অদ্ভুত কিছু সিনড্রোম
মন এবং আচরণকে প্রভাবিত করে এমন যেকোনো ধরনের জটিলতাকে বলে মানসিক ব্যাধি। মানসিক রোগের উপসর্গগুলো মানসিক বা শারীরিক লক্ষণ অথবা উভয় প্রকারেই প্রকাশ পেতে পারে। এরকম কয়েকটি অদ্ভুত মানসিক জটিলতা হলো-
এলিয়েন হ্যান্ড সিন্ড্রোম
এ ধরনের মানসিক সমস্যায় ভোগা মানুষ নিজের একটা হাতের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে; তাদের কাছে মনে হতে থাকে সেই হাত বুঝি অন্য কারও আজ্ঞাবহ। এ অবস্থায় তারা হয়তো মনেপ্রাণে চান আক্রান্ত হাত চুপটি করে থাকুক, কিন্তু দেখা যায় সেই হাতটি তা না করে ওই ব্যক্তির চোখ ডলছে, গালের চামড়া টানছে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে এ ধরনের মানসিক জটিলতাকে বলে এলিয়েন হ্যান্ড সিন্ড্রোম। যার প্রথম বর্ণনা পাওয়া যায় ১৯০৮ সালে জার্মানির মনোরোগবিদ কার্ট গোল্ডস্টেইনের এক গবেষণামূলক প্রতিবেদনে।
কোনোভাবে মাথায় আঘাত পেয়ে মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোব, প্যারাইটাল লোব এবং অক্সিপিটাল লোব ক্ষতিগ্রস্থ হলে কিংবা ব্রেইন সার্জারি, স্ট্রোক, মস্তিষ্কে ইনফেকশন, টিউমার ইত্যাদির কারণে এ ধরনের সমস্যা হতে পারে।
সাধারণত, অ্যালিয়েন হ্যান্ড সিন্ড্রোম বয়স্কদের আক্রমণ করলেও শিশুদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার নজির রয়েছে। তবে কারও ক্ষেত্রে এই জটিলতায় হাতের পরিবর্তে পা'ও আক্রান্ত হতে পারে।
ট্রাইকোটিলোম্যানিয়া
ট্রাইকোটিলোম্যানিয়া বা যা চুল-উপড়ানো নামেও পরিচিত। ট্রাইকোটিলোম্যানিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে দেখা যায় নিজের চুল টেনে ছিঁড়তে। সাধারণত, অনিয়ন্ত্রিত তাড়নার কারণে আক্রান্ত ব্যক্তি এ ধরনের কাজ করতে থাকেন। যাদের ট্রাইকোটিলোম্যানিয়া আছে তারা ঠিকই বুঝতে পারেন যে চুল উপড়িয়ে নিজেদের বিভৎস ক্ষতি করছেন, কিন্তু তারা তাদের এমন কার্যক্রমকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত হলে ট্রাইকোটিলোম্যানিয়ার রোগীদের মাথার চুল এমনকি চোখের পাপড়ি টেনে তুলে ফেলার মানসিক জটিলতা আরও তীব্র হয়।
পাইকা
কোনো কোনো ব্যক্তিকে দেখা যায় পুষ্টিগুণ নেই এ ধরনের বা খাবার অযোগ্য বিভিন্ন বস্তু খেতে। আদতে তারা পাইকা নামে এক মানসিক জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে এমন খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলেন। এ ধরনের সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তির পছন্দের খাবার হয়ে উঠতে পারে মাটি, সাবান, উনুনের ছাই ও কাঁচসহ বিভিন্ন জিনিস। পাইকায় আক্রান্ত অনেকে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্যন ও ধাতু খেতে পছন্দ করেন। ফলে তারা বিষক্রিয়াসহ বিভিন্ন ধরনের তীব্র শারীরিক জটিলতায় ভুগতে থাকেন।
সাধারণত শিশু এবং গর্ভবতী নারীরা এ ধরনের মানসিক জটিলতায় আক্রান্ত হয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা ক্ষণস্থায়ী সময়ের জন্য এ ধরনের প্রবণতায় আক্রান্ত হন। তবে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশকেন্দ্রিক সমস্যায় ভোগা ব্যক্তিসহ অনেকের ক্ষেত্রে আবার পাইকার প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হয়।
মানসিক এই জটিলতার নাম পাইকা দেওয়ার ক্ষেত্রে ম্যাগপাই পাখির সর্বভুক বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। ল্যাটিন ভাষায় ম্যাগপাইকে পাইকা বলা হয়।
পাইরোমেনিয়া
আরেকটি বিরল মানসিক জটিলতার নাম পাইরোমেনিয়া। পাইরোমেনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি সবকিছুতে আগুন ধরিয়ে দিতে চান। তার এই চাওয়া ঘটে থাকে নিজের আবেগ-ইচ্ছা, তাড়নাকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পারার ব্যর্থতা থেকে। বিভিন্ন জিনিসে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা সে ঘটাতে থাকে বারবার। পাইরোমেনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের কাছে আগুন তীব্র আকর্ষণ সৃষ্টি করে। কোনো কিছুকে আগুনে পুড়তে দেখলে তারা আনন্দ পায়, নিজেদের অশান্ত চিত্ত শান্ত হয়। পাইরোমেনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রায়শই দেখা যায় বিভিন্ন ধরনের আগুন উৎসের আশেপাশে থাকতে।
ক্লিনিক্যাল লাইকানথ্রোপি
তীব্র মানসিক এক জটিলতার নাম হচ্ছে ক্লিনিক্যাল লাইকানথ্রোপি। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি ভাবেন তারা নেকড়ে, হায়েনা, কুমির, বৃষের মতো কোন এক প্রাণী হয়ে যাচ্ছেন অথবা ইতোমধ্যে হয়ে গেছেন। আক্রান্ত ব্যক্তি ক্রমাগত প্রচণ্ড বিভ্রান্তি, হতাশায় ভুগতে থাকেন। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের বিভিন্ন প্রাণীর ডাক ও আচরণ অনুকরণ করতে দেখা যায়।
ইতিহাসের বিবরণীতে পারস্যের বুইয়ি সাম্রাজ্যের শেষ আমির আবু তালিব রুস্তম এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন বলে জানা যায়। আরও, জানা যায় যে, আবু তালিব রুস্তম একটা সময় নিজেকে গরু হিসেবে ভাবতে শুরু করেছিলেন এবং ইবনে সিনা নাকি তাকে এই রোগ থেকে সারিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন।
Comments