‘রাস্তায় কোনো সমস্যা নাই, শুধু টাকা বেশি লাগে’

গাবতলি ব্রিজ থেকে আমিনবাজার ঢাল পর্যন্ত সারি সারি প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, পিকআপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। ২৯ জুলাই ২০২১। ছবি: শাহীন মোল্লা/ স্টার

ঈদের ছুটি শেষে কঠোর লকডাউন উপেক্ষা করে প্রতিদিনই ঢাকায় ছুটছেন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের হাজারো কর্মজীবী মানুষ। একইভাবে অনেকে আবার ঢাকা ছেড়েও যাচ্ছেন।

গত বুধবার ও বৃহস্পতিবারে রাজধানীর গাবতলি ও আমিনবাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাস ছাড়া অন্য সব ধরনের গাড়িতেই যাত্রী আনা-নেওয়া চলছে। গাবতলি ব্রিজ থেকে আমিনবাজার ঢাল পর্যন্ত সারি সারি প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, পিকআপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। মূলত এখান থেকে যাত্রী নিয়ে এই যানবাহনগুলো দেশের বিভিন্ন জেলায় রওনা দেয়।

সারাদিন যাত্রীদের আনাগোনা থাকলেও সন্ধ্যার পরে ভিড় বাড়তে থাকে।

কঠোর লকডাউনে ঢাকা ছাড়ার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কয়েকজন যাত্রী ও চালক বলেন, 'যত কঠোর লকডাউনই হোক না কেন, চাইলেই দেশের যেকোনো জায়গায় যাওয়া সম্ভব। খরচ একটু বেশি হয়। দিনে পুলিশের আনাগোনা বেশি থাকে। সেজন্য রাতে রওনা দিলে সুবিধা।'

অর্ধেক পথ মোটরবাইক, বাকিটা লেগুনা বা সিএনজিতে করে বাড়িতে যাচ্ছেন অনেকে। কেউবা সরাসরি মাইক্রো, পিকআপ বা ট্রাকে চড়ে যাচ্ছেন।

গত বৃহস্পতিবার আমিনবাজারে অপেক্ষা করছিলেন সুজা মিয়া। মিরপুর টোলারবাগে একটি হার্ডওয়ার দোকানের কর্মচারী তিনি। লকডাউনে দোকান বন্ধ থাকায় পরিবার নিয়ে তিনি বাড়ি চলে যাচ্ছেন।

দ্য ডেইলি স্টারকে সুজা মিয়া বলেন, 'আরিচাঘাট পর্যন্ত গাড়ি নিয়ে যাব। নদী পার হয়ে গেলে আর সমস্যা নাই। লেগুনা আছে, সিএনজি আছে। এসবে ভেঙে ভেঙে বাড়িতে যাওয়া যাবে।'

আরিচাঘাট পর্যন্ত জনপ্রতি ৪০০ টাকা ভাড়ায় পরিবারের পাঁচ জনের জন্য মোট দুই হাজার টাকা দিয়ে একটি প্রাইভেট কার ভাড়া করেছেন তিনি।

আমিনবাজারে গাড়ির খোঁজে এসেছিলেন শাহজাহান (৪০) নামে আরেক যাত্রী। শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে ঈদের দিন ঢাকার শাহজাহানপুরে ইসলামি ব্যাংক হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর নিজ বাড়ি যশোরে ফিরে যাবেন। অ্যাম্বুলেন্সে করে গাবতলিতে এসেছেন।

অ্যাম্বুলেন্সে করেই যশোরে ফিরছেন না কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'অ্যাম্বুলেন্স ১৫ হাজার টাকা চায়। আমি এখন মোটামুটি সুস্থ। আমার সঙ্গে দুই ভাই আছে। আমরা দর কষাকষি করে ছয় হাজার টাকায় একটি প্রাইভেট কার ভাড়া করেছি। ঠিক বাসার সামনেই নামিয়ে দেবে।'

তবে চালক আরও দুজন যাত্রী খুঁজছেন বলে জানান তিনি।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চালক বলেন, 'এই গাড়ির ভাড়া দিতে হবে তিন হাজার টাকা। যাওয়ার সময় পেট্রোল খরচ আছে এক হাজার। আসার সময় যাত্রী পেলে ভালো, কিছুটা লাভ হবে। নাহলে আরও এক হাজার টাকা পেট্রোল খরচ যাবে। এদিকে, দালালকে ৫০০ টাকা দিতে হচ্ছে। কারণ সে যাত্রী জোগাড় করে দিয়েছে। অন্য সময়ে সাধারণত ১০ হাজারের নিচে যাই না। তাই এখন আরও দুজন যাত্রী খুঁজছি।'

গাবতলি ব্রিজের সামনে গেলেই দেখা যায়, যাত্রী সংগ্রহের জন্য অনেক মানুষ রংপুর, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলার নাম ধরে চিৎকার করছেন। তাদের বেশিরভাগই বাস টার্মিনালের হেল্পার বা কন্ডাকটর। লকডাউনে কর্মহীন হয়ে পড়ায় যাত্রী সংগ্রহের কাজ করছেন তারা। অ্যাম্বুলেন্স, প্রাইভেট কার চালকের সঙ্গে তারা চুক্তিতে কাজ করেন। একেকজন যাত্রী সংগ্রহ করে দেওয়ার জন্য তারা ১০০ থেকে ১৫০ টাকা নিয়ে থাকেন।

গাবতলিতে একটি বাস পরিবহন প্রতিষ্ঠানে হেল্পার হিসেবে কাজ করতেন হাসান মিয়া। এখন তিনি মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কারে যাত্রী সংগ্রহের কাজ করেন।

দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'লকডাউনের সময় পার্মানেন্ট কর্মচারীরা বেতন পায়। আমি এখনও পর্যন্ত কোনো টাকা পাই নাই। আমাদের যতক্ষণ কাজ ততক্ষণ পয়সা। বাইরের কোনো সাহায্যও পাই নাই। আমার সংসার আছে, দুই সন্তান আছে। আমিনবাজারে আমি ভাড়া বাসায় থাকি। এ অবস্থায় কীভাবে চলবো? বাসা ভাড়া কীভাবে দিব? তাই এখানে যাত্রী যোগাড়ের কাজ করছি।'

হাসান মিয়া রেন্ট-এ-কার, মাইক্রোবাস, পিকআপের জন্য বিভিন্ন রুটের যাত্রী যোগাড় করেন। এগুলোর বেশিরভাগই রাতে চলে। তিনি বলেন, 'একটা মাইক্রোবাসে ১২ থেকে ১৩ জন উঠায়। প্রতি যাত্রী থেকে ১০০ টাকা করে পাই। এখন যাত্রী কম। যাত্রী যোগাড় করতে কষ্ট হয়। দেখা যায়, একজন রংপুর যাবে, একজন বগুড়া, একজন রাজশাহী। তিন জন, তিন রুট। তখন তিন জন ড্রাইভার খুঁজে দিতে হয়।'

তিনি আরও বলেন, 'ড্রাইভার ভাড়া চায় বগুড়ার জন্য ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা, রংপুর ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা এমন। যাত্রীরা এতো টাকায় যেতে যায় না। তাদেরকে ভালো সার্ভিস, এসি আছে এ ধরনের কথাবার্তা বলে রাজি করতে হয়। আবার দু-একজন যাত্রী পাওয়ার পরেও কয়েকজন হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। সবমিলিয়ে বেশ কষ্ট।'

গাবতলি, আমিনবাজার ও কল্যাণপুর এলাকা ঘুরে এমন শতাধিক মানুষকে দিনেরাতে যাত্রী সংগ্রহের কাজ করতে দেখা গেছে।

হাসান মিয়া বলেন, 'গত মঙ্গলবারে মাত্র ৫০০ টাকা আয় হয়েছে। পাঁচ জন যাত্রী যোগাড় করতে পেরেছি। যাত্রীর চেয়ে গাড়ি বেশি। তাই ভাড়ায় মিলে না।'

পুলিশ ধরলে কী হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'পুলিশ ধরলে ড্রাইভার বুঝবে। আমাদের কাজ যাত্রী যোগাড় করে দেওয়া। যাত্রী যোগাড় করে দেওয়ার পর ড্রাইভার আমাদের নগদ টাকা দিয়ে দেয়।'

হাইওয়ে পুলিশের চেকপোস্ট সম্পর্কে জানতে চাইলে এক ট্রাকচালক বলেন, 'পুলিশ প্রাইভেট কার খুব একটা সন্দেহ করে না। দিনে তাও মাঝেমধ্যে থামায়। সেজন্য রাতে সুবিধা।'

তুলনামূলকভাবে সচ্ছল যাত্রীরা মাইক্রোবাস কিংবা প্রাইভেট কার ভাড়া করে ঢাকা ছাড়লেও মালবাহী ট্রাক কিংবা পিকআপেই যেতে হচ্ছে নিম্নআয়ের মানুষকে।

কেরানীগঞ্জের রিকশাচালক সিরাজ মিয়া (৩৫) বলেন, 'লকডাউনে রিকশা চলবে শুনে ঢাকায় থেকে গিয়েছিলাম। কিন্তু দিনে যে টাকা আয় হয় তাতে নিজে চলতে পারি কিন্তু সংসার চালানো যায় না। শুনেছি লকডাউন বাড়বে। তাই পরিবার নিয়ে বগুড়া বাড়িতে চলে যাচ্ছি।'

তিনি বলেন, 'অন্য রিকশাচালকদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করার পর তারা বলছে, হাজারের নিচে মাইক্রো কিংবা কার পাওয়া যায় না। ট্রাকে তিনশ-সাড়ে তিনশ টাকায় যাওয়া যায়। তাই ট্রাকের জন্য অপেক্ষা করছি।'

ঝিনাইদহ থেকে কারওয়ান বাজারে মালামাল নামিয়ে আমিনবাজারে ট্রাক নিয়ে এসেছেন এক চালক। তিনি বলেন, 'আমি যশোর যাব। এখান থেকে যাত্রী যে কয়জন পাবো, নিবো। ভাড়া জনপ্রতি ৩০০ টাকা করে। পথে যাত্রী পেলে ভালো।'

রাত ১০টার দিকে মালামাল নামিয়ে দিয়ে সারি সারি ট্রাকগুলো এখানে জড়ো হতে থাকে। তারপর বিভিন্ন রুটে রওনা হয়। রাত ২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত এখানে ট্রাক আসে। একেকটি ট্রাকে ২০ থেকে ২৫ জন যাত্রী নেওয়া হয়।

ট্রাকে যাত্রী সংগ্রহের জন্যও কাজ করেন অনেকে। তারা যাত্রী প্রতি ৫০ টাকা করে পান। অনেক সময় ট্রাকচালক নিজেই যাত্রীদের ডাকেন।

ট্রাকের জন্য অপেক্ষায় থাকা এক যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জে একটি ভবনে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করছিলেন তিনি। বলেন, 'এখন কাজ শেষ। অন্য জায়গায় কাজ খুঁজেছি, কিন্তু পাইনি। তাই রংপুরে নিজ বাড়িতে চলে যাচ্ছি।'

তার সঙ্গে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করা আরও নয় জন আছেন বলে জানান তিনি তিনি। জনপ্রতি ভাড়া ৩০০ টাকা দিয়েছেন তারা।

প্রয়োজন ছাড়াও অনেকেই ঢাকার বাইরে ঘুরতে যাওয়ার জন্য ঢাকা ছাড়ছেন। আমিনবাজারে অনেক তরুণ যাত্রীদের কাঁধে ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপের পর জানা গেছে, লকডাউনে একঘেয়েমি চলে আসায় তারা ঢাকার বাইরে বেড়াতে যাচ্ছেন।

এ ছাড়া, আর্থিকভাবে সচ্ছল অনেকেই ঢাকার বাইরে বেড়াতে যাচ্ছেন। শুরুতে স্বীকার না করলেও পরে কেউ কেউ জানায়, 'বাড়িতে ঘুরতে যাচ্ছি। এতোদিন যাইনি। ভেবেছিলাম এই লকডাউনে সময় কেটে যাবে। কিন্তু সময় কাটে না। তাই বেড়াতে যাচ্ছি। লকডাউন শেষ করে ফিরবো।'

লকডাউন প্রসঙ্গে তারা জানায়, 'রাস্তায় কোনো সমস্যা নাই। শুধু টাকা বেশি লাগে। টাকা খরচ করলে বাংলাদেশের যেকোনো জায়গায় যাওয়া যাবে। পুলিশ ধরলে সেখানেও কিছু পয়সা দিতে হবে।'

হাইওয়ে পুলিশের উর্ব্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলার চেষ্টা করা হলে তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

সাভার হাইওয়ে থানার উপ পরিদর্শক সাইফুল ইসলাম বলেন, 'আমাদের চোখে এভাবে চলাচল করা খুব বেশি চোখে পড়ে না। তারপরও এমন কোনো ঘটনা হলে আমরা মামলা দিচ্ছি।'

পুলিশকে টাকা দিয়ে এসব গাড়ি চলার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'হাইওয়ে পুলিশ টাকা নেওয়ার সাহসই করবে না।'

তিনি আরও বলেন, 'আগামীকাল থেকে গার্মেন্টস খোলা। শ্রমিকরা যারা বাড়ি ছিলেন তারা ঢাকা আসছেন। তাদের আমরা কিভাবে বাধা দেই।'

Comments

The Daily Star  | English

Fire service & civil defence: High-risk job, low pay

Despite risking their lives constantly in the line of duty, firefighters are deprived of the pay enjoyed by employees of other departments, an analysis of their organograms shows.

8h ago