চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের মনস্তত্ত্ব
চলতি বছরের ১৫ আগস্ট নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলায় চলন্ত ট্রেনে ছোড়া পাথরের আঘাতে আজমির ইসলাম নামের পাঁচ বছর বয়সী এক শিশুর একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়। এর আগে ২০১৩ সালে চট্টগ্রামে ভাটিয়ারী এলাকায় চলন্ত ট্রেনে বাইরে থেকে ছোড়া পাথরের আঘাতে নিহত হন প্রকৌশলী প্রীতি দাশ (২৪)।
রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন গত রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, সাম্প্রতিক সময়ে চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের প্রবণতা বেড়েছে। চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে ১১০টি। এসব ঘটনায় রেলের ক্ষতির পাশাপাশি আহত হয়েছেন ২৯ জন।
ট্রেনে পাথর ছুঁড়ে মারার মতো এমন প্রাণঘাতী ও নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ডের পেছনে যে মনস্তত্ত্ব কাজ করে, তা নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে।
তারা এই কর্মকাণ্ডকে দেখছেন 'মনোবিকৃতি' হিসেবে। যার মাধ্যমে পাথর নিক্ষেপকারীরা মূলত এক ধরনের অসুস্থ আনন্দ পেতে চান।
এ ব্যাপারে সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ ভাষ্য, সাধারণত দুই-তিনটা ঘটনার কারণে এটা হয়ে থাকে। প্রথমত যে পাথর নিক্ষেপ করছে, সে মনে করতে পারে যে, সে কোনো সামাজিক বা সোশ্যাল ইনজাস্টিসের মধ্যে আছে। অর্থাৎ তার প্রতি একটা অবিচার হচ্ছে। ট্রেন একটা জায়গা দিয়ে যাচ্ছে। সেটা তার সহ্য হচ্ছে না। তার ভালো লাগছে না। কারণ কোনো না কোনো জায়গা থেকে সে হতাশাগ্রস্ত।'
হেলাল উদ্দিন বলেন, 'হয়তো তার (পাথর নিক্ষেপকারী) পারিবারিক জীবনে কোনো হতাশা আছে। পেশাগত জীবনে কোনো হতাশা আছে। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর জন্য সে পাথরটা ছোঁড়ে। ট্রেন একটা সহজ লক্ষ্যবস্তু, নিরাপদ লক্ষ্যবস্তু। কারণ ট্রেন পাল্টা পাথর ছোঁড়ে না। সুতরাং সে সহজ জিনিসকে আঘাত করে। এর ভেতর দিয়ে সে হতাশাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে।'
ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের দ্বিতীয় কারণ হিসেবে 'অবজারভেশনাল লার্নিং' বা অন্যকে দেখে শেখার মতো একটা বিষয়কে হাজির করেন এই মনস্তত্ত্ববিদ। বলেন, 'এটাকে মাস সাইকোলজিও বলা যায়। গণমনস্তাত্বিক সাইকোলজি। গণপিটুনির ক্ষেত্রে যেটা ঘটে। যে লোকটিকে মারা হচ্ছে, তাকে হয়তো কেউ চেনেই না। কী কারণে মারছে সেটাও জানে না। দেখা যায়, একজন মার শুরু করলে পাঁচ-সাত জন তাকে মারা শুরু করলো।'
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, যে সব পয়েন্টে এগুলো ঘটছে সেসব এলাকার লোকজনের বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য আছে কিনা, সেটা জানাটা জরুরি। যেমন হরতাল হলে গাড়ি দেখলে তা পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এটা একটা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড হলেও তার পেছনে একটা উদ্দেশ্য থাকে। ফলে তারা সেটাকে অপরাধ মনে করে না। তাই যারা পাথর ছুড়ে মারছে তারাও এমন কিছু মনে করছে কিনা সেটা পরিষ্কার নয়।
তিনি আরও বলেন, 'আবার যারা পাথর ছুড়ছে, নিছক আনন্দের জন্যও তারা এটা করে থাকতে পারে। তারা ধরেই নেয় যে, এতে কেউ আহত হবে। এর ভেতর দিয়ে তারা একটা অসুস্থ আনন্দ পাচ্ছে। যেটা এক ধরনের মনোবিকৃতি।'
রেলওয়ে আইনের ১২৭ ধারা অনুযায়ী, ট্রেনে পাথর ছোড়া হলে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান আছে। ৩০২ ধারা অনুযায়ী, পাথর নিক্ষেপে কারও মৃত্যু হলে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। যদিও এসব আইনে কারও শাস্তির কোনো নজির নেই।
অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন মনে করেন, কেবল আইন করে বা শাস্তি দিয়ে এই প্রবণতা রোধ করা যাবে না। তিনি বলেন, 'এই প্রবণতা রোধ করতে হবে সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে। শোনা যাচ্ছে, পাথর নিক্ষেপ ঠেকানোর জন্য জানালায় নেট বসানো হচ্ছে। আমি মনে করি এটা কোনো সমাধান না। কারণ নেট বসানো হলে সেই নেটে পাথর মারবে। কাঁচটা রক্ষা পেল, মানুষের মাথা রক্ষা পেল। কিন্তু পাথর মারা তো বন্ধ হবে না।'
তার ভাষ্য, নেট বসানোর চেয়ে মেন্টাল সেফটিনেটটা জরুরি। এ জন্য মানুষের হতাশা, চাপ ও বিকৃতির জায়গাগুলো চিহ্নিত করতে সেগুলো পরিবর্তন করতে হবে।
রোববার রেলমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে দেশের প্রায় প্রতিটি রুটের নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় পাথর ছুঁড়ে মারার তথ্যও উল্লেখ করা হয়।
এ ব্যাপারে অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন বলেন, পাথর ছোঁড়ার এসব ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ওইসব এলাকার স্কুলশিক্ষক, ধর্মীয় নেতা, মসজিদ-মন্দিরের ইমাম, পুরোহিতদের সাহায্য নিতে হবে। স্থানীয় সরকারের সাহায্য নিতে হবে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের ভেতর দিয়ে একটা সচেতনতা তৈরি করতে হবে।
তার এই বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন অধ্যাপক কামাল। তিনি বলেন, 'কমিউনিটির সঙ্গে কাজ করা গেলে যারা এটা করছে তাদের মনস্তত্ত্ব আরও ভালোভাবে বোঝা যাবে। সে অনুসারে কমিউনিটি মেম্বারদের সঙ্গে কথা বলে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়াটাও সহজ হবে। জড়িতদের নিরুৎসাহিত করা যাবে।'
Comments