‘১ কোটি কার্ড কোন বিবেচনায় নির্ধারণ করা হয়েছে, বোধগম্য নয়’
করোনা মহামারির সঙ্গে গত ২ বছর ধরে লড়াই করছে মানুষ। সেই ধাক্কা সামাল দিতে চিকিৎসা, বাসস্থান ও বস্ত্রের মতো মৌলিক চাহিদাগুলোতে ব্যয় কমিয়ে ফেলেছে দেশের জনসংখ্যার বড় একটা অংশ।
গত নভেম্বরে প্রকাশিত দ্য পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) পরিচালিত এক সমীক্ষার তথ্য অনুসারে, করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ দেশের ৩ কোটি মানুষকে দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
এই ধাক্কা সামাল দিতে না দিতেই নতুন আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, চিনিসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্য এবং গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির দাম। দ্রব্যমূল্য ও জীবনযাত্রার বাড়তি ব্যয়ের কারণে নিম্ন আয়ের মানুষের এখন দিন চলাই দায়, নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে মধ্যবিত্ত পরিসরেও।
এ অবস্থায় কম দামে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে দেশের এক কোটি মানুষকে বিশেষ কার্ড প্রদানের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত মঙ্গলবার গণভবনে ১৪ দলের নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে এই পরিকল্পনার কথা জানান তিনি।
কোভিড-১৯ মহামারি চলাকালীন ৩৮ লাখ লোক আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'এদের সঙ্গে আরও অনেককে অন্তর্ভুক্ত করা হবে এবং শেষ পর্যন্ত মোট এক কোটি মানুষ এই কার্ড পাবে।'
বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক বিনায়ক সেনের সঙ্গে।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সরকারের এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন এই অর্থনীতিবিদ ও বিশিষ্টজনেরা। তবে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন এর সম্ভাব্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে। তাই অতীত অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে তারা এই কার্ডের সুবিধাভোগী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সব ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, স্বজনপ্রীতি ও দলীয় বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠে নিয়মতান্ত্রিকভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অপব্যবহার করা না হলে এটি অবশ্যই ভালো একটি উদ্যোগ। তবে কার্ড বণ্টনের কাজটি অবশ্যই ভালোভাবে করতে হবে। যারা কর্মকর্তা আছেন বা রাজনৈতিক নেতা আছেন শুধু তাদের আত্মীয়-স্বজন কার্ড পেলে এর যথাযথ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হবে না। কোনো ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়ম যেন না হয় সেই বিষয়টি নজরে রাখতে হবে।'
তিনি আরও বলন, 'এক কোটি পরিবার কার্ড পাবে মানে ৪ থেকে ৫ কোটি লোক এই সুবিধার আওতায় আসবেন। যেহেতু সামনে রমজান মাস, তাই রমজানে মাসে যেসব পণ্য বেশি ব্যবহৃত হয় সেগুলোই যেনো দেওয়া হয়।'
২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারির শুরুতে নগদ অর্থ সহায়তার প্রয়োজন আছে এমন ৫০ লাখ পরিবারের একটি তালিকা তৈরি করা হয়। সরকারের মাঠ-পর্যায়ের কর্মকর্তারা ওই তালিকা তৈরি করেন। তালিকায় ছিলেন— রিকশাচালক, দিনমজুর, নির্মাণশ্রমিক, কৃষক, দোকান কর্মচারী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও পরিবহন শ্রমিক।
ওই বছরের ১৪ মে প্রধানমন্ত্রী এই অর্থ বিতরণ কাজের উদ্বোধন করেন। তবে, টাকা বিতরণে অনিয়ম ও তালিকায় অনেক সচ্ছল ব্যক্তির নাম থাকায় মাঝপথে এই কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়।
পরে, অর্থ বিভাগ সেই তালিকা কয়েক পর্যায়ে যাচাই-বাছাই করে ১৪ লাখ ৩২ হাজার নাম বাদ দেয়। এরপর ৩৪ লাখ ৯৭ হাজার ৩৫৩ জনের চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করা হয়।
বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'এই (১ কোটি কার্ড বিতরণ) কার্যক্রমের ব্যবস্থাপনা নিয়ে অবশ্যই সরকারকে অনেক বেশি সজাগ থাকতে হবে। এ ধরনের কার্যক্রমে অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, স্বজনপ্রীতি বেশি হয়ে থাকে। করোনাভাইরাসের কারণে সারা দেশের ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র পরিবারকে যে নগদ সহায়তা দেওয়া হয়েছিল, তা নিয়ে আমরা একটি জরিপ করেছিলাম। আমাদের জরিপে দেখা যায়, ৮১ শতাংশ মানুষ মনে করেন এই সুবিধাগুলো দলীয় বিবেচনায় দেওয়া হয়। প্রকৃত ব্যক্তিরা সুবিধা পান না।'
এ ছাড়া কেন কেবল ১ কোটি মানুষকেই এই কার্ড দেওয়া হবে- এমন প্রশ্ন তুলে ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, 'এই সংখ্যাটি কিসের বিবেচনায় নির্ধারণ করা হয়েছে, তা বোধগম্য হচ্ছে না। এই তালিকা স্বাভাবিকভাবেই আরও বড় হওয়ার কথা। কারণ করোনা মহামারির কারণে অনেকেরই আয় কমে গেছে। দরিদ্রতা বেড়ে গেছে। অনেকেই নতুন করে দারিদ্র্য সীমার মধ্যে প্রবেশ করেছেন।'
তাই এই কার্যক্রমের আওতায় গ্রামের পাশাপাশি শহর ও শহরতলীর মানুষকে অন্তর্ভূক্ত করার পাশাপাশি তালিকাটি সম্প্রসারিত করার তাগিদ দেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান। তার বক্তব্য, 'বণ্টন প্রক্রিয়া ভালোভাবে করতে হবে। যাতে করে প্রকৃত লোকজনই এই সুবিধা পান।'
কীভাবে তালিকা করলে প্রকৃত ব্যক্তিরা এই সুবিধা পাবেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'তালিকা তৈরির জন্য সরকারি কর্মকর্তা ও দলীয় ব্যক্তিদের পাশাপাশি নির্বাচিত প্রতিনিধি, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, স্কুল কলেজের শিক্ষক এবং এনজিও কর্মীদের রাখা যেতে পারে। সবকিছু বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। এ ছাড়া এটি যেনো শুধু ২-১ মাস দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া না হয়। এর সময়সীমাও যেনো আরও বাড়ানো হয়।'
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক বিনায়ক সেনের পরামর্শ হলো, এর ভেতর দিয়ে আগে নিম্নবিত্ত মানুষকে কাভার করতে হবে। তারপর আসবে নিম্নমধ্যবিত্ত।
তিনি বলেন, 'এখন মুশকিল হলো, আমাদের এই ডেটাবেইজটা এখনো পর্যন্ত হয়নি। আমরা বহুদিন ধরে বলছিলাম যে এনআইডি কার্ডের (জাতীয় পরিচয়পত্র) সঙ্গে যদি সোশ্যাল প্রোটেকশনের (সামাজিক সুরক্ষা) ইনফরমেশনটা যুক্ত করা হতো, তাহলে বোঝা যেত কাদের কাদের এই কার্ড দেওয়া যায়।
'আমাদের সোশ্যাল প্রোটেকশন বেনিফিশিয়ারির একটা তালিকা আছে। গ্রামে-শহরে বিভিন্ন প্রকল্পের আছে। এর পরিমাণ ১ কোটির উপরে হবে। সেটার মাধ্যমেই তাদের কাছে পৌঁছানো যাবে। শহর এলাকায় এমন মানুষের সংখ্যা কম হবে। কারণ, শহর এলাকায় তো সোশ্যাল প্রোটেকশন নাই। ফলে এখানে আমাদের একটু বেশি জোর দিতে হবে,' যোগ করেন তিনি।
বিনায়ক সেন আরও বলেন, 'ঢাকাসহ বিভিন্ন নগরের যে নিম্নবিত্ত এলাকা বা বস্তি, সেখানে যেন টিসিবির ট্রাক দাঁড়ায় সেই ব্যবস্থা করতে হবে। এমন এলাকাগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে যেন কার্ড বিতরণ করা হয়। এই সুবাদে এনআইডি কার্ডের সঙ্গে সোশ্যাল প্রোটেকশন প্রোগ্রামগুলো সংযুক্ত করার বিষয়টি সরকার ভাবতে পারে। এক্ষেত্রে শহর এলাকায় ৪০ লাখ ও গ্রাম এলাকার ৬০ লাখ মানুষকে এই কার্ড দেওয়া যেতে পারে। যেন একটা ভারসাম্য থাকে '
এই অর্থনীতিবিদের ভাষ্য, শহরের কোন এলাকার মানুষের গড় আয় কেমন সেই তথ্য বিবিএসের আছে। সে হিসেবে এলাকা ও সুবিধাভোগী বাছাই করা যেতে পারে।
এর পাশাপাশি টিসিবির ট্রাকের সংখ্যা বাড়ানো ও আনুষঙ্গিক ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দেওয়ার তাগিদ দেন তিনি।
Comments