বিদ্রোহী প্রার্থীদের দমাতে পারছে না আওয়ামী লীগ
কারণ দর্শানোর নোটিশ, বহিষ্কার, ভবিষ্যতে দলীয় পদ-পদবী এবং মনোনয়ন না পাওয়া, দলের গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করে কোনো নোটিশ ছাড়াই দল থেকে বহিষ্কার, তৃণমূল থেকে সমঝোতার ভিত্তিতে কেন্দ্রে নাম পাঠানো—এতো সব উদ্যোগ নিয়েও বিদ্রোহী প্রার্থীদের দমন করতে পারছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলে সবার মধ্যে ক্ষমতার প্রতিযোগিতা, কেন্দ্রে নাম পাঠানোর সময় স্বজন পোষণ, স্থানীয় রাজনীতিতে গ্রুপিং, বিরোধী দলগুলোর নির্বাচনের মাঠে না থাকা এবং দলের চেইন অব কমান্ডের অভাবের কারণেই বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা বাড়ছে এবং এগুলোই বিদ্রোহী প্রার্থী না ঠেকাতে পারার কারণ বলে মনে করেন দলের নেতারা।
বরাবরের মতো দ্বিতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ৮৪৮ ইউপিতে প্রায় ৯০০ আওয়ামী লীগ নেতা বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন।
দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা ও বিদ্রোহী প্রার্থী ঠেকাতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২০১৬ সালে দলীয় গঠনতন্ত্র সংশোধন করে দলের প্রতীকের বিরুদ্ধে নির্বাচন করা দলীয় নেতাদের সরাসরি বহিষ্কারের ধারা অন্তর্ভুক্ত করে। তারপরেও, বিদ্রোহী প্রার্থী দমন করতে পারেনি আওয়ামী লীগ।
শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতারা আশা করছেন আগামীকালের মধ্যে বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা কমে আসবে। ১৭ অক্টোবর ছিল মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন এবং আগামীকাল ২৬ অক্টোবর মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহারের শেষ সময়। ২৭ অক্টোবর নির্বাচন কমিশন প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রতীক বরাদ্দ দেবে।
গত সেপ্টেম্বরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সতর্ক করে বলেন, দল বিদ্রোহীদের শক্ত হাতে দমন করবে। তিনি আরও বলেন, বিদ্রোহীরা দলে কোনো পদ পাবেন না। তাদেরকে ভবিষ্যতে মনোনয়নও দেওয়া হবে না।
তবে নিশ্চিতভাবেই, এই সতর্কবাণী কোনো কাজে আসেনি।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রাজ্জাক দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার কারণেই এতো বিদ্রোহী প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।
তিনি বলেন, 'বিএনপিকে প্রতিপক্ষ হিসেবে পেলে আওয়ামী লীগ নেতারা আরও বেশি একতাবদ্ধ থাকতেন।'
তিনি জানান, দল দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকার কারণে তৃণমূল পর্যায়ে নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে।
তিনি আরও জানান, আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এমন কোনো প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়নি, যিনি আগে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিমও এ কথার সঙ্গে একমত হন। নির্বাচনে বিরোধী দলের অনুপস্থিতির কারণেই মূলত এই প্রবণতা দেখা দিয়েছে।
তবে তিনি আশা করেন, কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এই বিষয় নিয়ে কাজ করছে এবং শিগগির এর সমাধান হবে।
আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের জন্য আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, প্রথম ধাপের ইউপি নির্বাচনে অনেক বিদ্রোহী প্রার্থী দলের মনোনীত প্রার্থীদের পরাজিত করেছেন।
২০ সেপ্টেম্বর ১৬০টি ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম ধাপের ইউপি নির্বাচন মহামারির কারণে বিলম্বিত হয়েছিল। ব্যাপক সহিংসতার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে কক্সবাজারে ২ জনের মৃত্যু হয়।
সেই নির্বাচনে বেশিরভাগ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী বিদ্রোহীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হয়েছিলেন। ২১ জুন অনুষ্ঠিত ২০৪টি উপজেলা পরিষদের নির্বাচনের সময়ও পরিস্থিতি একইরকম ছিল।
আমাদের সংবাদদাতাদের তথ্য অনুযায়ী, আসন্ন ইউপি নির্বাচনে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এর মধ্যে ৮টি ইউনিয়নে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
তাদের মধ্যে আছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও যশোর-২ আসনের সংসদ সদস্য নাসির উদ্দিনের ভাই একেএম গিয়াস উদ্দিন। তিনি মাগুরা ইউপি থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। তিনি চৌগাছার ১১টি ইউপির ১৯ জন বিদ্রোহীদের মধ্যে একজন।
কুষ্টিয়ার মিরপুর ও ভেড়ামারার ১৭টি ইউপিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই ২ উপজেলায় রয়েছেন ১৩ জন বিদ্রোহী প্রার্থী।
মিরপুরের পোড়াদহ ইউপিতে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান পদের জন্য প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পান শারমিন আক্তার। কিন্তু স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ারুজ্জামান বিশ্বাস মজনু স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
মজনুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, যাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে তৃণমূল পর্যায়ে তার কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই এবং কর্মীরা তাকে (মজনুকে) চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য 'জোর' করেছেন।
তবে মজনু জানান তিনি তার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিতে পারেন।
মানিকগঞ্জের সিংগাইরে ১১টি ইউপিতে চেয়ারম্যান পদের জন্য ৪৬ জন প্রার্থী তাদের মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। সূত্র জানিয়েছেন, ৮টি ইউপিতে ১৩ জন আওয়ামী লীগ নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
জয়মন্টপ ইউপিতে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হচ্ছেন শাহাদাত হোসেন। সেখানে আরও ২ জন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তাদের মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
২ নেতার একজন বোরহান উদ্দিন ফকির অভিযোগ করেন, টাকার বিনিময়ে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, 'তৃণমূল পর্যায়ের নেতা ও কর্মীদের চাপে পড়ে আমি মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছি।'
তিনি আরও অভিযোগ করেন, তাকে একটি শ্রেণীর স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ভয়ভীতি প্রদর্শন করছেন এবং মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করতে বলেছেন।
শেরপুর সদরে ৭ জন বিদ্রোহী প্রার্থী ৬টি ইউপিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
জাতীয় সংসদের হুইপ মো. আতিউর রহমান আতিকের বড় ভাই মো. ইসমাইল হোসেন কামারিয়া ইউনিয়ন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
সূত্র জানিয়েছে, রাজশাহীর তানোর ও গোদাগাড়ীর ১৬টি ইউপিতে নির্বাচন হতে যাচ্ছে।
রাজশাহী-১ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীর চাচাতো ভাই খাদেকুন্নবী বাবু চৌধুরী তানোরের কলমা ইউপিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।
পাবনার সুজানগর উপজেলার ১০ ইউপিতে ৩৩ জন বিদ্রোহী প্রার্থী আছেন। সাতবাড়িয়া ইউপিতে বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে আছেন আওয়ামী লীগের পাবনা-২ আসনের সংসদ সদস্য আহম্মেদ ফিরোজ কবিরের ছোট ভাই আহমেদ ফেরদৌস কবির।
অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments