কালের আলোক দিশারী সুফিয়া কামাল
আমাদের সব গণ আন্দোলনে, অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে তিনি একাত্ম হয়েছেন। সব সংগ্রামে আলোকবর্তিকা হয়ে পথ দেখিয়েছেন বারবার। তিনি জড়িয়ে আছেন আমাদের সব সংগ্রামী অভিযাত্রায়। কোথায় নেই সুফিয়া কামাল? ভাষা আন্দোলন থেকে ৬ দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ কিংবা স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন—সবখানেই তার সরব উপস্থিতি।
গণঅভ্যুত্থান প্রেক্ষাপটে বিন্দুমাত্র না ভেবে বর্জন করেছিলেন রাষ্ট্রীয় পদক। বাংলার মাটিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করার পর সম্মুখসারির যোদ্ধা হয়ে উঠেছিলেন। দেশজুড়ে অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের মিছিলে তিনিই থাকতেন নেতৃত্বের ভূমিকায়। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে কারফিউ উপেক্ষা করে শোভাযাত্রার নেতৃত্ব দেন। গণ আদালতে মুক্তিযুদ্ধের ঘাতকদের শিকড় উপড়ে ফেলার সাহসী বার্তাও আসে তার কাছ থেকে। সুফিয়া কামালের দীপ্তিময় উপস্থিতি আমাদের জাতীয় জীবনজুড়ে।
অথচ সুফিয়া কামালের কখনো প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার সুযোগ ঘটেনি। তার রক্ষণশীল পরিবার মনে করত, নারীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অপ্রয়োজনীয় ও ধর্মবিরোধী। ৭ বছর বয়সে বাবা নিরুদ্দেশ হওয়ার পর সুফিয়া কামাল ও তার মায়ের ঠাঁই হয় নানার বাড়ি বরিশালের শায়েস্তাবাদের নবাব পরিবারে। সম্ভ্রান্ত বাঙালি পরিবার হওয়া সত্ত্বেও সে পরিবারে ছিল না বাংলা শেখার ব্যবস্থা। আরবি ও ফার্সি ভাষা শেখা যেত শুধু। তবে মামার বিশাল লাইব্রেরি থাকায় সেখানে কিছুটা পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন সুফিয়া কামাল। তার বাংলার হাতেখড়ি হয়েছিল মা সাবেরা খাতুনের কাছে।
সুফিয়া কামালের জীবনে নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার প্রভাব ভীষণভাবে লক্ষণীয়। মায়ের সঙ্গে কলকাতায় আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে ৭ বছরের সুফিয়া কামাল প্রথম সামনাসামনি দেখেন বেগম রোকেয়াকে। বেগম রোকেয়া তার মাকে বলেছিলেন, 'আপনার মেয়েটিকে আমার স্কুলে দিয়ে দিন।'কিন্তু সুফিয়া কামালদের ঘোর রক্ষণশীল পরিবারের জন্য সেই প্রস্তাবে সম্মতি দেওয়া ছিল অকল্পনীয়।
মামাতো ভাই সৈয়দ নেহাল হোসেনের সঙ্গে সুফিয়া কামালের যখন বিয়ে হয়, তখন তার বয়স মাত্র ১৩। স্বামী নেহাল হোসেন তার পরিবারের একমাত্র আধুনিক ও জ্ঞানমনস্ক মানুষ ছিলেন। তারই সহায়তায় সুফিয়া কামাল জ্ঞান আহরণে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। পরিচিত হয়েছিলেন সাময়িক পত্রপত্রিকা ও সমকালীন সাহিত্যের সঙ্গে।
'সওগাত' পত্রিকায় প্রকাশিত হয় সুফিয়া কামালের প্রথম কবিতা 'বাসন্তী'। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন সম্পাদিত 'সওগাত' বেশ পরিচিতি পেয়েছে তখন। সওগাতের যে সংখ্যায় সুফিয়া কামালের 'বাসন্তী' কবিতা ছাপা হয়েছিল, সেই সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা 'সর্বহারা'ও।
সুফিয়া কামালের কবি জীবনে নজরুলের পরোক্ষ প্রভাব বরাবরই ছিলো। সুফিয়া কামাল লিখেছিলেন, 'এমনই কোনো বর্ষণমুখর দিনে মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ''হেনা'' পড়ছিলাম বানান করে। প্রেম, বিরহ, মিলন এসবের মানে কি তখন বুঝি? তবু যে কী ভালো, কী ব্যথা লেগেছিল তা প্রকাশের ভাষা কি আজ আর আছে? গদ্য লেখার সেই নেশা। এরপর প্রবাসী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা পড়তে পড়তে অদ্ভুত এক মোহগ্রস্ত ভাব এসে মনকে যে কোন্ অজানা রাজ্যে নিয়ে যেত। এরপর দেখতাম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, বেগম সারা তাইফুর লিখছেন। কবিতা লিখছেন বেগম মোতাহেরা বানু। মনে হলো, ওরা লিখছেন, আমিও কি লিখতে পারি না? শুরু হলো লেখা লেখা খেলা। কী গোপনে, কত কুণ্ঠায়, ভীষণ লজ্জার সেই হিজিবিজি লেখা ছড়া, গল্প। কিন্তু কোনোটাই কি মনের মতো হয়! কেউ জানবে, কেউ দেখে ফেলবে বলে ভয়ে-ভাবনায় সেই লেখা কত লুকিয়ে রেখে আবার দেখে দেখে নিজেই শরমে সংকুচিত হয়ে উঠি।'
সুফিয়া কামালকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছিল বেগম রোকেয়ার 'আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম'। এর মাধ্যমে বেগম রোকেয়ার সঙ্গে গড়ে উঠেছিল তার গভীর সম্পর্ক। কিন্তু সেই সময়টাও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি তার জীবনে। একই বছরে সুফিয়া কামালের স্বামী সৈয়দ নেহাল হোসেন এবং বেগম রোকেয়া ২ জনই পাড়ি জমান পরপারে।
স্বামীর আকস্মিক মৃত্যু মানসিক এবং আর্থিক ২ ভাবেই ভঙ্গুর করে দিয়েছিল সুফিয়া কামালকে। একমাত্র সন্তানকে নিয়ে সংসারের হাল ধরতে তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন কলকাতা করপোরেশন স্কুলে। তবে সাহিত্যচর্চায় বিরতি দেননি সুফিয়া কামাল, যার প্রমাণ তার প্রথম গল্পগ্রন্থ 'কেয়ার কাঁটা'।
তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'সাঁঝের মায়া'তে মুখবন্ধ লিখেছিলেন নজরুল। পাঠ প্রতিক্রিয়ায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর করেছিলেন প্রশংসা। এভাবেই সারাজীবন কখনো ভেঙেছেন, তো পরক্ষণে নতুন উদ্যমে জেগে উঠেছেন সুফিয়া কামাল।
সুফিয়া কামালের জীবনের একটি অংশ হয়ে আছে মাসিক 'সওগাত'। সওগাতের অভিযাত্রায় তিনি ছিলেন প্রধান ভূমিকায়। সওগাত থেকে যখন বাংলা ভাষার প্রথম সচিত্র নারী সাপ্তাহিক 'বেগম' পত্রিকার জন্ম হলো, তখন 'বেগমের' প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন সুফিয়া কামাল। এর প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন নারী শিক্ষার গুরুত্ব ও নারীদের দায়িত্ব প্রসঙ্গে।
লিখেছিলেন, 'সুধী ব্যক্তিরা বলেন, জাতি গঠনের দায়িত্ব প্রধানত নারীসমাজের হাতে। কথাটা অনস্বীকার্য নয় এবং এই গুরুদায়িত্ব পালন করতে হলে পৃথিবীর কোনো দিক থেকেই চোখ ফিরিয়ে থাকলে আমাদের চলবে না, এ কথাও মানতে হবে। শিল্প-বিজ্ঞান থেকে আরম্ভ করে গৃহকার্য ও সন্তান পালন সর্বক্ষেত্রে আমরা সত্যিকার নারীরূপে গড়ে উঠতে চাই।'
পরে 'বেগম' পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব নুরজাহান বেগমের হাতে অর্পিত হলেও পত্রিকাটির সঙ্গে কখনোই সুফিয়া কামালের সম্পর্ক ছেদ হয়নি।
গণ আন্দোলনের লড়াইয়ে সুফিয়া কামালের সরব উপস্থিতি দেখা গেছে বারবার। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ছাত্রদের মিছিলে পুলিশের গুলিতে সুফিয়া কামাল ছুটে গিয়েছেন মেডিকেলে। ভাষা আন্দোলনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার ছিল সার্বক্ষণিক যোগাযোগ। ভাষা আন্দোলনের কিংবদন্তি সংগঠক নাদেরা বেগমকে যখন পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজছিল, তখন সুফিয়া কামালই 'জাহানারা' ছদ্মনামে বোনের মেয়ে পরিচয়ে নিজ বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন নাদেরা বেগমকে।
১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীতে যখন আইয়ুব সরকার রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করল, তখন রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের পর প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে 'ছায়ানট' গড়ে তুললেন সুফিয়া কামালসহ অন্যান্যরা। সুফিয়া কামাল পেলেন ছায়ানটের সভাপতির দায়িত্ব। স্রোতের বিপরীতে তীব্র প্রতিকূলতায় এমনভাবেই সুফিয়া কামাল বারেবার এসেছেন উদ্ধারকর্তা হয়ে।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে সুফিয়া কামাল ছিলেন মহিলা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি। গণঅভ্যুত্থানের সমর্থনে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা 'তমঘা-ই-ইমতিয়াজ'পদক বর্জন করেন তিনি।
১৯৭০ সালের এপ্রিলে সমাজে নারীদের দায়িত্বশীল ভুমিকার অভিযাত্রায় এবং নারী-পুরুষ সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সুফিয়া কামালের উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত হয় 'পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদ'। এটিই আজকের 'বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ'। সুফিয়া কামালের স্বপ্ন ছিল, পিছিয়ে পড়া নারীরা মহিলা পরিষদের মাধ্যমে উপলব্ধি করবেন নিজেদের। তার লক্ষ্য ছিল সমাজ পরিচালনায় নারীর সম-অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
১৯৭১ সালের মার্চে অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন সুফিয়া কামাল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সুফিয়া কামাল নিজ বাড়িতে অন্তরীণ হয়ে পড়লেন। তখন তার ওপর পাকিস্তানি গোয়েন্দা বাহিনীর সার্বক্ষণিক নজরদারি। কিন্তু তাতেও দমে যাননি তিনি। মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়েছেন নিজের ২ মেয়েকে। সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে। মুক্তিযোদ্ধাদের রসদ রাখা হতো ধানমন্ডিতে তার বাড়িতে।
সুফিয়া কামালের মেয়ে সুলতানা কামাল লিখেছেন, 'বাসার পেছনেই সোভিয়েত কালচারাল সেন্টার ছিল। ওরা ওই দেয়াল টপকে অনায়াসে আমাদের বাসায় আসত। কথাবার্তা-আলোচনা হতো কে কীভাবে যাবে, পথের মধ্যে টাকা-পয়সা খরচা, ২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ করে শাহাদত ভাইয়ের গ্রুপের ছেলেদের সমস্ত লেনদেন, আলোচনা, শলাপরামর্শ আমাদের বাসায় হতো।'
সোভিয়েত সরকার এক পর্যায়ে সুফিয়া কামালকে নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে বিশেষ বিমানে রাশিয়ায় নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বলেছিলেন, দেশের মানুষের এই অনিশ্চিত অবস্থায় তিনি কোথাও যেতে রাজি নন। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি মুহূর্তে তিনি অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। 'একাত্তরের ডায়েরি' তেমনই একটি সময়ের দলিল।
১৯৯০ এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন বা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গঠিত ১৯৯২ এর গণ আদালতেও সুফিয়া কামালের শক্তিশালী ভূমিকা ছিল। ১৯৯২ সালের গণ আদালতের সময় সুফিয়া কামালের বয়স আশির ঘর অতিক্রম করেছে। সেই বয়সেও তার মনোবল ছিল অটুট। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে জনমত গঠন করে তা আন্দোলনে রূপ দিয়েছিলেন সুফিয়া কামাল। আর সেই আন্দোলনকে গণ আদালতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জাহানারা ইমাম। সুফিয়া কামালই প্রথম আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য জাহানারা ইমামের নাম প্রস্তাব করেছিলেন। এই পদক্ষেপের কারণেই পরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্ভব হয়।
একজন কবি, সাহিত্যিক বা লেখক একটি দেশের সব গণতান্ত্রিক আর গণ অধিকারের লড়াইয়ে কতটা নিবেদিতপ্রাণ হতে পারেন, তার উজ্জ্বলতম উদাহরণ সুফিয়া কামাল। সুফিয়া কামাল আমাদের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এক অনন্য দীপ্তময় নাম।
ঠিক যেন সুফিয়া কামালকে নিয়ে লেখা কবীর সুমনের সেই গান,
'ঐ তো লক্ষ ছেলেমেয়ে
নাতিনাতনি দামাল
সবুজ দ্বীপের মত মাঝখানে
সুফিয়া কামাল।'
জন্মবার্ষিকীতে জননী সাহসিকা, প্রজন্মের মশালবাহক কবি সুফিয়া কামালের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
তথ্যসূত্র:
ছিলাম কোথায় যেন নীলিমার নিচে/ সুলতানা কামাল
সুফিয়া কামাল স্মারকগ্রন্থ
একালে আমাদের কাল/ সুফিয়া কামাল
ahmadistiak1952@gmail.com
Comments