকটি ট্রাক ছিল আমরা সবাই সেটার উপরও প্রবল গুলিবর্ষণ শুরু করলাম। বাসটাও মাইনের উপর গিয়ে পড়লো। সৈন্যরা কেউ কেউ লাফিয়ে পড়লো।
আমাদের লক্ষ্য ছিল ৫-৭ মিনিট আমরা আক্রমণ করবো। কিন্তু অ্যামবুশের সাফল্য দেখে আমরা ভুলেই গেছি আমাদের ফেরত যেতে হবে। এরপর দেখলাম পেছন দিক থেকে আরও ২টি ট্রাক আমাদের দেখে পেছনের দিকে ঢুকে গেল। আমরা বুঝতে পারলাম ওরা আমাদের পিছন দিক থেকে ধরবে। তখন লেফটেন্যান্ট হেলাল মোর্শেদ নির্দেশ দিলেন, এবার পিছু হটো।
তখন আমরা যে যেদিক থেকে পারি তেলিয়াপাড়া ক্যাম্পের দিকে ফিরে গেলাম। কেবল অবজারভেশন পোস্টে থাকা ওই ২ জন রাস্তা না পেয়ে গ্রামের দিকে চলে গেল। ২ দিন পরে তারা এলো। কী পরিমাণ ওদের হতাহত হয়েছে আমরা জানি না।
আসার পরে মেজর শফিউল্লাহ আমাদের জিজ্ঞেস করলেন কতজন হতাহত হয়েছে? তখন আমরা বললাম যথেষ্ট হয়েছে। আমাদের ধারণা ছিল প্রায় সবই মারা গেছে।
ওই অ্যামবুশে পাকিস্তানিদের কতজন হতাহত হয়েছিল?
ওয়াকার হাসান: তখনো পুরোপুরি জানি না। ঘটনার ৩/৪দিন পরে চা বাগান খুললে ফিরে এলো কুলিরা। তখন কুলিদের কাছে মেজর শফিউল্লাহ জিজ্ঞেস করেছিলেন কী পরিমাণ মারা গেল ওরা।
কুলিরা বললো, স্যার আমাদেরকে চা বাগান থেকে ধরলো পাকিস্তানিরা। ধরে তারা বললো লাশগুলো ট্রাকে তুলতে। আমরা একটি ট্রাকে লাশ তুললাম, আহতদের আরেকটি ট্রাকে নিলো। আমরা গুণে গুণে ৫৪টা লাশ তুলেছি। আমাদের ধারণা ৭০-৮০ জন তাদের এই অ্যামবুশে আহত হয়েছে।
এরপর পাকিস্তানি বাহিনী তেলিয়াপাড়ায় ঘোরতর আক্রমণ চালালো। প্রতিদিনই পাকিস্তানিরা হামলা চালাতে লাগলো। একটা পর্যায়ে আমরা তেলিয়াপাড়া আর দখলে রাখতে পারিনি। আমরা ভারতে চলে গেলাম। ভারতের শিমলায় তখন মেজর শফিউল্লাহ আমাকে ৫ নম্বর কোম্পানি কমান্ডার করলেন।
মূর্তিতে বাংলাদেশ ওয়্যার কোর্সে কীভাবে নির্বাচিত হলেন?
ওয়াকার হাসান: মূর্তিতে আমরা আরও কিছুদিন পরে গেলাম। এর মধ্যে আমরা ছোটখাটো যুদ্ধ করেছি। জুন মাস চলে এলো। তখন মুজিবনগর সরকার চিন্তাভাবনা করলো। কারণ যুদ্ধ কতদিন চলবে কেউ বলতে পারে না।
মিলিটারি অফিসার দরকার যারা কমান্ড দেবে মুক্তিযোদ্ধাদের। তখন মেজর শফিউল্লাহ আমাকে ডেকে পাঠালেন। এই সেক্টরে সিলেক্টেড করা হবে ২৫ জনের মতো।
মেজর শফিউল্লাহ আমাকে বললেন, তুমি যেও না। শেষে আমাকে সিলেক্ট করলেন। মোট ২৪ জন সিলেক্ট হয়েছিলাম আমরা। মোট ৬১ জন প্রথম ওয়্যারকোর্সের জন্য নির্বাচন করা হলো। আমাদের পাঠানো হলো ভুটান সীমান্তবর্তী ভারতের জলপাইগুড়ির মূর্তিতে। ওখানে ট্রেনিং চললো আমাদের।
প্রথম ইস্ট বেঙ্গলে কীভাবে এলেন এরপর? আপনি দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলে ছিলেন।
ওয়াকার হাসান: মূর্তিতেই ঠিক হলো কে কোন রেজিমেন্টে যাবে। আমি প্রথম ইস্ট বেঙ্গলে গেলাম সঙ্গে আমার কোর্সমেট লেফটেন্যান্ট আনিস। প্রথমে মেজর শফিউল্লাহ আমাকে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল থেকে ছাড়তে রাজি ছিলেন না। বললেন ও তো আমার রেজিমেন্টে ছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত আমাকে ছাড়তে হলো।
আমাদের প্রথম ইস্ট বেঙ্গলে কমান্ডিং অফিসার ছিলেন দুর্ধর্ষ কমান্ডার মেজর জিয়াউদ্দিন। তার আসলে কোন ব্যাখ্যা বা তুলনা হয় না। আমাদের সব কোম্পানিতেই তখন পাকিস্তানি কমিশনড পাওয়া। ক্যাপ্টেন হাফিজউদ্দিন একটি কোম্পানির কমান্ডার।
আলফা কোম্পানির ক্যাপ্টেন মাহবুব, চার্লি কোম্পানির কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কাইয়ুম, ডেল্টা কোম্পানিতে ক্যাপ্টেন পাটোয়ারি। যেহেতু সবগুলো কোম্পানি করা আছে তাই আমাদের তো আর কোম্পানি কমান্ডার করার সুযোগ নেই তাই আমাকে ও আনিসকে একটা করে প্লাটুনের দায়িত্ব দেওয়া হলো।
আমি হলাম ডেল্টা কোম্পানিতে একটি প্লাটুনের কমান্ডার। আর আনিসকে দেওয়া হলো আলফা কোম্পানিতে একটা প্লাটুন। তখন আমরা নিয়মিত যুদ্ধ শুরু করলাম। একেরপর এক অ্যামবুশ করলাম।
এ সময় আমরা শ্রীমঙ্গলে গিয়ে একটা দারুণ অপারেশন করলাম। এভাবে যুদ্ধ চলতে চলতে নভেম্বর মাস চলে আসলো। তখন বলা হলো এখন থেকে কনভেশনাল যুদ্ধের জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তৈরি। আর গেরিলা যুদ্ধ নয়, এখন হবে সম্মুখ যুদ্ধ।
তখন কি আপনারা ভারতে নাকি বাংলাদেশে?
ওয়াকার হাসান: তখন আমরা ভারতে। আমরা থাকতাম আম্বাশা পাহাড়ে। ওখান থেকে বাংলাদেশে ঢুকে ঢুকে অপারেশন করতাম তারপর আবার ফিরে যেতাম। ১৯ নভেম্বর আম্বাশা পাহাড় থেকে রওয়ানা দিয়ে শিলংয়ের জালালপুর নামের একটা জায়গায় আমরা চলে এলাম পরদিন।
একবারেই সীমান্তে সুরমা নদী। একপাশে ভারতীয় ভূখণ্ডে জালালপুর আর ওপাশে বাংলাদেশের মধ্যে চারগ্রাম। জকিগঞ্জের রাস্তাটা ওদিকে। আমাদের পরিকল্পনা ছিল ২১ তারিখে আমরা বাংলাদেশের ভিতরে ঢুকে যাবো। ঈদের নামাজ পড়েই আমরা নৌকা করে বাংলাদেশে ঢুকে গেলাম। পাকিস্তান আর্মিরা বর্ডারের কাছে নেই বলে আমরা নিরাপদে চলে এলাম।
প্রথম দিনেই আমাদের লক্ষ্য ছিল জকিগঞ্জ দখল করা। আমরা তখন জকিগঞ্জের দিকে যেতে শুরু করলাম। জকিগঞ্জে পাকিস্তান আর্মির একটা প্লাটুন ডিফেন্স ছিল তারা জায়গায় জায়গায় চেকপোস্টের মতো রেখেছিল যেন আমাদের যাওয়াটা দেরি হয় কিন্তু আমরা ওদের সময় দিইনি।
আমরা একের পর এক পোস্ট দখল করতে করতে জকিগঞ্জ দখল করে ফেললাম। জকিগঞ্জ পৌঁছে আমরা দেখলাম পাকিস্তানিদের এমন কোন বাঙ্কার ছিল না যেখানে ধর্ষণ ও হত্যা করেনি তারা। জকিগঞ্জে যেসব পাকিস্তানি আর্মি ছিল তারা আমাদের দেখেই পালাতে লাগলো। কিন্তু ওরা বেশিদূর যেতে পারেনি।
চারগ্রাম কী তখন মুক্ত হয়ে গেছে?
ওয়াকার হাসান: না। তখনো মুক্ত হয়নি। আমরা জকিগঞ্জ দখল করেই চারগ্রাম আটগ্রাম দখল করলাম। তারপর আমরা সুরমা নদীর পাশে এসে ডিফেন্স নিলাম। সুরমা নদীর ডান পাশে ক্যাপ্টেন হাফিজের কোম্পানি। বাম দিকে ক্যাপ্টেন মাহবুবের কোম্পানি।
আমাদের ডেল্টা কোম্পানি পেছনের ডান দিকে, চার্লি কোম্পানি পেছনের বাম দিকে। আমাদের ডান দিকে ছিল খোলা জায়গা। অনেকটা জঙ্গলের মতো। ওখানে পাকিস্তানি বাহিনী আসে, নদী পাড়ি দিয়ে লুকিয়ে থাকে।
এরা কি ৩১ পাঞ্জাব ব্যাটেলিয়ন?
ওয়াকার হাসান: হ্যাঁ। ৩১ পাঞ্জাব ব্যাটেলিয়ন। এটা ছিল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স। ভীষণ দুর্ধর্ষ। তো খুব সকালবেলা ওরা নদী পাড়ি দিয়ে আমাদের দিকে আসা শুরু করলো। আমরা টেরই পাইনি ওরা আসছে। কারণ সামনে নদী। কোন দিক থেকে আসবে ওরা। পরে আমরা বুঝতে পারলাম তাদের পরিকল্পনা ছিল সামনের একটা কোম্পানি দিয়ে এটাকে আঘাত করো তারপর আরেকটা কোম্পানি ঢোকাও।
পিছনের কোম্পানি সিল করে দাও সামনের গুলোকে সারেন্ডার করতে বলো। তখন আর কোনো যাওয়ার রাস্তা নেই। তখন আমার সাথে ব্রিগেড এবং ব্যাটেলিয়ন হেড কোয়ার্টার পিছনে লাগানো। মানে জিয়াউর রহমান, জিয়াউদ্দিন ওদেরকেই ধরার লক্ষ্য।
তখনই আমার পাশের প্লাটুন অর্থাৎ ১১তম প্লাটুনের কমান্ডার সুবেদার মুসা ওয়্যারলেস কোম্পানি কমান্ডার ক্যাপ্টেন পাটোয়ারিকে বলছে, 'স্যার আমাকে ধরে ফেলছে প্রায় পাকিস্তানিরা। ওরা কাছে চলে আসছে।' তখন প্রচণ্ড গুলির আওয়াজ শুনতে পেলাম। কিন্তু আমরা ক্যাপ্টেন পাটোয়ারির কোনো জবাব পেলাম না।
ক্যাপ্টেন পাটোয়ারি তখন ঠিক কোথায়? তার ওয়্যারলেস সেটই বা কার কাছে?
ওয়াকার হাসান: বোধহয় তখন তিনি ব্যাটেলিয়ন হেড কোয়ার্টারে ছিলেন। হয়তো কোথাও ওয়্যারলেস সেট তিনি রেখে গেছেন। হেড কোয়ার্টারে নিয়ে গেলেও তো তিনি শুনতে পেতেন। উনি নিজেও বুঝতে পারেননি পাকিস্তানি বাহিনী যে পিছন দিক থেকে ঢুকবে।
তখন সুবেদার মুসা বারবার বলছে, স্যার পাকিস্তানিরা কাছে চলে আসছে। বলছে সারেন্ডার করো। আমি তখন ওয়্যারলেসে এসে সরাসরিই বললাম, 'মুসা সাহেব আপনাদের পজিশনটা আমাকে বলেন।'
সুবেদার মুসা জবাবে বললেন, 'স্যার ওরা আমার একাবারেই কাছে। আমি ওদের দেখতে পাচ্ছি। আমরা একটা পুকুরের পাড়ে।' তখন আমি সুবেদার মুসাকে বললাম, 'আপনি কি আপনার অবস্থান ১০ মিনিট ধরে রাখতে পারবেন?'
উনি বললেন, 'হ্যাঁ আমি পারবো স্যার।' আমি জবাবে বললাম, 'তাহলে আমি আসতেছি। আমি যখন আসবো তখন আপনি কিন্তু টের পাবেন। আমাদের শব্দেই আপনি বুঝতে পারবেন আমরা চলে আসছি। তখন আপনি আপনার প্লাটুনে যে ৪০ জন লোক আছে সবাই আমার দলে যোগ দিবেন।'
এটি বলার কারণ ছিল আমি পিছনে আমার দলের ৫ জনকে ফেলে এসেছি। আমার একটি মেশিনগান ছিল, সুবেদার মুসার একটি মেশিনগান। আমি তখন দুটো মেশিনগানকে গ্রাম বরাবর মেশিনগানের লক্ষ্যবস্তু করলাম।
আমার দলের ৫টি হালকা মেশিনগান দিয়ে ফেলে আসা ৫ জন এবং মেশিনগানের ২ জন করে গানম্যানসহ মোট ৪ জনকে ওয়্যারলেসে বললাম তোমরা ওই গ্রাম বরাবর মেশিনগান তাক করবা।
আমরা এদিক দিয়ে যাবো, তোমাদের গুলি চলবে বৃষ্টির মতো। যেই মাত্র আমরা গ্রামে গিয়ে পৌঁছাবো তখন ফায়ার বন্ধ হবে এর আগে না। তখন সূর্য উঠে গেছে। সব দেখা যাচ্ছে।
তখন আমরা হামাগুড়ি দিয়ে দৌড়ে =গ্রামের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। আমার সঙ্গে ৩৫ জনের মতো ওখানে তখন ৪০ জন আছেই।
গ্রামে ঢুকেই আমি পুরোপুরি কনফিউজড হয়ে পড়লাম। কারণ ওদেরও খাকি কাপড়, আমাদেরও খাকি কাপড়। ওদের চাইনিজ হেলমেট, আমাদেরও চাইনিজ হেলমেট। আমাদেরও চাইনিজ অস্ত্র ওদেরই একই। তখন আমরা সঙ্গে সঙ্গে রাইফেলে বেয়নেট ঢুকিয়ে শুরু হলো বেয়নেটের আঘাত।
এসময় পাকিস্তানি সৈন্যরা দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলো, আমরাও পিছন থেকে ধাওয়া শুরু করলাম এবং চিৎকার করতে করতে আত্মসমর্পণের জন্য নির্দেশ দিলাম। কিন্তু ওরা পালাচ্ছে।
তখন আমি আমার প্লাটুনের সিপাহি কাশেমকে গুলি চালাতে নির্দেশ দিলাম। পিছন থেকে ফায়ার করতেই ৭/৮ জন মারা গেল। তখন সামনের গুলো ঘুরে গিয়ে হাত উঁচু করে আত্মসমর্পণ করলো।
আপনারা কতজনকে আটক করলেন? মুক্তিবাহিনী বা পাকিস্তানিদের হতাহত কতজন হবে আনুমানিক?
ওয়াকার হাসান: আমরা জীবিত অবস্থায় ২৬ জনকে আটক করলাম। আমাদের মোট ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা হতাহত হয়েছেন এই যুদ্ধে। তারপর হেলিকপ্টার খবর দিলাম আমরা। এরই মধ্যে আমাদের কোম্পানির জেসিও বললেন মেজর সারওয়ারসহ মোট ৮৮ পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়েছে।
এরপর আমরা বাঙ্কার গুলো ছেড়ে তাদেরকে নিয়ে অন্য একটা জায়গায় যাবো। তাই নিহত পাকিস্তানি সৈন্য সবগুলোকে বাঙ্কারে ঢুকিয়ে দাফন করে দিলাম। এইপাশে পাকিস্তানি বাহিনীর পুরো মেরুদণ্ড ভেঙে গেল। এরাই তখন কানাইঘাটে যাওয়ার কথা।
এরপর কানাইঘাটে যে যাবে এই শক্তিটুকুও পাকিস্তানি বাহিনীর আর ছিল না। ওদেরই যাওয়ার কথা ছিল ওখানে কিন্তু তাদের বেশিরভাগই আহত। অন্যদিকে, ক্যাপ্টেন আবদুর রব তার ৪টা কোম্পানি দিয়ে কানাইঘাট দখল করে নিলেন।
ahmadistiak1952@gmail.com
Comments