ইউক্রেন যুদ্ধে চেচনিয়ার রমজান কাদিরভের ভূমিকা কী?
রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণের ২ দিনের মাথায় চেচেন প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট রমজান কাদিরভ ঘোষণা দেন, তার দেশের সেনারা যুদ্ধক্ষেত্রে মোতায়েন আছে।
এরপর থেকে চেচনিয়ার এ নেতা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়মিত চেচেন সৈন্যদের ইউক্রেন অঞ্চলে সামরিক ও মানবিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের ভিডিও প্রকাশ করছেন।
কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৪ মার্চ তিনি একদল সেনাসহ নিজের একটি ভিডিও আপলোড করেন। ভিডিওতে দাবি করেন, কিয়েভের কাছাকাছি একটি জায়গায় তিনি চেচেন বাহিনীর সঙ্গে অবস্থান করছেন। তবে, তার এই দাবির সত্যতা যাচাই করা যায়নি এবং পরবর্তীতে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকোভ জানান, কাদিরভের ইউক্রেনে থাকার বিষয়ে তার কাছে কোনো তথ্য নেই।
এর আগেও রুশ বাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চেচেন বাহিনী বিভিন্ন যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। তারা ২০০৮ সালে জর্জিয়ায়, ২০১৪-১৫ সালে ইউক্রেনে এবং সিরিয়ার যুদ্ধেও অংশ নেয়।
তবে পর্যবেক্ষকদের দাবি, সাহসী যোদ্ধা হিসেবে চেচেন বাহিনীর সুনাম থাকলেও ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা নেই। তাদের উপস্থিতি মূলত এক ধরনের জনসংযোগ কার্যক্রম, যেটি একই সঙ্গে কাদিরোভের নিজস্ব রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও ক্রেমলিনের প্রোপাগান্ডার প্রয়োজন মেটাচ্ছে।
কে এই রমজান কাদিরভ?
২০০৭ সালে ক্ষমতায় আসেন কাদিরভ। এর ৩ বছর আগে তার পিতা ও সাবেক চেচেন রাষ্ট্রপতি আখমাদ কাদিরভ আততায়ীর হাতে নিহত হন। পিতা-পুত্র একসঙ্গে প্রথমবরের মতো চেচেন যুদ্ধে (১৯৯৪-৯৬) স্বাধীনতাকামী বাহিনীর পক্ষে অংশ নেন। তবে দ্বিতীয় যুদ্ধের (১৯৯৯-২০০) সময় তারা পক্ষ পালটে রাশিয়ার হয়ে যুদ্ধ করেন এবং তাদেরকে জয়লাভে সহযোগিতা করেন। ফলে চেচনিয়া তাদের স্বল্পকালীন স্বাধীনতা হারায় এবং রাশিয়ান প্রজাতন্ত্রের অন্যতম রাজ্যে পরিণত হয়।
ক্ষমতায় আসার পর থেকে তার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অসংখ্য অভিযোগ এসেছে। ২০১৭ সালে চেচেন প্রেসিডেন্টের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র।
রুশ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ধারাভাষ্যকার কনস্ট্যানটিন ফল এগার্ট জানান, কাদিরভ শক্ত হাতে চেচনিয়া শাসন করেন কিন্তু এ বিষয়ে মস্কোর পক্ষ থেকে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।
'পুতিনের সঙ্গে কাদিরভের বিশেষ রাজনৈতিক সমঝোতার কারণেই পরিস্থিতি এরকম', যোগ করেন এগার্ট।
এগার্ট আরও জানান, চেচনিয়ার যুদ্ধের পর দুই পক্ষের মধ্যে এক অনানুষ্ঠানিক সমঝোতা হয়। রাশিয়া চেচনিয়ার অর্থায়ন করবে এবং চেচনিয়াকে স্বাধীনভাবে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেবে। বিনিময়ে দুই পক্ষ শান্তি বজায় রাখবে।
১৫ বছরের শাসনে কাদিরভ নিজেকে শান্তির দূত হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি নিয়মিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে 'সন্ত্রাসবিরোধী' অভিযান পরিচালনা করেন। তিনি বিভিন্ন বক্তৃতা ও রাজনৈতিক কার্যক্রমে পুতিনের প্রতি তার ভক্তি ও শ্রদ্ধার পরিচয় রেখেছেন।
এগার্ট দাবি করেন, 'কাদিরভের মূল ভূমিকা হচ্ছে পুতিনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ এবং তার সব শত্রু বিনাশের মাধ্যম হিসেবে কাজ করা।'
চেচেন প্রজাতন্ত্র রাশিয়ার কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে বড় আকারে ভর্তুকি পায়, যা বাজেটের ৮৭ শতাংশ পর্যন্তও গেছে।
রাষ্ট্রীয় তহবিল 'আখমাদ কাদিরভ তহবিলে' নিয়মিত ও প্রচুর পরিমাণে অর্থ গেছে। এ ছাড়া চেচেনের সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারীদের বেতনের একটি অংশ আবশ্যিকভাবে এই তহবিলে পাঠানো হয়েছে। মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ এই তহবিলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ধারণা করা হয়, এটাই কাদিরভের অর্থায়নের মূল উৎস এবং তিনি এটি নিজের ব্যক্তিগত কাজের জন্যেও প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করে থাকেন।
অভিযোগ আছে, কাদিরভের জন্মদিনে পশ্চিমের অভিনেতা অভিনেত্রীদের যোগ দেওয়ার জন্য এই তহবিল থেকে অর্থ ব্যয় করা হয়।
ইউক্রেনে 'কাদিরোভতস্কি'
ইউক্রেনে চেচেন বাহিনী মোতায়েনের বিষয়টি ক্রেমলিনের প্রতি কাদিরভের আনুগত্যের আরেকটি নিদর্শন। ২৬ ফেব্রুয়ারিতে পোস্ট করা ভিডিওতে তিনি বলেন, 'প্রেসিডেন্ট (পুতিন) সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং আমরা যেকোনো পরিস্থিতিতে তার নির্দেশ মেনে চলব।'
কাদিরভ দাবি করেন, হাজারো চেচেন স্বেচ্ছাসেবী ইউক্রেনে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত আছে। রাশিয়ার জাতীয় গণ মাধ্যম আরটির দাবি, ১২ হাজার চেচেন সেনা ইউক্রেনে মোতায়েনের জন্য প্রস্তুত আছে। তবে যুদ্ধক্ষেত্রে কত সেনা উপস্থিত আছে, সে ব্যাপারে সঠিক কোনো তথ্য নেই।
বিশ্লেষক হ্যারল্ড চেম্বার্সের মতে, কাদিরভের চেচেন বাহিনী, যাদেরকে 'কাদিরোভতস্কি' নামে ডাকা হয়, কিয়েভের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়া বহরের সঙ্গেই আছে। মারিউপোল শহরেও তাদের উপস্থিতি সম্পর্কে জানা গেছে।
কাদিরভ দাবি করেছেন চেচেন বাহিনী যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে, তবে রাশিয়ার সমর্থনপুষ্ট বিচ্ছিন্নতাবাদী ও কিছু পর্যবেক্ষক এই দাবি মেনে নেননি।
১৫ মার্চ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দোনেৎস্কে রাশিয়ার সমর্থনপূষ্ট বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনীর সাবেক কমান্ডার ইগর গিরকিন জানান, চেচেন সেনারা মারিউপোলের যুদ্ধে অংশ নেয়নি।
১৬ মার্চ এক সাক্ষাৎকারে একই বাহিনীর ভোস্টোক ব্যাটেলিয়নের কমান্ডার আলেকজান্ডার খোদাকোভস্কি জানান, চেচেন সৈন্যরা অপ্রস্তুত অবস্থায় মারিউপোলে এসে পৌঁছান।
তিনি জানান, তারা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে আসেননি। সুন্দর করে সেজেগুজে এসেছেন, সবার মুখে লম্বা দাড়ি ও পরনে সুন্দর পোশাক। আমি চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম, তারা হালকা সাঁজোয়া যান এনেছেন। যুদ্ধক্ষেত্রে টিকে থাকার মতো তেমন কোনো রসদ তাদের সঙ্গে ছিল না।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান কনফ্লিক্ট ইন্টেলিজেন্স টিমের প্রতিষ্ঠাতা রুসলান লেভিয়েভ জানান, তিনি চেচেনদের যুদ্ধে অংশগ্রহণের কোনো তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারেননি।
লেভিয়েভ যোগ করেন, তারা শুধু সম্মুখ যোদ্ধাদের পেছনে দাঁড়িয়ে সুন্দর সুন্দর ভিডিও তৈরি করে, যেখানে তারা জোরে চেঁচিয়ে ওঠে বলতে থাকেন 'আল্লাহু আকবর' এবং 'আখমাদ—শক্তি।'
অন্যান্য বাহিনীর সদস্যরাও নিশ্চিত করেছেন, যুদ্ধক্ষেত্রে কোনো কাদিরোভতস্কির সঙ্গে এখনো তাদের দেখা হয়নি।
জনসংযোগ উদ্যোগ
কাদিরভ বিভিন্ন যুদ্ধ জয়ের দাবি জানানোর পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চেচেন সৈন্যদের মানবিক ত্রাণ বিতরণের ভিডিও পোস্ট করেছেন। তিনি দাবি করেন, এই ত্রাণ সামগ্রী আখমাদ তহবিলের অর্থ ব্যয় করে কেনা হয়েছে।
গণমাধ্যম কাভকাজকিই উজেল মিডিয়া আউটলেটের চিফ এডিটর গ্রিগরি শভেদভ জানান, ইউক্রেনে চেচেন বাহিনীকে সুস্পষ্টভাবে জনসংযোগের কাজ দেওয়া হয়েছে, যেটি তারা বাস্তবায়ন করছেন।
কাদিরভের আনুগত্য ও যুদ্ধের প্রতি প্রবল উৎসাহ দেখানোর বিষয়টি পুতিনের বেশ কাজে আসছে। ইতোমধ্যে রাশিয়ার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্প্রদায়ের একটি অংশ এ যুদ্ধের বিরোধিতা করছে। এ ক্ষেত্রে কাদিরভের বার্তা মানুষকে এ যুদ্ধের প্রতি নমনীয় মনোভাব দেখাতে উৎসাহিত করছে।
গত ১৬ মার্চ রাশিয়ার বিভিন্ন প্রজাতন্ত্র থেকে অর্থনৈতিক সহায়তা পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত এক বৈঠকে কাদিরভ ও অন্যান্য আঞ্চলিক প্রধানরা অংশ নেন। সেখানে পুতিন মাথা ঘুরিয়ে কাদিরভকে তার বিভিন্ন উদ্যোগের জন্য ধন্যবাদ জানান।
শভেদভের মতে, এ থেকে প্রমাণিত হয়, চেচেনদের জনসংযোগ কার্যক্রম শুধু তাদের নিজেদের উদ্যোগ নয়, এর নেপথ্যে রয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে আসা চাহিদা।
বিশ্লেষকদের ধারণা, দেশে ও দেশের বাইরে তথ্য যুদ্ধে জয়লাভের জন্য কাদিরভের জনসংযোগ উদ্যোগ বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেওয়ার চেয়ে তা কোনো অংশে কম নয়।
Comments