বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি: কীভাবে স্মরণ করব জাতীয় বীরকে

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির ইতিহাসে অনেক বীর রয়েছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাদের সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন। অন্যরা হয়তো তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে, কিংবা একাধিক ক্ষেত্রে শীর্ষে পৌঁছতে পেরেছেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বীরত্বগাথা সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে আমাদেরকে একটি দেশ এনে দিয়েছেন।

একটি দেশ বলতে আমরা এর ভৌগলিক সীমানা, মানুষ, ঐতিহ্য, খনিজ সম্পদ, প্রকৃতি, নদ-নদী, গাছপালা এবং সে দেশে বসবাস করা সব প্রাণীর সমষ্টিকেই বুঝি। এ ছাড়াও, একটি দেশ বলতে মানসিক বুদ্ধিবৃত্তিক উত্তরাধিকারকেও বোঝায়। একটি দেশের সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ বলতে দেশটির সম্ভাবনার সমষ্টিকে বোঝায়। যেখানে থাকবে সমৃদ্ধি, উন্নয়ন, এগিয়ে চলা, প্রতিকূলতা জয় করা, সুশাসন বা ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং সার্বিকভাবে আরও ভালো কিছুতে রূপান্তরিত হওয়া। এগুলোই একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দ্বার উন্মোচন করে, যেখানে শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের সবচেয়ে বড়, উজ্জ্বল এবং  প্রাসঙ্গিক নায়ক থেকে মহানায়ক হয়ে ওঠেন। আমরা সেই উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ, আংশিক কিংবা মোটেই অর্জন করতে পারবো কি না, তা আরেকটি প্রশ্ন। কিন্তু তিনি আমাদেরকে সেই দ্বার উন্মোচনের পথে নিয়ে গেছেন। এটা একটি চিরন্তন সত্য, যা আমাদের মনে চিরকাল অম্লান থাকবে।

কিন্তু সেই মহানায়ককে হত্যা করা হয়েছে ইতিহাসের ভয়ঙ্করতম বর্বরতার সঙ্গে। যে মানুষটি আমাদের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন, অন্তরের অন্তঃস্থলের আকাঙ্ক্ষা আর কাঙ্ক্ষিত চাহিদাগুলো পূরণ করেছেন এবং আমাদের রাজনৈতিক সত্ত্বাকে বৈশ্বিক বাস্তবতায় রূপান্তর করেছেন, কেন তাকে এতটা বর্বরতার সঙ্গে হত্যা করা হলো?

হত্যাকারীদের উদ্দেশ্য ছিল আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের নীতি, গণতন্ত্রের মূল্যবোধ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র এবং জাতীয়তাবাদের মূলনীতির ওপর আঘাত করা। তারা ইতিহাসকে বিকৃত করতে চেয়েছিলেন এবং একইসঙ্গে সম্ভব হলে আমাদের যা যা অর্জন তাও ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিলেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, তারা আমাদের উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ কেড়ে নিতে চেয়েছিলেন।

হত্যাকারীদের সঙ্গে গণতন্ত্রের কোনো রকম যোগসূত্র থাকতে পারে না। তারা ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করতেন না, তারা সমাজতন্ত্রকে বিকৃত করেছেন এবং জাতীয়তাবাদকে তাদের নিজেদের মতো করে সংজ্ঞায়িত করেছেন, যা তাদের মূল উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ বিপরীতে নিয়ে গেছে।

নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, জেনারেল জিয়াউর রহমানের সরকার বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের নিরাপদ রাখার লক্ষ্যে কাজ করেছে। তিনি তাদের ঘৃণ্য অপরাধের বিচার করতে দেশে ফেরানোর চেষ্টা না করে, বিদেশের মাটিতে তাদের চাকরি অব্যাহত রেখেছেন। এমনকি যখন তাদের একজন দেশে ফিরে সশস্ত্র বাহিনীতে শৃঙ্খলা ভঙ্গে মদদ দিয়েছিলেন, তখনও তার বিরুদ্ধে তেমন কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। শিশুরা কোনো ভুল করলে বড়রা যেমন ভ্রূকুটি করেন, তার ক্ষেত্রেও এমনই করা হয়েছিল। সবচেয়ে কলঙ্কজনক কাজটি হচ্ছে, তিনি ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলে কোনো উদ্যোগ নেননি। এ নিয়ে আমরা আগেও অনেকবার লিখেছি। এমনকি যখন খালেদা জিয়া ক্ষমতায় ছিলেন তখনও লিখেছি। এই অধ্যাদেশটি বঙ্গবন্ধুর স্বঘোষিত হত্যাকারীদের সাংবিধানিক সুরক্ষা দিয়েছে এবং এর ফলশ্রুতিতে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরণের আইনি ব্যবস্থা নেওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র দেশ হিসেবে অনেক বছর ধরে আমরা সর্বজনস্বীকৃত এই খুনিদের সাংবিধানিক সুরক্ষা দিয়েছি।

জেনারেল এইচ এম এরশাদ এতটা খোলামেলা ভাবে না হলেও খুনিদের তুষ্ট রাখার ক্ষেত্রে একই ধরণের নীতি অনুসরণ করে গেছেন। করদাতাদের অর্থে এক দেশ থেকে অন্য দেশে ঘুরে বেড়ানো খুনিদের বিচারের আওতায় আনার কোনো চেষ্টাই করেননি তিনি। এমনকি ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলেরও চেষ্টা করেননি।

খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালে ক্ষমতাসীন হয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে তার স্বামীর নির্ধারণ করে যাওয়া পথে চলেছে। কোনো দালিলিক প্রমাণ না থাকলেও তার তথাকথিত জন্মদিন উৎসব পালন করে শেখ হাসিনা ও তার বোনকে সুনির্দিষ্টভাবে কষ্ট দিয়ে গেছেন। একটি মর্মান্তিক হৃদয়বিদারক হত্যাকাণ্ডকে উপহাস করাই ছিল এই জন্মদিন পালনের তাৎপর্য। এখানে রুচিহীনতা ও সংবেদনশীলতার চরম ঘাটতিই দৃশ্যমান ভাবে পরিলক্ষিত হয়। তারা কী ভেবেছিলেন মিথ্যা জন্মদিন উদযাপনে সমগ্র জাতি এতটাই মগ্ন হয়ে থাকবে যে, তারা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার নিষ্ঠুর মর্মান্তিকতা ভুলে যাবে?

এই পুরো সময়কাল জুড়ে বঙ্গবন্ধুকে ধীরে ধীরে জনসাধারণের নজর থেকে সরিয়ে নেওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চলতে থাকে। যিনি বাংলাদেশের জন্মের রূপকার তার প্রতি ন্যুনতম শ্রদ্ধা প্রদর্শন তো দূরে থাক, ইতিহাস থেকে তার নাম মুছে ফেলার অনবরত প্রচেষ্টা চলেছে। দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি দিন— ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বরেও উচ্চারণ পর্যন্ত করা হত না বঙ্গবন্ধুর নাম।

এক পর্যায়ে ইতিহাসের বিকৃতি চরম আকার ধারণ করে  এবং মনে হচ্ছিল যেন নাৎসি পার্টির প্রোপাগান্ডা বিশারদ গোয়েবলস তার পূর্ণ অশুভ চরিত্র নিয়ে পুনর্জন্ম নিয়েছেন। জিয়ার আমলে হঠাৎ করে বাংলাদেশে লাখো মানুষকে নির্বিচারে হত্যার জন্য দায়ী ও গণহত্যার সূচনাকারী পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ইতিহাসের বই, স্কুলের পাঠ্য বই ও আনুষ্ঠানিক বর্ণনায় 'হানাদার বাহিনী' হিসেবে আখ্যায়িত করা শুরু হল। এ ছাড়াও, সেই সময়ে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরু হয়েছিল একটি রেডিও ঘোষণার মাধ্যমে, এ বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা চোখে পড়ে। ব্যাপারটি এমন, যেন দৃশ্যপটে জিয়া আসার আগে কিছুই হয়নি। ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু করে কয়েক দশকের সংগ্রাম, ভাষা আন্দোলন, সামরিক আইন (মার্শাল ল) বিরোধী আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন, ১১ দফা আন্দোলন— সব কিছুর অবদানকে মুছে ফেলা, বিকৃত করা ও অবমাননা করা শুরু হয়। কারণ এর সবগুলোতেই ছিল বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় ও কেন্দ্রীয় ভূমিকা।

বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ সমগ্র জাতিকে উদ্বুদ্ধ করতে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল চাঙ্গা রাখতে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে (প্রত্যক্ষ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় জানি, মুক্তিবাহিনীর সদস্য হিসেবে এটি আমাদের দৈনন্দিন অনুপ্রেরণার উৎস ছিল)। ভাষণটি এখন বিশ্বের বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যের অংশ। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত যারা ক্ষমতায় ছিলেন তাদের কাছে এই ভাষণের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। তাদের কার্যক্রমে মনে হতো, ৭ মার্চে কেউ কোনো ভাষণই দেননি।

ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণার অংশ হিসেবে বলছি, যতদূর মনে পড়ে, ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর অফিসে বসে হঠাৎ করে রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনতে পাই। সেদিন ২১ বছর পর প্রথমবারের মতো আমি ভাষণটি প্রকাশ্যে শুনে আবেগে আপ্লুত হয়ে পরি। স্মৃতিতে ২৫ বছর আগের সেই বিস্ময়কর দিনটিতে ফিরে যাই, যেদিন আরও লাখো স্বাধীনতাকামী মানুষের সঙ্গে আমি রেসকোর্স ময়দানে (এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জমায়েত হয়েছিলাম আমাদের মহান নেতা ও বীরের বক্তৃতা শোনার জন্য। নীরবে আমি শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানালাম আমাদেরকে এই অসামান্য উত্তরাধিকারটি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। তবে আমার মতে, এতো বছর ক্ষমতায় থাকার পর সরকারের এই সম্পদটির যথেচ্ছা ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরও বিচক্ষণতার পরিচয় দেওয়া উচিৎ।

আজকের বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর প্রতি স্তুতিবাক্যের সুনামি দেখে সেই সময়ের কথা মনে করাটা বেশি কষ্টকর, যখন তার নাম উচ্চারণই করা হতো না।

তাহলে কীভাবে স্মরণ করব এই জাতীয় বীরকে? বঙ্গবন্ধু নিজের লেখনিতেই বিবরণ দিয়ে গেছেন যে, কীভাবে তাকে স্মরণ করা উচিৎ। 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'তে ১৯৭৪ সালের ৩ মে তিনি লিখেছেন, 'একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি, একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙ্গালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি ও অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।' তার জন্য আমরা যে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করি, সেগুলো মানুষের হৃদয় ও মননে নির্মাণ করতে হবে এবং এগুলোকে ভালবেসে নির্মাণ করতে হবে। তার রাজনীতি অর্থপূর্ণ হয়েছে মানুষের প্রতি অবিচল দায়বদ্ধতা থেকে। যারা তাকে দেখেছেন, তার সঙ্গে রাজনীতি করেছেন, তার সঙ্গে কাজ করেছেন এবং যারা তার বিষয়ে পড়েছেন— সবাই নিশ্চিতভাবে জানেন যে, তিনি যা কিছু করেছেন সবই জনমানুষের জন্য। অর্থাৎ, জনগণের কল্যাণ সবসময়ই তার চিন্তা চেতনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল।

বর্তমান ও ভবিষ্যতের নাগরিকদের জন্য একটি উন্নত দেশ গড়তে আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, যাই করা হোক তা জনমানুষকে কেন্দ্র করেই করতে হবে। জনমানুষের কল্যাণ, উন্নয়ন, বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, শরীরের ও মনের স্বাধীনতার জন্য করতে হবে; বিশেষ করে মনের স্বাধীনতার জন্য।

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

Major trade bodies miss election deadline as reforms take centre stage

Elections at major trade bodies have missed the 90-day deadline as new administrators of the business organisations seek amendments to the governing rules.

16h ago