শাহজালাল বিমানবন্দরে ই-গেট: কার্যকর পদ্ধতির অকার্যকর প্রয়োগ!

ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করার জন্য শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ১৫টি ই-গেট স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল এই ই-গেট ব্যবহারে ইমিগ্রেশন পার হতে সময় লাগছে আরও বেশি।

কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? ই-গেট কী কার্যকর নয়, নাকি পরিকল্পনায় রয়েছে গোলযোগ?

বিভিন্ন দেশের ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে থাকা ই-গেট হচ্ছে এক ধরনের গেট, যা ই-পাসপোর্ট এবং পাসপোর্টধারীকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুব দ্রুত শনাক্ত করতে পারে। এর ফলে একজন ই-পাসপোর্টধারী যাত্রী বিমানবন্দরে থাকা ইমিগ্রেশন গেট নিজ থেকেই দ্রুততার সঙ্গে অতিক্রম করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে তাকে পাসপোর্ট ও অন্যান্য কাগজপত্র যাচাইয়ের জন্য কোনো ইমিগ্রেশন অফিসারের কাছে যেতে হয় না।

সহজ কাজকে দ্রুততার সঙ্গে সম্পাদনের জন্য এবং ব্যস্ত বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন চেকআপ ত্বরান্বিত করার জন্যই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সীমান্তে ই-গেট স্থাপন করা হচ্ছে। পাসপোর্টে কোনো জটিলতা না থাকলে এবং সঠিকভাবে গেট ব্যবহার করলে এই ই-গেট অতিক্রম করতে গড়ে সময় লাগে মাত্র ১৫-২০ সেকেন্ড।

হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে সম্প্রতি উদ্বোধন করা হয়েছে ই-গেট সিস্টেম, যা ১৮ সেকেন্ডের মধ্যেই অতিক্রম করা সম্ভব। তবে ৯ জুন দ্য ডেইলি স্টারের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই ই-গেটের ব্যবহার ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া সম্পন্নের সময় না কমিয়ে বরং আরও ১৮ সেকেন্ড বাড়িয়ে দিয়েছে।

অর্থাৎ যে সমস্যা নিরসনের জন্য এত টাকা ব্যয় করে ই-গেট স্থাপন করা হয়েছে তার সমাধান তো হলোই না, বরং সমস্যা আরও প্রকট হলো।

বিস্তারিত প্রতিবেদনটি পড়ে বোঝা গেল, ই-গেটগুলো মূলত ভুল যায়গায় স্থাপন করার কারণেই ইমিগ্রেশন অতিক্রমে পূর্বের চেয়ে আরও বেশি সময় লাগছে।

শাহজালাল বিমানবন্দরে ডিপারচার এলাকায় ১২টি এবং অ্যারাইভাল এলাকায় ৩টি ই-গেট স্থাপন করা হয়েছে। আর এর ফলেই ঘটছে যত বিপত্তি। উচিত ছিল সবগুলো, অর্থাৎ ১৫টি ই-গেটই অ্যারাইভাল এলাকায় বসানো। ইমিগ্রেশনের ডিপারচার এলাকায় বর্তমান টেকনোলজিতে ই-গেটের ব্যবহার ফলপ্রসূ নয়।

বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন মানুষ যায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। বিভিন্ন দেশের জন্য রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ভিসা পদ্ধতি। নিয়ম অনুযায়ী, ভিসা ছাড়া বাংলাদেশের পাসপোর্টধারী কোনো যাত্রী বাংলাদেশের কোনো ইমিগ্রেশন বর্ডার অতিক্রম করতে পারেন না। সুতরাং ইমিগ্রেশনের ডিপারচার গেট অতিক্রম করতে বহির্গামী যাত্রীদের অবশ্যই ভিসার বৈধতা যাচাই করার প্রয়োজন পরে।

এই ভিসা যাচাই পদ্ধতি জটিল এবং ম্যানুয়ালি ভিসা স্টিকার বা রেসিডেন্স পারমিট পরীক্ষা করতে হয়। এই জটিল কাজটি ই-গেটের মাধ্যমে করা সম্ভব নয়। আর এই কারণেই ডিপারচারের ই-গেট অতিক্রম করার পর সকল যাত্রীকে আবার পূর্বের মতোই ইমিগ্রেশন ডেস্কে যেতে হচ্ছে পাসপোর্ট ও ভিসা প্রদর্শন এবং যাচাইয়ের জন্য। এ ক্ষেত্রে ই-গেটের ব্যবহার রিডান্ডেন্ট বা অপ্রয়োজনীয় হয়ে পরছে। আর এর কারণেই সময় লাগছে আগের চেয়ে বেশি।

আমি গত কয়েক বছর ধরে যুক্তরাজ্যের ই-গেট ব্যবহার করছি। যুক্তরাজ্যের বিমানবন্দরগুলোতে সারিবদ্ধভাবে ই-গেট বসানো হয়েছে অ্যারাইভাল জোনে। আমার ব্রিটিশ ই-পাসপোর্ট থাকায় আমি যে দেশ থেকেই আসি না কেন, নিজেই পাসপোর্ট স্ক্যান করে সোজা পার হয়ে যাই ইমিগ্রেশন গেট। আর সেটাও ১৫ সেকেন্ডের ভেতরেই।

তবে যারা ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বা ব্রিটিশ নাগরিক নয়, তাদের ই-পাসপোর্ট থাকলেও এই ই-গেট ব্যবহার করতে পারেন না। তাদেরকে যেতে হয় ইমিগ্রেশন অফিসারের কাছে, যেখানে ভিসা চেক করে তাদেরকে দেশের অভ্যন্তরে ঢুকতে দেওয়া হয়। যুক্তরাজ্যে প্রায় ২৭০টিরও বেশি ই-গেট বসানো হয়েছ ১৫টি বিমানবন্দরের অ্যারাইভাল গেটে। যাতে দ্রুততার সঙ্গে আগত যাত্রীরা দেশে প্রবেশ করতে পারেন।

যুক্তরাজ্যের বিমানবন্দরগুলোর ডিপারচার এলাকাতে কোনো ই-গেটের ব্যবহার নেই। কারণ বহির্গমন বা ডিপারচারের সময় চেক-ইন ও ভিসা পরীক্ষা বাধ্যতামূলক। অনলাইনে চেক-ইন করা গেলেও ডিপারচারের সময় অবশ্যই চেক-ইন ডেস্ক বা ইমিগ্রেশনে ভিসা প্রদর্শন করতে হয়। এটা ছাড়া উড়োজাহাজে ওঠার জন্য পুরো চেক-ইন প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয় না।

এই পদ্ধতিগত বাধ্যবাধকতার কারণেই যুক্তরাজ্যে ডিপারচার এলাকায় কোনো ই-গেট নেই। বাংলাদেশে কোন যুক্তিতে ডিপারচার এলাকায় এতগুলো ই-গেট বসানো হলো তা বোধগম্য নয়।

অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও অ্যারাইভাল জোনে ই-গেট ব্যবহার করে আগত প্রবাসীদের নিজ দেশে প্রবেশ ত্বরান্বিত করা যায় বহুগুণ। বাংলাদেশে প্রতিদিন হাজারো মানুষ আসছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে। তাদের সিংহভাগই বাংলাদেশি প্রবাসী এবং বাংলাদেশের পাসপোর্টধারী। বিমানবন্দরে তাদেরকে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ইমিগ্রেশন চেকের জন্য। অনেক সময় ব্যয় হয় অবরোহণ বা ডিসএম্বার্কেশন কার্ড পূরণে।

শাহজালাল বিমানবন্দরের অ্যারাইভাল জোনে যদি সবকটি ই-গেট স্থাপন করা হতো তাহলে আগত ই-পাসপোর্টধারী বাংলাদেশিদের আর লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হতো না, দরকার পরতো না ডিসএম্বার্কেশন কার্ড পূরণেরও। সবকিছুই হতো স্বয়ংক্রিয়ভাবে। তারা সোজা পাসপোর্ট স্ক্যান করে নিজে নিজেই ইমিগ্রেশন পার হয়ে যেতে পারতেন ১৮ সেকেন্ডেই।

দুঃখের বিষয়, শাহজালাল বিমানবন্দরের অ্যারাইভাল জোনে বসানো হয়েছে মাত্র ৩টি ই-গেট। আর যেখানে দরকার নেই সেখানে বসানো হয়েছে ১২টি। যার ফলে ই-গেটের সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন হাজারো যাত্রী। শোনা যাচ্ছে, দেশের বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরগুলোতে মোট ৫০টি ই-গেট স্থাপন করা হবে। এসব ই-গেট স্থাপনের আগে অবশ্যই সঠিক পরিকল্পনা দরকার।

আর যে গেটগুলো শাহজালাল বিমানবন্দরের ডিপারচার জোনে ইতোমধ্যে বসানো হয়েছে সেগুলোকে অ্যারাইভাল জোনে প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ই-গেটগুলোর সঠিক ব্যবহার না করতে পারলে ইমিগ্রেশনে জটিলতা কমবে তো না-ই, আরও বাড়বে।

ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম, সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য

Comments

The Daily Star  | English

Nowfel gained from illegal tobacco trade

Former education minister Mohibul Hassan Chowdhoury Nowfel received at least Tk 3 crore from a tobacco company, known for years for illegal cigarette production and marketing including some counterfeit foreign brands.

3h ago