ভোগান্তির আরেক নাম নাটোর-বগুড়া মহাসড়ক
সড়কপথে উত্তরবঙ্গের সঙ্গে খুলনা ও বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোর যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম নাটোর-বগুড়া মহাসড়ক। গত ২ বছর ধরে এই মহাসড়ক প্রশস্তের কাজ চলছে। কাজ শেষ করতে এরই মধ্যে একদফা সময় বাড়ানো হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত ৫০ শতাংশ কাজ শেষ হয়নি।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের সূত্রগুলো জানায়, ২০২০ সালের জুনে নাটোর-বগুড়া মহাসড়কের প্রস্থ ১৮ ফুট থেকে ৩৪ ফুটে উন্নীত করার কাজ শুরু হয়। ২ জেলায় ৬২ কিলোমিটার মহাসড়কের মধ্যে ৩১ কিলোমিটার নাটোরে ও বাকি অংশ বগুড়ায়।
প্রতিষ্ঠান ২টি ৬ দশমিক ৩ কিলোমিটার সড়ক প্রশস্ত করতে ৮১ কোটি টাকার কাজ পেয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৩ দশমিক ২ কিলোমিটার সড়কে ৪ লেন হচ্ছে। পুরো প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে প্রায় ৭৪০ কোটি টাকা।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে কাজের সময়সীমা যখন শেষ হয় তখন ২৫ শতাংশ কাজও শেষ হয়নি। পরে ঠিকাদারদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বাড়ায় সড়ক ও জনপথ বিভাগ। সময় শেষ হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে ৫০ ভাগের কম কাজ শেষ করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর হাবিবুল ইসলাম বিল্ডার্স ও রানা বিল্ডার্স।
মহাসড়কের কাজ শেষ না হওয়ায় ধুলোয় যাত্রীদের ভোগান্তির পাশাপাশি যানবাহন বিকল হয়ে পড়ে থাকছে। অসুস্থ রোগী পরিবহন তো দূরের কথা সুস্থ মানুষ এই সড়কে চলাচল করলেও অসুস্থ হয়ে পড়ছে। ধুলোবালি নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত পানি ছিটানো হচ্ছে না।
চুক্তি ভঙ্গ করে সড়কের পাশ থেকে মাটি কাটা নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর ২০২১ সালের ১৩ জুন নাটোরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবু সাঈদ স্বপ্রণোদিত হয়ে মামলা গ্রহণ করে নাটোরের পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)-কে তদন্তের আদেশ দেন।
পরে তদন্তকারী কর্মকর্তা ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। অভিযোগপত্রে সরকারের দেড় কোটি টাকা ক্ষতিসাধনের কথা বলা হয়। অভিযোগপত্র গ্রহণ করে নাটোরের অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এ এফ এম গোলজার রহমান অভিযোগ গঠন করে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু করেন।
একই সঙ্গে সড়ক ও জনপথ বিভাগের কোনো কর্মকর্তার অবহেলা বা অপরাধ থাকলে তা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলীকে।
পরে সড়ক বিভাগের ২ উপ-সহকারী প্রকৌশলীকে বদলি করা হলেও আর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সড়ক ও জনপথ বিভাগ। অন্যদিকে মীর হাবিবুল আলম ও মো. আলমের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হলে তারা হাইকোর্ট থেকে জামিন নেন।
এরই মধ্যে আসামিপক্ষ চার্জ গঠনের বিরুদ্ধে রিভিশন আবেদন করলে জেলা ও দায়রা জজ মো. শরীফ উদ্দীন মামলার অভিযোগ ভিত্তিহীন মর্মে পর্যবেক্ষণ দিয়ে চার্জ গঠনের আদেশ রহিত করেন এবং আসামিদের অব্যাহতি দেন।
নাটোরের সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি রনেন রায় দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে মামলা গ্রহণ করার পর ঠিকাদার ও সড়ক বিভাগের কর্মকর্তারা নড়েচড়ে বসেছিলেন। পরে আবার কাজ থমকে যায়। মন্ত্রিসভার এক সদস্য নানা সময় সড়ক বিভাগের কর্মকর্তাদের আল্টিমেটাম দিলেও লাভ হয়নি।
সিংড়া উপজেলার পাঁচবাড়িয়া এলাকার বাসিন্দা আনিসুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, সড়কের ২ পাশ থেকে মাটি কেটে সড়ক প্রশস্ত করেছে ঠিকাদাররা। ২ পাশের সেই খাল বেশিরভাগ জায়গায় আর ভরাট করা হয়নি।
ঠিকাদার মীর হাবিবুল আলম ওরফে বখতিয়ারের দাবি সড়কের পাশে মাটি তিনি পুরোপুরি ভরাট করে দিয়েছেন। নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাড়ায় কাজ শেষ করতে দেরি হচ্ছে। আবারও সময় বাড়ানোর আবেদন করবেন বলে ডেইলি স্টারকে জানান তিনি।
নাটোরের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুর রহিম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঠিকাদার নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না করায় মানুষের চরম ভোগান্তি হচ্ছে। সেকারণে ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করতে প্রকল্প পরিচালককে সুপারিশ করেছি।'
নাটোর-বগুড়া মহাসড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্পের পরিচালক এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের রাজশাহী বিভাগীয় অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. সাদেকুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঠিকাদারের চুক্তি বাতিল করতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। নির্ধারিত সময় এবং বর্ধিত সময় পার হলেও কাজের অগ্রগতি মাত্র ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ। আমরা জনদুর্ভোগ দূর করাকে গুরুত্ব দিচ্ছি। চুক্তি বাতিলের চিঠি দেওয়ার পরও ঠিকাদারের কাজ সন্তোষজনক নয়।'
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মামলার তদন্তে আসামিদের অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। তারা অপরাধ স্বীকার করে সড়কের মাটি কিছু অংশে ভরাট করেছে। তাদের শাস্তি হওয়া উচিত।'
Comments