অনাহারই টোকাইদের একমাত্র সমস্যা নয়
খাবারের চেয়েও নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে রাজধানীর পথশিশুদের কাছে। রাস্তা থেকে আবর্জনা সংগ্রহকারী এসব শিশু অর্থাৎ ‘টোকাই’ দের ক্ষুধার কষ্টের চেয়েও সারাক্ষণ তাদের চারপাশে ওৎ পেতে থাকা বিপদ নিয়েও উদ্বিগ্ন থাকতে হয়।
ভয়াবহ শিশু নিপীড়ন থেকে শুরু করে দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সমস্যা, নেশাজাতীয় দ্রব্যে আসক্তি ও অপরাধী চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার মতো বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকিতে আছে এসব শিশু।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) ২০১৬ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সালে সারাদেশে পথশিশুর সংখ্যা ছিল ১৫ লাখ। গবেষণার পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০২৪ সালের মধ্যে এই সংখ্যা বেড়ে হবে ১৫ লাখ ৬০ হাজারের মতো।
এসব শিশুদের ৭৫ শতাংশই রাজধানীতে থেকে আবর্জনা সংগ্রহের মতো বিপজ্জনক কাজের সঙ্গে জড়িত। তবে, এ ধরনের অসহায় শিশুদের পুনর্বাসিত করার জন্য সরকারের তেমন কোনো উদ্যোগ নেই বললেই চলে।
১৩ বছর বয়সী রাজুর কথা ধরা যাক। প্রায় পাঁচ বছর আগে, রাজুর সৎ মা তাকে বাসা থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার পর খিলক্ষেত থেকে একটি ট্রেনে চড়ে কারওয়ান বাজারে চলে আসে সে। তারপর থেকেই ওই এলাকার আবর্জনা কুড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে। কারওয়ান বাজারকেই নিজের বাসস্থান হিসেবে মনে করে রাজু।
রাজু বলে, ‘আমি কখনো স্কুলে যাইনি, তাই কিছু উপার্জনের জন্য শুধু এই কাজটাই পারি।’
সারাদিনের পরিশ্রমের পর রাজু কথা বলতে বলতে বস্তার ভেতরে ঢুকে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। যে বস্তায় করে সে সারাদিন ধরে আবর্জনা সংগ্রহ করে, তার মধ্যেই ঘুমায়। পরনের কাপড় ছাড়া তার একমাত্র সম্পত্তি এই বস্তা।
রাজু বলে, ‘ঘুমিয়ে পড়ার পর চুরি হয়ে যায় বলে সঙ্গে কিছুই রাখতে পারি না। এমনকি একটা পরিষ্কার ও সুন্দর শার্ট পরে ঘুমালেও সেটা কেউ গা থেকে খুলে নিয়ে যায়।’
রাজুর দিন শুরু হয় ভোর ৪টায়। জানায়, ‘আমি সবকিছুই সংগ্রহ করি—কাগজ, প্লাস্টিক, গ্লাস ও লোহার জিনিস। যখন রাস্তায় কিছু খুঁজে পাই না, তখন পয়ঃনিষ্কাশন লাইনে খুঁজি। দিনের শেষে আমরা সারাদিনের সংগ্রহ করা জিনিসপত্র ভাঙাড়ির দোকানে বিক্রি করি।’
ভবিষ্যতে কী করবে, জানতে চাইলে অনিশ্চিতের হাসি হাসে রাজু। ‘আমি লেখাপড়া জানি না। আমার কপালে কী আছে জানা নেই।’
তেজগাঁও এলাকার আরেক আবর্জনা সংগ্রহকারী মোহাম্মাদ সুমন (১৬) এ ব্যবসার নির্মম সত্যটি প্রকাশ করেন।
সুমন বলেন, ‘আমাকে অসংখ্যবার চোর সন্দেহে পিটিয়ে আধমরা করে দেওয়া হয়েছে। একদিন ফেলে দেওয়া হয়েছে মনে করে একটি প্লাস্টিকের পাত্র তুলে নিয়েছিলাম। কিন্তু কেউ আমার কথা বিশ্বাস না করে ‘চুরি’ করার অভিযোগে নির্দয়ভাবে পিটিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয়।’
যে দোকানদার তার কাছ থেকে কুড়িয়ে পাওয়া জিনিস কিনতেন, তিনি তাকে পরে উদ্ধার করেন। সুমনের মুক্তির জন্য তাকে ১০ হাজার টাকা খরচ করতে হয়। সেই টাকা শোধ করতে দুই বছর লেগেছিল সুমনের।
আবর্জনা কুড়ানোর সময় তারা কোনো ধরনের গ্লাভস, মাস্ক বা প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জাম ব্যবহার করে না। এর ফলে বিপজ্জনক সব আবর্জনা সংগ্রহের সময় নানা ধরনের রোগের সংক্রমণ ও আঘাত পাওয়ার ঝুঁকিতে থাকতে হয়।
কারওয়ান বাজারের রাজু আবর্জনা সংগ্রহ শুরুর প্রথম দিকে তিন মাস জন্ডিসে ভোগে। এখনো সে প্রায়ই জ্বর ও বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগে ভোগে।
সুমনের মতে, ‘তীক্ষ্ণ কাঁচ, ধাতু, সুই এসব নিয়ে কাজ করতে গিয়ে সংক্রামিত হওয়া আমাদের প্রতিদিনের ঘটনা। আপনি খুঁজলে আমার হাতে-পায়ে শত শত কাটা দাগ দেখতে পাবেন। তবে, আমরা খুব সহজে কঠিন রোগে আক্রান্ত হই না। আমার একবার জন্ডিস হয়েছিল কিন্তু তারপর দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠি।’
‘আমরা গ্লাভস, মাস্ক ও জুতা ব্যবহার করি না, কারণ আমরা সেগুলো রাখতে পারি না। চুরি করার জন্য সব সময়ই কেউ না কেউ থাকবে’, বলে রাজু।
এত রকমের ঝামেলা থাকার পরও তাদের এই কাজে নেই কোনো বিশ্রামের বিরতি বা ছুটি।
ঢাকার হাজারীবাগ ও ধানমন্ডী এলাকার তাইজুল (১২), ফাইজুল (১০) ও আট বছর বয়সী ইজাজুলের সঙ্গে কথা হয়। অসুস্থ মা-বাবা ও আরও দুজন ছোট ভাই-বোনকে সাহায্য করার জন্য তারা আবর্জনা সংগ্রহ করে। তারা টোকাইদের জন্য নির্দিষ্ট করা এলাকা সংক্রান্ত সমস্যাগুলোর ব্যাপারেও জানায়।
তাইজুল জানায়, তার বাবা অসুস্থ হওয়ার পর থেকে তাদের সপ্তাহের প্রতিটি দিনই কাজ করতে হচ্ছে, এমনকি ঈদের দিনেও। তারা যদি একদিন কাজ না করে তাহলে অন্য কোনো দল তাদের জায়গাটি দখল করে নেয়।
‘আমাদের মাসে বাড়িভাড়া বাবদ তিন হাজার টাকা দিতে হয়। বাবা পিঠের ব্যথার কারণে কাজ করতে পারে না। মাকে ছোট দুই ভাই-বোনের খেয়াল রাখতে হয়। কে আমাদের স্কুলের বেতন দেবে? আর যদি কাজ না করে স্কুলে যাই, তাহলে পুরো পরিবারকে খাওয়াবে কে?’, বলে তাইজুল।
ঝুঁকিপূর্ণ ও বিরামহীন এই কাজে যুক্ত থাকার পাশাপাশি অনেক শিশুই মরিয়া হয়ে বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কার্যক্রম যেমন, চুরি ও ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে তারা যখন দুই বেলা খাবারের ব্যবস্থা করার মতো যথেষ্ট পরিমাণ আবর্জনা সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়।
এছাড়া তারা ক্ষুধা থেকে বাঁচতে আরেকটি উপায়ের কথা জানায়, মাদক সেবন। অনেক শিশু স্বীকার করেছে তারা ক্ষণিকের জন্য ক্ষুধার যন্ত্রণা ভুলে থাকতে সস্তা নেশা জাতীয় দ্রব্য ব্যবহার করে। যেমন, আঠার ঘ্রাণ নেওয়া, ইত্যাদি।
দ্য ডেইলি স্টার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার প্রায় ২৫টি এমন শিশুর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারে তাদের প্রায় সকলেই বিভিন্ন নেশাজাতীয় দ্রব্যে আশক্ত। বেশিরভাগ শিশুই জানিয়েছে, তারা চামড়া ও রাবারের তৈরি উপকরণ জোড়া দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত একটি বিশেষ ধরনের আঠা থেকে তৈরি বাষ্প সেবন করে।
তারা এটাকে ‘ডান্ডি’নামে চেনে। তুলনামূলকভাবে সস্তা এই মাদক সেবনের সঙ্গে সঙ্গেই নেশা হয়। এর পাশাপাশি অনেকে গাঁজা ও হেরোইনেও আসক্ত।
রাজু বলে, ‘সব ধরনের মারধর ও নির্যাতন সহ্য করতে পারি, কিন্তু ক্ষুধার যন্ত্রণা বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারি না। যখন আমার ক্ষুধা লাগে কিন্তু খাবার কিছু থাকে না তখন আমি পাগলের মতো হয়ে যাই। এ অবস্থায় ক্ষুধা ভুলে থাকতে ডান্ডি অথবা গাঁজা খাই।’
এই শিশুদের বিপর্যস্ত জীবন নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সুলতানা শাহানা বানু দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, ‘দীর্ঘদিন ধরে বিষাক্ত উপকরণ ও মাদকদ্রব্যের সংস্পর্শে থাকলে ক্যান্সারের মতো বিভিন্ন ধরনের দীর্ঘস্থায়ী রোগ হতে পারে। এছাড়া দেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, যেমন লিভার, কিডনি, অগ্ন্যাশয়, এমনকি মস্তিষ্কেরও ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তারা ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস সংক্রমণের সহজ শিকারেও পরিণত হয়।’
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মারুফ বলেন, ‘যেহেতু এসব শিশুদের যত্ন নেওয়া ও দেখাশোনা করার জন্য কোনো উপযুক্ত অভিভাবক নেই। তাই বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য দুষ্কৃতিকারীরা সহজেই তাদের ব্যবহার করতে পারে।’
তিনি জানান, ‘এর ফলে এসব শিশুরা যথেষ্ট পরিমাণ আত্মবিশ্বাস ও সমাজে চলার মতো গুণাগুণ ছাড়াই বড় হবে। এছাড়া তারা স্বাভাবিক কার্যক্রমের ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়ে অসামাজিক মানুষে পরিণত হবে।’
চিল্ড্রেন’স চ্যারিটি বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের সভাপতি ব্যারিস্টার আবদুল হালিম বলেন, ‘টেকসই পরিবর্তন আনতে হলে সরকারকে প্রতিটি ওয়ার্ড অনুযায়ী পথশিশুদের তালিকা তৈরি করতে হবে এবং তাদের নিরবচ্ছিন্ন পুনর্বাসন প্রকল্পের মাধ্যমে খাদ্য ও শিক্ষা দিতে হবে। যদি এই দুটি মৌলিক চাহিদা পূরণ হয়, তাহলে তাদের অন্য কাজের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসবে।’
তিনি বলেন, ‘যদি কয়েকটি ওয়ার্ডে পরীক্ষামূলকভাবে এ ধরনের পুনর্বাসনের উদ্যোগ বাস্তবায়িত করা যায়, তাহলে বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান ও দানশীল ব্যক্তিরা এগিয়ে আসতে পারবেন।’
সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) সৈয়দ মো. নূরুল বাসির বলেন, ‘টেকসই পরিবর্তন আনার জন্য আমাদের আরও অবকাঠামো ও দক্ষ জনশক্তি প্রয়োজন, যাতে এই শিশুদের জন্য শিক্ষাদান কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়। বর্তমানে ২০০ আসন বিশিষ্ট একটি মাত্র শেল্টার রয়েছে মিরপুরে। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণ কর্মীর অভাবে সেখানে মাত্র ৫০ জন শিশু, তরুণ-তরুণী ও দরিদ্র নারী থাকতে পারছেন।’
ঢাকার সিটি করপোরেশনগুলো আবর্জনা সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনার উপযোগিতা বাড়ানোর জন্য কাজ করে যাচ্ছে যাতে এ উদ্যোগের ফলে এ সংক্রান্ত শিশুশ্রম বন্ধ হয়।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা, কমোডোর এম সাইদুর রহমান বলেন, ‘আমরা সুশৃঙ্খলভাবে ঢাকা শহরের আবর্জনা সংগ্রহের জন্য কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দিয়েছি। তারা যদি বেশিরভাগ আবর্জনা সংগ্রহ করতে পারে, তাহলে টোকাইরা সংগ্রহ করার মতো আবর্জনা খুঁজে পাবে না। এতে তাদের সংখ্যা কমে যাবে।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমোডোর বদরুল আমিন বলেন, ‘আমরা ময়লার ভাগাড়ে বর্জ্য পৃথকীকরণ ও পুনঃব্যবহার ব্যবস্থা বসাবো। যাতে ৭০ শতাংশ বর্জ্যকে পুনঃব্যবহার করা যায়।’
তিনি বলেন, ‘এ জন্য আমরা ইতোমধ্যে জমি পেয়েছি এবং প্রস্তাবটি বর্তমানে মন্ত্রণালয়ের বিবেচনাধীন অবস্থায় আছে। এই সুবিধাগুলো চালু হলে পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য পরিমাণে উন্নতি হবে এবং প্রথাগত উপায়ে সংগ্রহ ও পুনঃব্যবহার প্রক্রিয়ার জন্য আর তেমন কোনো আবর্জনা খুঁজেই পাওয়া যাবে না।’
প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান।
Comments