সংক্রমণ বৃদ্ধির সময়ে শিথিলতার পরিণতি কী
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির মতামত উপেক্ষা করে আরোপিত ‘কঠোর লকডাউন’ শিথিল করেছে সরকার। সেই সঙ্গে রাজধানীর পাশাপাশি সারা দেশে কোরবানির পশুর হাটও বসেছে।
সড়কে, ঘাটে ঘরমুখী মানুষের উপচে পড়া ভিড়। গণপরিবহনগুলোতেও ঠাসাঠাসি অবস্থা। পশুর হাটেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা কিংবা এ সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনার কোনো চিহ্ন চোখে পড়ছে না।
বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিশেষজ্ঞ তৌফিক জোয়ারদার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খানের সঙ্গে।
তারা বলছেন, জনস্বাস্থ্যের দিক থেকে এটা খুবই বাজে একটা সিদ্ধান্ত। জুলাইয়ের শুরু থেকে আরোপিত লকডাউনের প্রভাব ও সংক্রামক রোগের স্বাভাবিক গতি-প্রকৃতি অনুসারে চলতি মাসের মধ্যভাগ থেকে সংক্রমণ কমে আসার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এমন একটা সিদ্ধান্তের কারণে সংক্রমণ কমার বদলে তা আরও বেড়ে যেতে পারে।
একই সঙ্গে তাদের অভিমত হলো, এমন একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনে জনকল্যাণের চেয়ে সরকারের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের বিষয়টিই মুখ্য হয়ে উঠেছে।
এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ তৌফিক জোয়ারদার বলেন, ‘যে কোনো সংক্রামক রোগের একটা গতি-প্রকৃতি থাকে। এক ধরনের ম্যাথমেটিকাল মডেল দিয়ে মোটামুটি প্রেডিক্ট করা যায়। সেই মডেল অনুসারে আমাদের এক ধরনের প্রেডিকশন আগে থেকেই ছিল যে, জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময় থেকে সংক্রমণটা কমে আসবে। কিন্তু যেভাবে সবকিছু খুলে দেওয়া হলো, জনস্বাস্থ্যের দিক থেকে সেটা খুব একটা ভালো সিদ্ধান্ত না।’
পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশনের প্রধান গবেষক তৌফিক আরও বলেন, ‘লকডাউন শিথিল মানে রাস্তাঘাট খোলা থাকবে, মার্কেট খোলা থাকবে, পশুর হাট খোলা থাকবে। এগুলোকে সংক্রমণ ছড়ানোর একেকটা মোক্ষম উৎস বলা যায়। সুতরাং, স্বাভাবিকভাবে সংক্রমণ যেভাবে কমার কথা ছিল, সেভাবে কমবে না। এতে হঠাৎ করেই আমরা একটা উত্থান দেখতে পারি। দেখা যাবে কোনো একটা সপ্তাহ থেকে রোগী হঠাৎ করে বেড়ে গেছে।’
একই সঙ্গে এই বিশেষজ্ঞের বক্তব্য, ‘গ্রামীণ অর্থনীতির সঙ্গে কোরবানির পশু ক্রয়-বিক্রয়ের একটা বড় সম্পর্ক আছে। ওটাকে ইগনোর করা কঠিন। এটা অনেকের সারা বছরের বিনিয়োগ। এটা আপনি বন্ধ করে দিতে পারেন না। কিন্তু হাট বসানোর ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে যে স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চলার কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের উদ্যোগ কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি না।’
এই পরিস্থিতিতে ‘হাত গুটিয়ে বসে না থেকে’ যথাযথ ব্যবস্থাপনার আওতায় হাট-বাজার-গণপরিবহনসহ সবখানে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বাধ্য করার জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান তৌফিক।
এ ক্ষেত্রে তার পরামর্শ, ‘জনপরিসরে চাপ কমাতে ছুটি বাড়ানো যেতে পারে। সরকারি উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনার আওতায় গণপরিবহনের সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে। পশুর হাটে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য যে নির্দেশনাগুলো দেওয়া হয়েছে, সেগুলো কঠোরভাবে তদারকির ব্যবস্থা করা যেতে পারে।’
তৌফিক জোয়ারদার সংক্রমণ প্রতিরোধে কেবল লকডাউনকেই একমাত্র সমাধান বলে মনে করেন না। তার মতে, ‘লকডাউনের আগেও অনেক কিছু করার থাকে। কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং, নতুন কোনো ধরন আসলে সেটাকে আটকানোর ব্যবস্থা করা— এমন নানাকিছু। এসব কিছু ব্যর্থ হলে তখন লকডাউনের প্রশ্ন আসতে পারে। আমরা সেগুলোর কিছুই না করে কেবল লকডাউনের ওপরেই বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি।’
লকডাউন শিথিল ও গরুর হাট বসানোর সরকারি সিদ্ধান্তের ব্যাপারে অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান বলেন, ‘এর আগেও আমরা দেখেছি, যখন সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি থাকে, তখন সবকিছু শিথিল করে দেওয়া হয়। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, এই ধরনের সমস্যা থেকে আমরা কীভাবে বের হবো, তার কোনো এক্সিট প্ল্যানও সরকারের নেই।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপকের পর্যবেক্ষণ হলো, ‘আসলে কোভিড হয়ে গেছে একটা পলিটিক্যাল উইপেন। এটা যে একটা মহামারি, এর যে একটা স্বাস্থ্যগত দিক আছে, এ সবকিছু ছাপিয়ে এটা এখন একটা রাজনৈতিক বিষয় হয়ে উঠেছে। পুরোমাত্রায় রাজনৈতিক স্বার্থ ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এটাকে বিবেচনা করা হচ্ছে। সিদ্ধান্তগুলোও ওভাবে নেওয়া হচ্ছে।’
তানজিম উদ্দিন খানের অভিমত, ‘সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার একটা সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে এই মহামারি। এ ধরনের সংক্রমণ মোকাবিলায় যেভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, সর্বমানুষের কল্যাণের জন্য, সেটা আদতে নেই।’
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এই শিক্ষক আরও বলেন, ‘যদি সেটাই হতো, তাহলে যখন আমাদের সংক্রমণ বাড়ছে, মৃত্যুর হার বাড়ছে তখন পশুর হাট কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে খামারিদের ভর্তুকি বা ক্ষতিপূরণ দেওয়া যেতো, কিংবা অন্য কোনো ব্যবস্থাপনা বা উপায় বের করা যেত। আর এ ব্যাপারে মানুষকে বোঝানোর দায়িত্ব তো সরকারেরই।’
এ ছাড়া জরুরি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে জাতীয় পরামর্শক কমিটির ভূমিকা প্রসঙ্গে তানজিম উদ্দিন খান বলেন, ‘যে কমিটি আছে, সেটা সিদ্ধান্ত প্রণয়নের ক্ষেত্রে তেমন কোনো ভূমিকাই তো রাখতে পারছে না। তারা যেটা বলছে তার উল্টো কাজটাই করছে সরকার। আমলাতন্ত্রের তো এখানে ভূমিকা রাখার কোনো জায়গা নেই। তারা কেবল সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ব্যবস্থা নিতে পারে। এখন তারাই যদি সিদ্ধান্ত দিয়ে দেয়, তাহলে ওনারাই তো সবকিছু করতে পারেন। বাকিদের তো প্রয়োজন নেই।’
Comments