রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আতঙ্ক ও ঘৃণা
ব্যাপারটা এ রকম না যে সম্প্রতি একজন জনপ্রিয় নেতার হত্যাকাণ্ডের পর থেকে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দাদের মনে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। অনিয়ন্ত্রিত অপরাধ, বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব ও নিরাপত্তার অভাবে সব সময়ই ক্যাম্পের বাসিন্দারা আতঙ্কে থাকেন।
তবে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসর (এআরএসপিএইচ) চেয়ারম্যান মুহিব উল্লাহ গত সপ্তাহে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ায় পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। ফলশ্রুতিতে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পে সক্রিয় বিভিন্ন অপরাধী গোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্যমান উত্তেজনা ও সার্বিকভাবে নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়ার বিষয়গুলো এখন সবার সামনে উন্মোচিত হয়েছে।
মুহিব উল্লাহর হত্যাকাণ্ডের পর সম্প্রতি এই সংবাদদাতা ক্যাম্পগুলোতে সরেজমিনে পরিদর্শন করে প্রায় ১০০ জন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলেন। তাদের বেশিরভাগই অভিমত দিয়েছেন, আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সশস্ত্র দলগুলোর তৈরি করা ত্রাসের রাজত্বের কারণে সম্প্রতি ক্যাম্পগুলোতে নিরাপত্তা পরিস্থিতি আগের চেয়েও অনেক খারাপ হয়ে গেছে।
উখিয়ার ৭ নং ক্যাম্পের বাসিন্দা জাকির হোসেন বলেন, 'আমরা নিজেদের জীবন বাঁচাতে দেশ ছেড়ে এখানে এসেছি। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, আমাদের ভাগ্যের খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। এখানেও আমরা সারাক্ষণ ভয়ে আছি।'
জাকির ক্যাম্পের মুদি দোকানি। পিনপতন নীরবতায় আচ্ছন্ন ক্যাম্পে বসে পরিস্থিতির বর্ণনা দেন জাকির। তিনি বলেন, 'সূর্য ডোবার আগেই আমি আমার দোকান বন্ধ করে ঘরে ফিরে যাই। সন্ধ্যা নেমে আসার পর অপরাধী দলগুলো টহলে বের হয় এবং ক্যাম্প একটি ভয়ংকর রূপ ধারণ করে।'
'যেখানে আমাদের সবার একই উদ্দেশ্য নিয়ে একতাবদ্ধ থাকার কথা, সেখানে আমরা বিভাজিত। আমরা একে অপরের ওপর ভরসা রাখতে পারছি না', বলেন জাকির। তিনি দাবি করেন, ২০১৭ সালে মিয়ানমারে ১০০ একরের মতো জমি ফেলে তিনি এখানে এসেছেন।
বাসিন্দাদের মধ্যে ভরসার এতটাই অভাব যে, জাকির এমনকি তার পাশের বাড়ির প্রতিবেশীর সঙ্গেও খুব একটা কথা বলেন না। তার নিকটতম প্রতিবেশী মিয়ানমারে তার বাড়ি থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরের একটি জায়গা থেকে এসেছেন, জানান জাকির।
রোহিঙ্গাদের বেশিরভাগই জানায়, ক্যাম্পের বেশির ভাগ সশস্ত্র দল আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সদস্য এবং তারা মুহিবকে প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করতো।
গতকাল একটি বক্তব্যে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায়, মুহিবের মৃত্যুর পর জাতিসঙ্ঘের এই শরণার্থী সংস্থার কাছে কমপক্ষে এক ডজন মানবাধিকার কর্মী নিরাপত্তা চেয়েছে। কারণ হিসেবে তারা আরসাসহ অন্যান্য সশস্ত্র দলগুলোর কাছ থেকে নতুন করে আসা হুমকির কথা উল্লেখ করেছেন।
বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কমপক্ষে ১০টি রোহিঙ্গা দল অন্তত ১২ ধরনের অপরাধে যুক্ত, যার মধ্যে রয়েছে হত্যাকাণ্ড, অপহরণ, ধর্ষণ, মাদক চোরাকারবার ও ডাকাতি।
রোহিঙ্গারা জানায়, কয়েকটি দল 'সালমান শাহ গ্রুপ', 'পুটিয়া গ্রুপ', 'মুন্না গ্রুপ', 'হাকিম গ্রুপ' ও 'জাকির গ্রুপ' নামে পরিচিত।
২০১৭ আগস্ট থেকে শুরু করে অন্তত ২২৬ জন রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে এবং মাদক ও অস্ত্র চোরাকারবারে যুক্ত থাকার অভিযোগে ২ হাজার ৮৫০ জনের বিরুদ্ধে ১ হাজার ২৯৮টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) ৩টি ব্যাটালিয়ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার দায়িত্ব পালন করে। ২০১৭ সাল থেকে শুরু করে এই ক্যাম্পগুলোতে প্রায় ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছেন।
এপিবিএন-১৪ এর কমান্ডিং অফিসার নাইমুল হক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ক্যাম্পগুলো এতটাই জনবসতিপূর্ণ যে যখনই আমরা কোনো অভিযান চালাই, তারা (অপরাধীরা) এক ক্যাম্প থেকে আরেক ক্যাম্পে চলে যায় এবং মানুষের ভিড়ে হারিয়ে যায়।'
ক্যাম্পগুলোর চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া আছে, কিন্তু অনেক জায়গায় বেড়ায় এমন ফুটো রয়েছে যাতে ফাঁক গলে মানুষ সহজে বাইরে চলে যেতে পারে।
'রোহিঙ্গারা বেড়ায় কমপক্ষে ১২টি ফুটো তৈরি করেছে। যখনই আমরা একটি মেরামত করি, তারা আরেকটি তৈরি করে। সরকার বেড়ার পাশ দিয়ে হাঁটার পথ তৈরি করছে। এটি হলে টহল জোরদার করে অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধ করা সম্ভব হবে', বলেন তিনি।
নাইমুল আরও বলেন, বেশিরভাগ অপরাধ সংঘটিত হয় রাত ৮টার পরে। ক্যাম্পে আলোর স্বল্পতা থাকায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাজটি আরও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
তিনি আরও জানান, শিগগির কক্সবাজার ও ভাসান চরে আরও ২ ব্যাটালিয়ন আর্মড পুলিশ মোতায়েন করা হবে।
ক্যাম্পে এক দিন
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৫০টি ওয়াচ টাওয়ার আছে। ক্যাম্পে প্রবেশ করার আগে যে কোনো ব্যক্তিকে সম্পূর্ণ নিরাপত্তা তল্লাশির মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
এই সংবাদদাতাকে ২ অক্টোবর নৌকার মাঠ ক্যাম্পে প্রবেশ করার আগে অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার এবং এপিবিএন-১৪ এর কমান্ডিং অফিসারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়েছে।
একটি মুদি দোকানের সামনে বসে গল্প করতে করতে ৩ তরুণ জানান, ক্যাম্পে সব কিছুই ঠিকভাবে চলছে। লম্বা সময় ধরে তাদের সঙ্গে কথা বলার পর এই সংবাদদাতা তাদের একটি নিকটবর্তী চায়ের দোকানে আপ্যায়ন করতে চাইলে তারা সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করেননি।
২৫ বছর বয়সী রোহিঙ্গা তরুণ এই সংবাদদাতাকে বলেন, 'আমি যদি আপনার সঙ্গে গিয়ে চা খাই, তাহলে আমি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার গুপ্তচর ও বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত হবো। আমি বিপদে পড়ে যাব।' এই কথা বলে তিনি অস্বস্তির সঙ্গে এদিক-ওদিক তাকাতে থাকেন।
তিনি আরও বলেন, 'ক্যাম্পের সব জায়গায় অপরাধীরা আছে এবং তারা রোহিঙ্গাদের চলাফেরার ওপর নজর রাখে। আপনি যদি তাদের তালিকায় থাকেন, তাহলে আপনি বিপদে আছেন।'
অপরাধীদের বিরুদ্ধে কথা বলার মতো সাহস কারো নেই জানিয়ে তিনি বলেন, 'দিনের বেলায় সব কিছু শান্ত মনে হয়। সূর্যাস্তের পর পরিস্থিতি পুরোপুরি বদলে যায়।'
লাম্বাশিয়া ক্যাম্পের বাসিন্দা মোহাম্মদ ফয়সাল বলেন, 'রোহিঙ্গাদের একতাবদ্ধ থাকা উচিত ছিল। কিন্তু আমরা নিজেরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করছি এবং আরও দুর্বল হয়ে পড়ছি।'
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর আগ্রাসনের শিকার হয়ে পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা সে দেশ থেকে পালিয়ে আসে। তারা এর আগে একই ধরনের আক্রমণের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা ৩ লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে যোগ দিয়ে কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়।
ইতোমধ্যে অস্ত্র, মাদক ও মানব পাচার বন্ধে মিয়ানমার সীমান্তে আগামীতে গুলি চালানো হবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ. কে আব্দুল মোমেন।
তিনি বলেন, 'গতকাল (সোমবার) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বর্তমান সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে আমার আলাপ হয়েছে, এবং (আমরা) সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আগামীতে আমরা গুলি চালাবো। শুধুমাত্র এভাবেই অপরাধগুলো থামানো সম্ভব।'
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার বলেন, কক্সবাজারের অসংখ্য রোহিঙ্গা মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত।
অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments