কুখ্যাত গুয়ানতানামো বে কারাগার বন্ধ হবে?
গুয়ানতানামো বে কারাগারের নাম শুনলেই মনে পড়ে যায় ভয়ংকর নির্যাতনের শিকার একদল কয়েদির মানবেতর জীবনযাপনের চিত্র। ৯/১১ হামলা পরবর্তী সময়ে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ (সিনিয়র) এই কারাগার চালু করেন।
তবে বর্তমান বাইডেন প্রশাসন নীরবে এই কুখ্যাত কারাগার থেকে সব কয়েদির মুক্তিদানের প্রক্রিয়া চালু করছে অথবা নিদেনপক্ষে এ কার্যক্রমের প্রাথমিক ভিত্তিপ্রস্তর তৈরি করছে।
বার্তা সংস্থা এপি জানায়, কয়েদিদের মুক্তিদান প্রসঙ্গে একটি পর্যালোচনা বোর্ড গঠন করা হয়েছে, যার সদস্য হিসেবে আছেন সামরিক ও গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা।
কিউবায় অবস্থিত মার্কিন সেনা ঘাঁটি সংলগ্ন এ কারাগার থেকে বোর্ডের সদস্যরা বিনা অভিযোগে অনির্দিষ্টকালের জন্য আটক থাকা ৩৯ কয়েদিকে নিরাপদে মুক্তি দিয়ে নিজের দেশে অথবা অন্য কোনো দেশে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করতে আগ্রহী।
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা আটক কয়েদিদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত না নেওয়ার প্রবণতা, তাদেরকে মুক্তিদানের আবেদন নাকচ করা এবং সর্বোপরি এ কারাগারের কার্যক্রম চিরতরে বন্ধ না করতে চাওয়ার কারণে প্রশাসনের কড়া সমালোচনা করেছে। তারা উল্লেখ করে, গত এক বছরে মাত্র ১ জন বন্দীর মুক্তি দিয়েছে গুয়ানতানামো কর্তৃপক্ষ।
কারাগারটিতে এ মুহূর্তে ২০ জন কয়েদি আছেন, যাদেরকে শিগগির মুক্তি দেওয়া বা স্থানান্তর করা সম্ভব। কিছু দেশ হয়তো মুক্তির পরও তাদের দেশের নাগরিকদের (কয়েদি) ফিরিয়ে নিতে রাজি নাও হতে পারে বা রাজি হলেও, তাদের ওপর বিশেষ নিরাপত্তাসূচক নিয়ন্ত্রণ চালু করতে পারে। তবে আগামী কয়েক সপ্তাহ ও মাসে অনেকেই মুক্তি পেতে পারেন।
তাত্ত্বিকভাবে মনে হতে পারে, ৩৯ জন কয়েদিকে মুক্তি দিলেই গুয়ানতানামো বে কারাগার বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু এ ২০ জন বাদে অপর ১০ জনের বিচারিক কার্যক্রম এখনো চলমান। তাদের মধ্যে ৫ জনের বিরুদ্ধে ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার অভিযোগ আছে। একটি সমাধান হতে পারে, দোষ স্বীকারের পর শর্তসাপেক্ষে সবাইকে মুক্তি দেওয়া। কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকে যায়, তাদের কী আরও কিছুদিন জেল খাটতে হবে কিনা।
৯/১১ এর হামলা ও আফগানিস্তানে অভিযান চালানোর পর ২০০২ সালের জানুয়ারিতে জর্জ বুশ এই কারাগার স্থাপন করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল আল-কায়েদা অথবা তালেবানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আসামিদের জেরা করা ও আটক রাখা। প্রায় ৭৮০ ব্যক্তিকে এখানে কোনো না কোনো সময়ে, বিভিন্ন মেয়াদে আটক রাখা হয়েছে। ২০০৩ সালে সর্বোচ্চ ৬৮০ জন কয়েদি এখানে আটক ছিলেন।
বুশের প্রতিরক্ষা সচিব ডোনাল্ড এইচ রামসফেল্ড এ কারাগারে বন্ধী থাকা কয়েদিদের 'নিকৃষ্টদের মধ্যে নিকৃষ্টতম' মানব হিসেবে অভিহিত করে সমালোচিত হন। তবে বাস্তবে আটক ব্যক্তিদের অনেকের সঙ্গেই সন্ত্রাসবাদের কোনো সংযুক্তি ছিল না এবং কিছু কয়েদির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো অভিযোগও দায়ের করা হয়নি।
নির্যাতন ও বৈষম্যের বিভিন্ন ঘটনা প্রকাশ পেতে থাকলে এই কারাগারকে ঘিরে সৃষ্টি হয় সমালোচনার ঝড়। বুশ তার মেয়াদকালে ৫৩২ জন বন্দীকে মুক্তি দেন।
বারাক ওবামা দায়িত্ব নেওয়ার পর গুয়ানতানামো বে কারাগার বন্ধের সংকল্প করেন, কিন্তু তিনি কংগ্রেসের বিরোধিতার শিকার হন। কংগ্রেস সদস্যরা কিউবায় আটক অপরাধীদের দেশে এনে বিচার করা বা কোনো মার্কিন কারাগারে আটক রাখার বিরুদ্ধাচরণ করেন। ওবামার গঠিত নিরীক্ষা বোর্ড ১৯৭ কয়েদিকে মুক্তি দেয়।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে মাত্র ১ জন কয়েদি দোষ শিকারের পর শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পান। জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর এ প্রসঙ্গে তেমন কিছু বলেননি। বস্তুত উত্তর কোরিয়া, ইউক্রেন, চীন ও অন্যান্য বিষয়ের নিচে গুয়ানতানামো বে'র প্রসঙ্গ পাদপ্রদীপের আলো থেকে সরে গেছে। বাইডেনের আমলেও এ যাবত ১ জন কয়েদি মুক্তি পেয়েছেন।
জানুয়ারিতে মানবাধিকার সংস্থাগুলো গুয়ানতানামো বে প্রতিষ্ঠার ২০তম বার্ষিকী পালনের সময় এটি বন্ধের প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে। মূলত এরপর থেকেই পর্দার আড়ালে মার্কিন প্রশাসন ও উল্লেখিত পর্যালোচনা বোর্ড কয়েদিদের মুক্তিদান নিয়ে কাজ শুরু করেছে।
পেন্টাগনের উপপ্রেস সচিব জে টড ব্রিজেল জানান, প্রশাসনের দৃষ্টিতে এটি একটি বিস্তারিত ও সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া, যেটি দায়িত্বশীলতার সঙ্গে আটক ব্যক্তিদের সংখ্যা কমানো এবং গুয়ানতানামো বে কারাগার বন্ধের বিষয়টি নিয়ে কাজ করবে।
দীর্ঘদিন ধরে কারাবন্দী থাকা ৩৯ জন কয়েদি এখন তাদের নিয়তির অপেক্ষায় আছেন।
Comments