মুক্তিযুদ্ধ

খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা: কাজী মুহাম্মদ শফিউল্লাহ, বীর উত্তম

কাজী মুহাম্মদ শফিউল্লাহ, বীর উত্তম। ছবি: সংগৃহীত

মুক্তিযুদ্ধে লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী মুহাম্মদ শফিউল্লাহ ছিলেন নেতৃস্থানীয় ভূমিকায়। অসামান্য বীরত্বের জন্য হিসেবে তিনি পেয়েছিলেন বীর উত্তম খেতাব। তার খেতাবের সনদ নম্বর ২। মুক্তিযুদ্ধে প্রথমে তিনি ছিলেন ৩ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার। পরে এস ফোর্সের প্রধান হন।

মুক্তিযুদ্ধের আগে কাজী মুহাম্মদ শফিউল্লাহ ছিলেন ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন কমান্ড। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মুহাম্মদ শফিউল্লাহর নেতৃত্বে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে ১৯ মার্চ ঢাকার ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার থেকে জয়দেবপুরে যান ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাবা। বাঙালি সেনাদের নিরস্ত্র করার চেষ্টা করেন তিনি। কারণ তিনি জানতেন, যে কোনো মুহূর্তে যুদ্ধ শুরু হতে পারে এবং বাঙালি সেনাদের কাছে অস্ত্র থাকলে তারা বিদ্রোহ ঘোষণা করবে। কিন্তু বাঙালি সেনাদের তারা নিরস্ত্র করতে ব্যর্থ হন।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ২৮ মার্চ কাজী মুহাম্মদ শফিউল্লাহর নেতৃত্বে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনারা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ২৯ মার্চ ঢাকা আক্রমণের পরিকল্পনা করেন তারা। এরইমধ্যে ২ নম্বর সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ খবর পাঠান, তিনি শফিউল্লাহর সঙ্গে দেখা করতে চান। ২ সেক্টরের সেনারা একত্র হয়ে যুদ্ধের পরিকল্পনা করলে অপারেশন সফল হবে বলে মত দেন খালেদ মোশাররফ। শফিউল্লাহদের ঢাকা আক্রমণের পরিকল্পনার পেছনে ছিল অন্য একটি কারণও। একদিন ওয়ারলেসে খবর পাঠাতে গিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর যশোর ও চট্টগ্রামে বড় ধরনের আক্রমণের পরিকল্পনার কথা জেনে যান তারা। এটিকে একটি সুযোগ ভেবে নরসিংদী ও পাঁচদোনায় কিছু সেনা রেখে ঢাকা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু মেজর খালেদ মোশাররফের সঙ্গে বৈঠকের পর সে সিদ্ধান্ত বাতিল হয়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ৪ এপ্রিল হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ম্যানেজার বাংলোতে ঐতিহাসিক বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কাজী মুহাম্মদ শফিউল্লাহ। এর আগে মেজর খালেদ মোশাররফের আহ্বানে ১ এপ্রিল তেলিয়াপাড়ায় গিয়ে ৪র্থ বেঙ্গলের সঙ্গে যৌথভাবে সদর দপ্তর স্থাপন করেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১০ এপ্রিল থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত ৩ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন কাজী মুহাম্মদ শফিউল্লাহ। তার অধীনে থাকা ৩ নম্বর সেক্টরের আওতাধীন এলাকা ছিল হবিগঞ্জ মহকুমা, কিশোরগঞ্জ মহকুমা, আখাউড়া-ভৈরব রেললাইন থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে কুমিল্লা ও ঢাকা জেলার অংশবিশেষ। মুক্তিযুদ্ধের অক্টোবর মাসে তার নেতৃত্বে গড়ে তোলা হয় এস ফোর্স। এই ফোর্সের অধীনে ছিল ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ১১ নম্বর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। কেএম শফিউল্লাহর নির্দেশে ও নেতৃত্বে অসংখ্য দুর্ধর্ষ ও সফল অপারেশন পরিচালিত হয়েছিল। তিনি এসব অপারেশনে কখনো ছিলেন প্রত্যক্ষ ভূমিকায়, কখনো বা পরোক্ষ ভূমিকায়।

তার পরিকল্পনায় সিলেটের একাংশ, আশুগঞ্জ, ভৈরব ও মাধবপুর হানাদারমুক্ত হয়। তার নেতৃত্বে হানাদারমুক্ত হয় আশুগঞ্জ, ভৈরব, লালপুর, আজবপুর, সরাইল, শাহবাজপুর, মাধবপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুর।  

৬ ডিসেম্বর অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান কে এম শফিউল্লাহ। ওইদিন হবিগঞ্জের  তেলিয়াপাড়া থেকে আশুগঞ্জ যাচ্ছিলেন তারা। পথে চান্দুরা ও মাধবপুরে ছিল মুক্তিবাহিনী ব্লক পজিশন। সেখানে তারা গাড়ি থামান। অনুমতি পাওয়ার পরেই গাড়ি এগিয়ে যাবে। পথে পাকিস্তানি বাহিনী বা রাজাকারদের চোরাগুপ্তা হামলাও হতে পারে। তবে বিপজ্জনক কোনো সংকেত না পেয়ে তারা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলেন। ইসলামপুরে যাওয়া মাত্রই দেখা গেল একটি গাড়ি তাদের দিকে আসছে। প্রথমে তারা মনে করলেন, এটি ইস্ট বেঙ্গলের গাড়ি। কিন্তু হঠাৎই গাড়ির ড্রাইভারের পাশে বসা থাকা পাকিস্তানি বাহিনীর এক জেসিও প্রায় লাফিয়ে শফিউল্লাহকে জাপটে ধরলেন। সঙ্গে থাকা শফিউল্লাহর রানারের সঙ্গে ছিল স্টেনগান। কিন্তু রানার আগে থেকেই গুলিতে আহত।  

পাকিস্তানি বাহিনীর জেসিওর কাছে ছিল রাইফেল। ২ জনের মধ্যে তখন তীব্র ধস্তাধস্তি চলছে। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে জেসিও রানারকে জাপটে ধরে শফিউল্লাহকে লক্ষ্য করে রানারের হাতে থাকা স্টেনগানের ট্রিগার চাপেন। কিন্তু এ গুলি শফিউল্লাহর কোমরে বাঁধা পিস্তলে লাগে। শফিউল্লাহ জেসিওর মাথায় কয়েক দফা আঘাত করতেই নিস্তেজ হয়ে পড়ে যান জেসিও। ঠিক এ সময় পাকিস্তানি বাহিনীর একটি বাস সেখানে গিয়ে থামে। এবার প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যান শফিউল্লাহ। বাস থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পাকিস্তানি সেনাকে সেনা নামছে তখন। তিনি রাইফেল নিয়ে তাদের গুলি করতে গিয়ে দেখেন রাইফেল ভাঙা। কোমরে থাকা পিস্তলও বিধ্বস্ত। এ সময় তিনি পাশে থাকা নালায় নেমে যান। কচুরিপানা আর কাদাপানিতে ডুবে থাকার পর এক সময় তিনি পাকিস্তানি অফিসার হওয়ার ভান করে সেনাদের পাশ দিয়ে এগিয়ে গেলেন। কাদাপানিতে ডুবে থাকার কারণে তার জলপাই রঙের ইউনিফর্ম পাকিস্তানিদের পোশাকের সঙ্গে মিলে যায়। তাই পাকিস্তানিরা কোনো সন্দেহ করেনি।

কাজী মুহাম্মদ শফিউল্লাহর জন্ম নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ১৯৩৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর। রূপগঞ্জের মুড়াপাড়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন তিনি। মুন্সিগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজে পড়া অবস্থাতেই যোগ দেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৫৫ সালে কমিশন পান তিনি। এরপর ১৯৬৮ সালে ডিফেন্স  স্টাফ কলেজ থেকে পিএসসি করেন। তিনি  স্কুল অব ইনফেন্ট্রিতে প্রশিক্ষক ছিলেন। ১৯৭০ সালে পদোন্নতি পেয়ে আবার ব্যাটেলিয়নে ফিরে আসেন কাজী মুহাম্মদ শফিউল্লাহ।

মুক্তিযুদ্ধের পর  ১৯৭২ সালের ৫ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন কাজী মুহাম্মদ শফিউল্লাহ। তখন তাকে পূর্ণ কর্নেল পদমর্যাদা দেওয়া হয়।  ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে তিনি ব্রিগেডিয়ার এবং একই বছরের ১০ অক্টোবর মেজর জেনারেল পদ লাভ করেন। ১৯৭৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত তিনি সেনাপ্রধান ছিলেন। ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত টানা ১৬ বছর তিনি বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৯১ সালে দেশে ফিরে এলে তাকে ১ বছরের জন্য ওএসডি করে রাখা হয়। পরের বছর তিনি স্বেচ্ছায় অবসরে জান। ১৯৯৫ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করে নারায়ণগঞ্জ ১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

তথ্যসূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র দশম খণ্ড

বাংলাপিডিয়া

 

আহমাদ ইশতিয়াক

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Technical education hit by teacher shortage, falling enrolment

Bangladesh’s technical education sector is facing a slow-burning crisis, shaped by a severe shortage of teachers, poor infrastructure, and steadily declining student interest.

10h ago