মেহমানখানায় এবার ১১ গরু, ৬ হাজার মানুষের মুখে হাসি
‘মেহমানখানা’ মানেই নিম্ন আয়ের মানুষের ঈদ। আর সেটা যদি সত্যি সত্যিই ঈদের দিন হয় তাহলে তো কথাই নেই। আজ বুধবার ঈদুল আজহার দিনে মেহমানদের জন্য দিনভর সেখানে ছিল গরুর মাংস আর খিচুড়ির বিশেষ আয়োজন। এখানে মেহমান মানে নিম্ন আয়ের মানুষ, রিকশাচালক, অসহায় এতিম কিংবা হতে পারেন যে কেউ। মেহমানখানার দরজা তাদের জন্য সবসময় খোলা।
মেহমানখানার আয়োজকরা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, বুধবার দুপুর থেকে শুরু হয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় ছয় হাজার মানুষকে ৪১ জন স্বেচ্ছাসেবক খাইয়েছেন। ১১টি গরুর মাংস আর খিচুড়ির বিশেষ আয়োজন যেন শুধু পেটের ক্ষুধা নয়, ঈদের দিনের মনের ক্ষুধাও যেন মিটিয়েছে আজকের ‘মেহমানদের’।
রিকশাচালক আবু সাঈদের কথায় সেই আনন্দই যেন ফুটে উঠলো। বললেন, ‘এই ঢাকা শহরে গরিব মানুষকে যে কেউ এতো যত্ন করে খাওয়ায়, সেটা এখানে না এলে বোঝা যাবে না।’
সাঈদ জানালেন, তিনি ঢাকায় রিকশা চালান। ঈদে বাড়ি যাননি। ঈদের দিন দুপুরে খেতে এসেছেন মেহমানখানায়। এর আগেও তিনি এখানে খেয়েছেন।
আট বছরের শিশু ইয়াসিন হাতে মুখে মাখিয়ে খিচুড়ি আর গরুর মাংস খাচ্ছিল। উচ্ছ্বাস নিয়ে জানাল, ঈদের দাওয়াত খেতে এখানে এসেছে।
আদাবরের মনসুরাবাদ থেকে আসা বিপ্লব হোসেন জানান, রান্না খুবই দারুণ হয়েছে। পেটের খিদে মিটেছে, সঙ্গে মিটেছে ঈদের দিনের কষ্টও।
আগত সাধারণ মানুষদের প্লেটে খাবার দিচ্ছিলেন ইজাজ আহমেদ। পেশায় প্রকৌশলী ইজাজ মেহমানখানার আয়োজক স্বেচ্ছাসেবকদের একজন। বুধবার সন্ধ্যায় দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, ‘চারটা গরু জবাই হয়েছিল। আরও সাতটা গরুর মাংস নানা জায়গা থেকে লোকজন এখানে পাঠিয়ে দিয়েছেন। দুপুর থেকে প্রায় ছয় হাজার মানুষকে খাওয়ানো হয়েছে। একটার পর একটা ব্যাচ বসছেই। স্বেচ্ছাসেবকরা শারীরিকভাবে কিছুটা ক্লান্ত হলেও, মানসিকভাবে খুব আনন্দে আছেন।’
আগতদের প্লেটে করে খাবার পৌঁছে দিচ্ছিলেন স্বেচ্ছাসেবক আহসান হাবিব মুরাদ। দুপুরে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এই শহরের কিছু মানুষ আনন্দ নিয়ে খাচ্ছে এবং এমন একটি মহৎ কাজে আমরা থাকতে পারছি এটা আমার জীবনের বিশেষ আনন্দ।’
অবশ্য শুধু এবারের কোরবানির ঈদ নয়, গত এক বছর ধরেই লালমাটিয়ার ডি ব্লকে ‘মেহমানখানা’র এই আয়োজন চলছে। এ বছরের রমজানে প্রতিদিন দেড় থেকে দুই হাজার মানুষ এই মেহমানখানায় ইফতার করেছেন বিনামূল্যে।
ঈদের দিনের পর সপ্তাহে দুদিন এই কর্মসূচি চললেও ১ জুলাই লকডাউনের পর থেকে মেহমানদের খাওয়ানোর উদ্যোগ অব্যাহত আছে।
আয়োজকরা জানান, ২০২০ সালের মার্চে কোভিডের সময় যাত্রা শুরু হয় মেহমানখানার। থিয়েটার কর্মী আসমা আক্তার লিজা, বেসরকারি একটি সংস্থার কর্মী সৈয়দ সাইফুল আলম শোভন, সৈয়দ শামসুল আলম, ইজাজ আহমেদসহ আরও অনেকেই এই উদ্যোগ নেন।
মেহমানখানা শুরুর ভাবনা নিয়ে সম্পর্কে আসমা আক্তার লিজা জানান, গত বছর করোনা মহামারি শুরু হলে তার ভাবনায় নিম্ন আয়ের মানুষরা আলোড়ন তোলে। তখন বাসায় এসে রান্না করে নানা জায়গায় খাবার দিয়ে আসতেন। প্রথম দিকে একশ-দুইশ মানুষ, এরপর রোজায় প্রতিদিন দেড় থেকে দুই হাজার মানুষকে ইফতার করানো হয়।
আয়োজকরা জানান, যখন লকডাউন দেওয়া হয়, তখনই ধারাবাহিকভাবে আয়োজন চলে।
আসমা আক্তার লিজা গতকাল সন্ধ্যায় দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমরা প্রমাণ করেছি এই দেশের মানুষ পরস্পরকে ভালোবাসতে জানে। এই যে ঈদে ১১টা গরু এলো, এগুলো কেউ না কেউ পাঠিয়েছেন। আমরা ৪১ জন স্বেচ্ছাসেবক শুধু শারীরিক পরিশ্রম করেছি। আগামী তিন দিন এই আয়োজন অব্যাহত রাখতে চাই।
‘আমরা চাই এই শহরের নিম্ন আয়ের মানুষ মনে করুক তাদের জন্য কেউ আছে। মহামারির এই সময়ে সবার ভালোবাসায় যেন ভালো থাকে দেশের প্রতিটি মানুষ,’ বলেন তিনি।
শরিফুল হাসান: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
Comments