মুক্তিযুদ্ধ

কামালপুরের ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণ: যিনি এনেছিলেন বিজয় বার্তা

বশির আহমেদ বীর প্রতীক এর সাক্ষাৎকার
কামালপুরে পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের দিনে বশির আহমেদ ও আনিসুল হক সঞ্জু। ছবি: হারুন হাবীব

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কামালপুরের যুদ্ধ এক অনন্য স্থান দখল করে আছে। অসংখ্য খণ্ড যুদ্ধ ও চার বার সেট পিস যুদ্ধ নিয়ে বিস্তৃত কামালপুর রণাঙ্গন সন্দেহাতীতভাবে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম রণাঙ্গন। কামালপুরের যুদ্ধ যেমন ঐতিহাসিক তেমনি কামালপুরের আত্মসমর্পণের ঘটনাও অভূতপূর্ব। কামালপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পেছনে ছিলেন দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া মাত্র ১৫ বছরের এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। আজ ৪ ডিসেম্বর কামালপুরের ঐতিহাসিক সেই আত্মসমর্পণের ৫০তম বছর পূর্ণ হলো।

দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কামালপুরের আত্মসমর্পণের নায়ক দুঃসাহসিক কিশোর মুক্তিযোদ্ধা বশির আহমেদ, বীর প্রতীক বলেছেন ঐতিহাসিক সেই আত্মসমর্পণের দিনের ঘটনা প্রবাহ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আহমাদ ইশতিয়াক। 

আমরা জানি আপনি মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্য থেকে কামালপুর বিওপিতে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন। কী হয়েছিল সেদিন?

৩ ডিসেম্বরের কথা। সন্ধ্যা বেলা আমার অবস্থান ছিল সীমান্তের চেকপোস্টের ধারে বানরোডের পাশে। আমাদের কোম্পানির অবস্থান ছিল ওখানে। এদিন সন্ধ্যা বেলা ভারতীয় বাহিনীর কমান্ডার মেজর জওহর সিং আমাদের বললেন তোমরা সবাই বিমান আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ট্রেঞ্চ খুঁড়ে নাও। পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করেছে। এখন ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধ শুরু হবে। আমার সাথে ছিল উড়িষ্যার এক হাবিলদার। আমরা দুজনে একটা ট্রেঞ্চ খুঁড়ে এর মধ্যে আশ্রয় নিলাম। ওখানে রাতে থাকলাম। রাতে মহেন্দ্রগঞ্জে ব্যাটেলিয়ন হেড কোয়ার্টারে ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হলো পরদিন পাকিস্তানিদের প্রথমে আক্রমণ না করে তাদের আগে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেওয়া হোক। প্রস্তাবে তাদের বলা হবে, 'তোমরা আত্মসমর্পণ করো, নয়তো বিমান হামলা ও স্থল হামলা চালিয়ে তোমাদের ঘাঁটি নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হবে।'

৪ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ৭টার দিকে ব্রিগেডিয়ার হরদেব সিং ক্লেয়ার তার কমান্ড পোস্ট মাজেশ্বর থেকে আমাদের যেখানে অবস্থান ছিল অর্থাৎ ভারতের সীমান্তবর্তী গ্রামটির কাছে সেখানে একটি চেয়ার নিয়ে বসলেন। এরই মধ্যে কোম্পানিগুলোতে খবর পাঠানো হলো এখানে আসার জন্য। যার ফলে বহু মুক্তিযোদ্ধা জমায়েত হলেন সেখানে। এর মধ্যে ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার জমায়েত মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে বললেন, 'তোমাদের কোনো একজনকে কামালপুরে পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব নিয়ে যেতে হবে।' কিন্তু কে যাবে? পাঞ্জাবিরা হলো রুক্ষ মেজাজের। কে যাবে তাদের কাছে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব নিয়ে! কেইবা যাবে শত্রুর কাছে। যদি আমাদের দেখা মাত্র গুলি করে ওরা। এরকম প্রাণ হাতের মুঠোয় রেখে নিশ্চিত মৃত্যু জেনে কে যাবে তাদের কাছে! সবাই নীরব তখন।

সবার মধ্য থেকে আপনি সেদিন রাজি হয়েছিলেন...

মুক্তিবাহিনীর কাছে বিভিন্ন জায়গায় ওয়্যারলেসে করে জানানো হলো, 'কেউ কি আত্মসমর্পণের প্রস্তাব নিয়ে পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে যেতে পারবে?' কিন্তু মৃত্যু নিশ্চিত জেনে কেউই রাজি হচ্ছে না।' আমি হাত উঠালাম। হাত উঠিয়ে বললাম, 'স্যার আমি যাব।' ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেন। আমাকে একটি সাদা পতাকা ও একটি বদ্ধ খামে একটি চিঠি দেওয়া হলো। আমাকে বললো এই চিঠি তুমি নিয়ে যাও। নিয়ে গিয়ে তুমি পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে গিয়ে ক্যাম্প কমান্ডার আহসান মালিকের হাতে পৌঁছে দেবে। প্রথমে তুমি কিন্তু ক্যাম্পে যাবে না। তুমি ক্যাম্প থেকে ১৫০ গজের মতো দূরত্বে থেকে প্রথমে সাদা পতাকা ও চিঠি দেখাবে। তারপর তাদের ইশারায় ডাকবে চিঠি নেওয়ার জন্য। যদি তুমি দেখো তোমার উপর গুলি করছে তুমি নিচে শুয়ে পড়বে। আমরা উপর থেকে আর্টিলারি ফায়ার করবো। তুমি হামাগুড়ি দিয়ে চলে আসবে।' 

কামালপুরে পাকিস্তানিদের বিওপি থেকে তখন আপনাদের ক্যাম্প কতোটা দূরত্বে ছিল?

আনুমানিক ২ হাজার গজ হবে। তবে ভারতীয় সীমানা থেকে কামালপুর ক্যাম্প পর্যন্ত তখন একবারেই ফাঁকা জায়গা ছিল। হাঁটু সমান ঘাস। কোনো গাছপালা বাড়িঘর কিছুই নেই। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। 

তারপর আমি কামালপুর ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। বানরোডে উঠলাম। আমি দেখতে পেলাম আমাকে আসতে দেখে পাকিস্তানিরা যার যার অস্ত্র নিয়ে বাঙ্কারে চলে গেল। আমি বানরোডে উঠে তাদের দিকে সাদা পতাকা আর সাদা বদ্ধ খাম দেখালাম। কিন্তু তারা কেউই আমার কাছে আসছে না। এরকম আনুমানিক ২০-২৫ মিনিট হয়ে গেল। শেষে তারাই আমাকে ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য ইশারায় ডাক দিলো। কোন কথা হচ্ছে না কিন্তু। সব ইশারায়।

শেষে আমি চিন্তা করলাম এখন যদি আমি না যাই তাদের কাছে তারা হয়তো আমাকে গুলি করতে পারে। যাই হোক আমি আল্লাহর নাম স্মরণ করে হাঁটা শুরু করলাম। তাদের ক্যাম্প তখন ভীষণ সুরক্ষিত। সামনে বাঁশের কঞ্চি পোঁতা, মাইন লেআউট করা। তারপর আমি ক্যাম্পের গেইটে এসে দাঁড়ালাম। একজন অফিসার এগিয়ে এসে আমার হাত থেকে চিঠি আর সাদা পতাকাটা নিলো। আমাকে ক্যাম্পের পাশে আমগাছের নিচে পাতা একটি বেঞ্চিতে বসতে দিলো। কিছুক্ষণ পর আমার জন্য কিছু রুটি কিছু ডাল আর এক মগ পানি নিয়ে এলো। আমি বললাম। না আমি নাস্তা করেই এসেছি। আমি খাবো না।' তখন এমন জোরাজুরি করলো যে খেতেই হবে। আমি রুটি খেলাম বাধ্য হয়ে।

তখন কয়টা হবে আনুমানিক? 

তখন সকাল সাড়ে নয়টা হবে আনুমানিক। হঠাৎই ভারত থেকে কয়েকটি যুদ্ধ বিমান এসে কামালপুর ক্যাম্পে আক্রমণ শুরু করলো। আমাকে টেনে একটা বাঙ্কারের ঢোকানো হলো। যুদ্ধ বিমান একটা বোমা নিক্ষেপ করলো। বোমার স্প্রিন্টারগুলো বাঙ্কারে পড়ে কয়েক জায়গায় টুকরো উঠে গেছে। পরে জেনেছিলাম ব্রিগেডিয়ার হরদেব সিং ক্লেয়ারের ছেলেই ছিল বিমান বাহিনীর পাইলট। বিমান আকাশে কিছুক্ষণ ঘুরে চলে গেল। তখন আমি বুঝে গেলাম পাকিস্তানিরা আমাকে মেরে ফেলবে। আমার মনে ভয় পেয়ে বসলো। আমার বাঁচার কোনো উপায় নেই। যেহেতু বিমান হামলা শুরু হয়ে গেছে সেহেতু আমার মৃত্যু অনিবার্য। আমার শরীরে কেমন নিস্তেজ ভাব এসে গেল। কিন্তু আমি চিন্তা করছি, আমাকে মেরে ফেলুক অসুবিধে নেই। আমার তখন কেবল শহীদ আহাদুজ্জামানের কথা মনে পড়লো।

শহীদ আহাদুজ্জামান শহীদ হয়েছিলেন কখন? 

আগস্ট মাসে। তিনি একটি অপারেশন শেষে পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়ার পরে তাকে কামালপুর ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে জিপের পিছনে রশি দিয়ে বেঁধে টেনেহিঁচড়ে বকশীগঞ্জ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পুরো শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল তার। তারপর তাকে বকশিগঞ্জে নিয়ে এসে গাছের সঙ্গে উল্টো করে ঝুলিয়ে ব্লেড গিয়ে পুরো শরীর কেটে কেটে লবণ মরিচ দিয়ে তার উপর নির্যাতন চালিয়ে তাকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানিরা। আমি তখন আল্লাহকে স্মরণ করে বলছি যে, 'আল্লাহ আমাকে যদি গুলি করে মারা হয় কোনো কষ্ট হবে না। কিন্তু শহীদ আহাদুজ্জামানের মতো যেন এমন পৈশাচিক নির্যাতনের পর না মারা হয়।

মুক্তিযোদ্ধা আনিসুল হক সঞ্জু এলেন কখন? 

ওটা আরেকটু পরে। এদিকে ভারতীয় যৌথ বাহিনী তো মনে করেছে আমাকে মেরেই ফেলেছে। দুপুর সাড়ে তিনটার কিছু আগ মুহূর্তে আনিসুল হক সঞ্জুকে ঠিক একইভাবে পাঠানো হলো। বদ্ধখামে কী লেখা ছিল আমরা তো জানি না তবে জেনেছি কড়াকড়িভাবেই লিখেছে হরদেব সিং ক্লেয়ার। সঞ্জুও ঠিক আমার মতোই এলো। ওকে ডেকে এনে আমার বাঙ্কারেই রাখলো। আমি সঞ্জুকে বললাম, 'আমি মরেছি তো মরেছি তুমি আসলে কেন?' এর পাঁচ দশ মিনিট পরে আমরা দেখতে পেলাম পুনরায় ভারতীয় যুদ্ধ বিমান এসে কামালপুর ক্যাম্পে আক্রমণ করলো। তাদের বোমার আঘাতে বেশ কয়েকটি বাঙ্কারে বোমা নিক্ষেপ করা হলো। দু- তিনজন পাকিস্তানি সেনা আহত হলো। তখন একজন অফিসার দৌড়ে এসে সাদা পতাকা ও চিঠি আমাদের দুজনের হাতে দিয়ে বললো মুক্তিযোদ্ধা 'আমরা ইয়ে দেখাও। আম সারেন্ডার হোগা।' আমরা তখন বাঙ্কার থেকে বেরিয়ে মাঠের সামনে এসে পতাকা আর চিঠি উঁচু করে ধরে যুদ্ধ বিমানের দিকে তাকিয়ে নাড়তে থাকলাম। দেখা গেল আর কোনো বোমা হামলা না করেই যুদ্ধ বিমান পুনরায় চলে গেল।

এরপর কী হলো? আপনারা কি তখন ক্যাম্পের ভেতরে নাকি বাইরে? 

আমরা তখন ওই বেঞ্চিতে বসে। ক্যাম্পের বাইরে। আনুমানিক ৪টার দিকে লেফটেন্যান্ট আহসান মালিক শুধু আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন ক্যাম্পের ভেতরে। নিয়ে গিয়ে আরেকটি চিঠি আর সাদা পতাকা দিয়ে বললেন ব্রিগেডিয়ারকে দিতে। আমাকে চিঠি নিয়ে ব্রিগেডিয়ারের কাছে গিয়ে উত্তর নিয়ে আসতে বললেন। চিঠি নিয়ে আমি ভারতীয় ভূখণ্ডে আমাদের ক্যাম্পে চলে গেলাম। কিছুক্ষণ পর আমাকে আসতে দেখে আমার সহযোদ্ধারা এবং ভারতীয় সেনারা এগিয়ে এলো আমাকে নিতে। ভারতীয় বাহিনীর লেফটেন্যান্ট আবদুল মালেক ও গোর্খা রেজিমেন্টের এক ক্যাপ্টেন প্রায় ২০০-৩০০ গজ সামনে দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। ওরা বুঝে ফেলেছে আত্মসমর্পণে রাজি হয়েছে পাকিস্তানি বাহিনী। আমাকে কাঁধে করে ব্রিগেডিয়ার হরদেব সিং ক্লেয়ারের কাছে নিয়ে গেল। আমি ব্রিগেডিয়ারের হাতে চিঠি দিলাম। উনি পড়লেন তারপর মেজর জওহর সিংকে বললেন 'সবাইকে খাবার দাও।' খেয়েদেয়ে বললেন, এটা নিয়ে ক্যাম্পের কমান্ডার ক্যাপ্টেন আহসান মালিককে দেবে। সেই সাদা পতাকা নিয়ে আমি পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে আবার চললাম। তখন আমার আর ভয় নেই মনে। আমি পাকিস্তানি ক্যাম্পে গিয়ে আহসান মালিকের হাতে চিঠিটা দিলাম। উনি আমাকে বাঙ্কারের কাছে বসতে বলে ভিতরে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এসে আমাকে ডাকলেন। ডেকে বললেন, ব্রিগেডিয়ারের কাছে চিঠিটা নিয়ে যাও। কিন্তু ততক্ষণে ব্রিগেডিয়ার হরদেব সিং ক্লেয়ার তার সৈন্যসহ কামালপুর ক্যাম্প থেকে তিনশ চারশ গজ দূরে চলে এসেছেন। চিঠিতেই বোধকরি এমন লেখা ছিল। 

তখন কি আত্মসমর্পণ হয়ে গেছে? নাকি প্রক্রিয়া চলছে? 

তখনো প্রক্রিয়া চলছে। এরমধ্যে টেলিফোনে ক্যাপ্টেন আহসান মালিক অনেকের সাথে কথা বললেন। কয়েকজন ভারতীয় অফিসারের সঙ্গেও কথা বললেন। এরপর ব্রিগেডিয়ার সাহেবের কাছে চিঠি নিয়ে যেতে বললেন। আমি চিঠিটা ব্রিগেডিয়ারকে দিতেই উনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। এরমধ্যে সবাই আমাকে নিয়ে উৎসবে মেতে গেল। একজন টেনে নিয়ে যায় তো একজন গাল টেনে দেয়। বিজয় উৎসব শুরু হয়ে গেল। আমার যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না আমাদের কামালপুর স্বাধীন হয়ে গেছে। ঘড়িতে তখন সময়টা আনুমানিক ৫টা। 

ahmadistiak1952@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English

Ending impunity for crimes against journalists

Though the signals are mixed we still hope that the media in Bangladesh will see a new dawn.

11h ago