‘দেশের জনসাধারণ এত অবহেলা ডিজার্ভ করে না’

লকডাউন কি কেবল গরিবের জন্যে?
বৃষ্টিতে ভিজেই ওএমএসের ট্রাক থেকে পণ্য কেনার লম্বা সারি। ছবি: স্টার ফাইল ছবি

কথায়, গানে বিদ্যমান শ্রেণি ব্যবস্থাসহ সমাজের নানা অসঙ্গতিগুলোকে বার বার বিদ্ধ করে চলা শিল্পী কবীর সুমন একবার লিখেছিলেন, ‘সুবিধের খাটে আমাদের খুনসুটি/ শ্রেনীর সুবাদে সমঝোতা লুটোপুটি/ চুলোয় যাকগে যা আছে চুলোয় যাবার/ আমাদের আছে অঢেল খাবারদাবার’।

গরিবের ঘরে কিন্তু খাবার নেই। তাই পেটের ভাত জোটাতে সামান্য রোজগারের আশায় ‘কঠোর লকডাউন’ উপেক্ষা করে তাদের অনেকে নেমে আসছেন রাস্তায়। আর আটকে যাচ্ছেন জেল-জরিমানার জালে।

অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও নূর খান লিটন। ছবি: সংগৃহীত

বিপরীতে করোনাভাইরাসের প্রকোপ ঠেকাতে বাংলাদেশে গত ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া নতুন এই বিধি-নিষেধের সময় যত গড়াচ্ছে, ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় তত বাড়ছে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা। অথচ এসব গাড়িতে থাকা সুবেশী-সচ্ছল ব্যক্তিদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি পর্যন্ত হতে হয় না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন বিধি-নিষেধ কার্যকর করতে চার ধরনের আইন ব্যবহার করা হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে— সংক্রামক ব্যাধি আইন, মোটরযান আইন, ডিএমপি অ্যাক্ট ও মোবাইল কোর্ট আইন। শহরে সেনা, পুলিশ ও র‌্যাবের পাশাপাশি ৫০টিরও বেশি ভ্রাম্যমাণ আদালত কাজ করছেন। এ ছাড়া, রাজধানীর প্রবেশপথগুলো বাদেও নগরজুড়ে বসেছে শতাধিক তল্লাশি চৌকি।

ঢাকা মহানগর পুলিশের হিসাবে, লকডাউন অমান্য করে বাইরে বের হওয়ার অভিযোগে গতকাল ১১ জুলাই পর্যন্ত ঢাকায় মোট সাত হাজার ২৪৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যাদের প্রায় সবাই দরিদ্র।

আটকের পর এসব দরিদ্র মানুষকে ছাড়িয়ে নিতে পরিবারের লোকজন থানা কিংবা আদালত প্রাঙ্গণে ভিড় করছেন। সেখানে দালালের খপ্পরে পড়ছেন কেউ কেউ। সর্বোপরি ক্ষুধার যন্ত্রণা ছাপিয়ে ভোগান্তি আর নিগ্রহের শিকার হচ্ছে আটক ব্যক্তির পুরো পরিবার।

আবার নানা জায়গা থেকে আটক ব্যক্তিদের থানা থেকে গাড়িতে গাদাগাদি করে যেভাবে আদালতে নেওয়া হচ্ছে, তাতেও তৈরি হচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে— তাহলে এই লকডাউন কি কেবল গরিব ঠেকানোর জন্যে?

বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে কোডিভ-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী কমিটির মহাসচিব নূর খান লিটনের সঙ্গে।

তারা বলছেন, চলমান কঠোর বিধি-নিষেধ শুরুর আগে শহরের দরিদ্র মানুষের জন্যে খাবারের জোগান নিশ্চিত করা হয়নি। এ অবস্থায় লকডাউন ভঙ্গের অভিযোগে এখন যেভাবে তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, হয়রানি করা হচ্ছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আর একই ঘটনার বিপরীতে নগরের সুবিধাভোগী মানুষের প্রতি যে আচরণ, তা বিদ্যমান শ্রেণি বৈষম্যকে আরও বেশি প্রকট করে তুলছে।

এ বিষয়ে কোডিভ-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক নজরুল ইসলামের ভাষ্য, ‘লকডাউন কার্যকর করার জন্যে সুষ্ঠুভাবে তা পরিচালনা বা ব্যবস্থাপনার বিষয়টা নাই। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী গাড়ি আটকাচ্ছে, মানুষকে জরিমানা করছে। এটা করতে গিয়ে পেছনে লম্বা জ্যাম পড়ে যাচ্ছে। মানুষ আরও কাছাকাছি চলে আসছে। তারা সবকিছু করল, কিন্তু ভাইরোলজিক্যাল বিষয়টা মাথায় রাখল না, তা তো হবে না।’

বিএসএমএমইউর সাবেক এই উপাচার্য বলেন, ‘আমাদের দেশের জনসাধারণ এত অবহেলা ডিজার্ভ করে না। ওরা ইনফেকটেড হলে চিকিৎসা পাচ্ছে না, অক্সিজেন পাচ্ছে না। কেন দেড় বছর পর আমাদের এই অবস্থা থাকবে? জেলাতে তো বটেই। প্রতিটা উপজেলাতে পিসিআর ল্যাব করা উচিত ছিল। সেখান থেকে আক্রান্তদের আইসোলেশনের পাঠানো ও স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে তা দেখভালের ব্যবস্থা করা যেত।’

অধ্যাপক নজরুলের মন্তব্য, ‘কোনো ধরনের সুবিধা নিশ্চিত না করে কেবল অসচেতনতার কথা বলে, জেল-জরিমানার ভয় দেখিয়ে মানুষ ঠেকানো যাবে না। করোনাও ঠেকানো যাবে না।’

সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের অভিমত, ‘এখন একটা বাংলাদেশেই দুইটা বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়ে গেছে। একটা হলো ৯৯ ভাগ মানুষের। অন্যটা বাকি এক ভাগের। একই সমাজের ভেতর দুইটা সমাজ।’

এই বাম নেতা আরও বলেন, ‘আমরা সরকারকে বার বার বলছিলাম, যে কেবল প্রশাসনের ওপরে ও প্রচলিত ব্যবস্থার ওপরে ভর করে চললে করোনা থেকে দেশটাকে তো মুক্ত করা যাবেই না, বরং গরিব থেকে ধনী অভিমুখী সম্পদের স্থানান্তর আরও তীব্রতর হবে। সেটাই ঘটে চলছে এখন।’

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের মতে, ‘দেশে এখন লুটেরা ধনিক শ্রেণি, দুর্নীতিবাজ আমলা ও দুষ্টু রাজনীতিক মহলের রাজত্ব চলছে। নিজেদের সুখ-শান্তি নিশ্চিত করাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য। বাকিদের তারা খরচের খাতায় ফেলে রেখেছে।’

সেলিম বলেন, ‘কিন্তু এই আহাম্মকের দল জানে না, এই ৯৯ ভাগ মানুষ না থাকলে তাদের কাজের বুয়া থাকবে না, ড্রাইভার থাকবে না, তাদের চুল কাটার লোক থাকবে না।’

মহামারিতে বিদ্যমান শ্রেণি বৈষম্য আরও বেড়েছে মন্তব্য করে সেলিম বলেন, সরকারকে বাধ্য করতে হবে যাতে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের কৌশল নিয়ে করোনা মোকাবিলা করা যায়। জাতির সব শক্তিকে যেন এই কাজে নিয়োজিত করা যায়। সরকারের হাতে আমরা ছয় লাখ কোটি টাকা (করের অর্থ) দিয়ে দিয়েছি। বিপদের সময় এই টাকার ১০ শতাংশ হলেও তো খরচ করা উচিত। আমাদের কাছ থেকে টাকা নিলো তো সেবা দেওয়ার জন্যে। এই টাকা দরিদ্রদের জন্য খরচ করুক।’

এ বিষয়ে নূর খান লিটনের ভাষ্য, ‘যাদের আটক করে আদালতে নেওয়া হচ্ছে, তাদের প্রায় সবাই খেটে-খাওয়া মানুষ, গরিব মানুষ। তাদের পুরো দিন আটকে রাখা হচ্ছে। জরিমানা করা হচ্ছে। যারা জরিমানা দিতে পারছেন না, তাদের কয়েক ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রেখে ছাড়া হচ্ছে।’

‘আরেক দিকে আমরা দেখছি শহরময় ব্যক্তিগত গাড়ি। এই শ্রেণির প্রচুর লোক ঘোরাঘুরি করছেন। তাদের কাউকে কাউকে হয়তো জরিমানা করা হচ্ছে।’

এ অবস্থায় নূর খানের পর্যবেক্ষণ হলো, ‘মহামারির যে দৃশ্যপট আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, সেখানে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা অবশ্যই জরুরি। কিন্তু, সেটা সার্বজনীন হওয়া উচিত। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, এখানে খেটে-খাওয়া মানুষগুলোই কেবল দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। হেনস্তা হচ্ছেন। বিপরীতে যাদের আর্থিক সঙ্গতি ভালো, প্রাইভেট গাড়িতে চলাফেরা করেন, তাদের খুব কম সংখ্যককেই জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়তে হয়।’

এই মানবাধিকারকর্মীর অভিমত, ‘জরুরি ছিল গরিব মানুষের জন্যে খাবারের নিশ্চয়তা রেখে সর্বাত্মক লকডাউন কার্যকর করা। তাহলে এটা নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকত না। কিন্তু, দুর্ভাগ্য হচ্ছে খেটে খাওয়া, কর্মজীবী মানুষগুলোই এই ঘটনার শিকার হচ্ছে। রাষ্ট্রের তরফ থেকে যেটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’

আটক মানুষগুলোকে দেখতে ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলতে নূর খান অন্তত তিন দিন আদালত প্রাঙ্গণে গিয়েছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘আদালত প্রাঙ্গণে মানুষের সঙ্গে কথা বলে যেটা বুঝেছি, কোর্টে যাদের উপস্থাপন করা হচ্ছে, তাদের চেয়ে কয়েকগুণ মানুষকে রাস্তা থেকে উঠিয়ে নেওয়া হয়। যাদের এক ধরনের সমঝোতার ভিত্তিতে ছেড়ে দেওয়া হয়। আবার প্রথম দিকে এমন কথাও শোনা গেছে যে, কাউকে কাউকে থানা থেকেও ছেড়ে দেওয়া হয়েছে টাকা-পয়সার বিনিময়ে। এর মধ্যে দুই এক জন নির্যাতনের অভিযোগও তুলেছেন। গাড়িতে তোলার সময় ও থানায় নেওয়ার পর।’

নূর খান বলেন, ‘ঘটনা হলো একজন মানুষকে আটক করা হলে সেই দুর্ভোগ কিংবা হয়রানি তার একার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। আটক ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরাও এর শিকার হন। তাদের থানায় দৌড়াতে হয়, আদালতে দৌড়াতে হয়।’

এ ছাড়া আটক ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি সামনে এনে নূর খান আরও বলেন, ‘আটক মানুষগুলোকে যেভাবে গাড়িতে গাদাগাদি করে থানা কিংবা আদালতে নেওয়া হচ্ছে, সেখানে স্বাস্থ্যবিধি কিংবা সামাজিক দূরত্বের কোনো বালাই থাকছে না। থানার গারদে, আদালতের গারদেও একই অবস্থা দেখা যাচ্ছে।’

 ‘এতে যে উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র তাদের আটক করার কথা বলছে, সেই উদ্দেশ্যও চূড়ান্তভাবে ব্যাহত হচ্ছে।’

Comments

The Daily Star  | English

Khaleda acquitted in Zia Charitable Trust graft case

The HC scraped the trial court verdict that sentenced Khaleda and two others in the same case.

34m ago