চট্টগ্রামে গণপরিবহনে শিশুশ্রমে বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি

ঝুঁকিপূর্ণভাবে সিএনজিচালিত অটোরিকশার পেছনে ঝুলে হেলপারের কাজ করে শিশুরা। ছবি: সংগৃহীত

মো. ফারুকের বয়স ২৬ বছর। হিউম্যান হলারের চালক হওয়ার গল্প বলতে গিয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। ১৩ বছর বয়সে কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রামে এসেছিলেন ফারুক। পরিবারের আর্থিক দুরবস্থার কারণে ওই বয়সে কাজের খোঁজে বের হতে হয়েছিল তাকে।

যাত্রী বেশে এই প্রতিবেদক তার চালক হওয়ার গল্প জানার আগ্রহ দেখালে ড্রাইভিং সিটে বসে ফারুক তার অতীতের কথা বলতে শুরু করেন।

'আমি ১৩ বছর বয়সে আমার দূর সম্পর্কের ভগ্নীপতির সঙ্গে কুমিল্লা থেকে এই চট্টগ্রাম শহরে এসেছিলাম। ভগ্নীপতি ছিলেন একজন অটো টেম্পো চালক। আমি তার সহকারী হিসেবে কাজ করতে শুরু করি। আসলে তাকে সহায়তা করার জন্য তিনি আমাকে নিয়ে এসেছিলেন। আমার পরিবার এত দরিদ্র ছিল যে, আমাকে আমার ছেলেবেলায় কাজ খুঁজতে হয়েছিল। আমার সমবয়সী ছেলেরা যখন পড়াশোনা করতো, অবসরে মাঠে খেলতো, তখন আমাকে গণপরিবহনে কাজ করতে হতো,' বলেন ফারুক।

দারিদ্রতার কারণে শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত

তিনি জানান, সহকারী হিসেবে কাজ করে তিনি দৈনিক ৮০ টাকা পেতেন। ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত কাজ করতে হতো তাকে। মাস শেষে বাড়িতে ১ হাজার টাকা পাঠাতে পারতেন।

শুরুর অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে ফারুক বলেন, 'একবার আমি চলন্ত টেম্পো থেকে পা পিছলে পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হয়েছিলাম। আমাকে ৩ মাস বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়েছিল সেসময়।'

ফারুক ১৭ বছর বয়সে চালক হন। তিনি বলেন, '৪ বছর সহকারী হিসেবে কাজ করার পর আমি নিজেই গাড়ি চালাতে শুরু করি। প্রথমে আমি অটো টেম্পো চালাতাম। এখন আমি হিউম্যান হলার চালাই। দিনে ৭০০ টাকা থেকে ৯০০ টাকা আয় হয়।'

ফারুকের মতো অনেক পরিবহন শ্রমিক কৈশরেই পরিবহণ খাতে কাজ শুরু করেন।

চকবাজার থেকে হালিশহর বড় পুল রুটে একটি হিউম্যান হলারে সহকারী ১৫ বছর বয়সী মো. মুসার (আসল নাম নয়) সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়।

তিনি জানান, পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করে দারিদ্র্যের কারণে ২ বছর আগে পরিবহন খাতে কাজ শুরু করেন। তিনি এখন দিনে ৩০০ টাকা আয় করেন।

সুযোগ পেলেই তিনি ড্রাইভিং শেখার চেষ্টা করেন জানিয়ে মুসা বলেন, 'আমার ওস্তাদ (চালক) আমাকে দিনের শেষ ট্রিপ শেষে গাড়িটিকে গ্যারেজে নিয়ে যেতে বলেন। এইভাবে আমি গাড়ি চালানো শেখার চেষ্টা করি।'

গণপরিবহনে ১৮ বছরের কম বয়সী শিশুরা কাজ করছে, এটি চট্টগ্রাম শহরের খুব সাধারণ দৃশ্য। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য শহরে আসেন। তাদের অধিকাংশই বিভিন্ন বস্তিতে আশ্রয় নেন। তাদের অনেকেই আবার তাদের কিশোর বয়সী সন্তানদের সঙ্গে করে নিয়ে আসেন এবং তাদেরকে বিভিন্ন আয়বর্ধক কাজে নিয়োজিত করেন। তাদের মধ্যে অনেকেই গণপরিবহনে কাজ খুঁজে পান।

গবেষক, সমাজবিজ্ঞানী এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য ড. মনজুর-উল-আমিন চৌধুরী পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, নগরীর গণপরিবহন খাতে ১৫ হাজার শিশু কাজ করছে। তাদের মধ্যে ৫৭ শতাংশ শিশু হেলপার কাম ড্রাইভার হিসেবে কাজ করে।

গবেষণাটি গত ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ের মধ্যে পরিচালিত হয়। গবেষণার অংশ হিসেবে ড. আমিন (যিনি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ঘাসফুলের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন) সাক্ষাতকারের জন্য মোট ৩৩৮ জন শিশুকে দ্বৈবচয়নের ভিত্তিতে নির্বাচন করেছিলেন। তারা সবাই বন্দরনগরীতে গণপরিবহন খাতে কাজ করে।

এ বিষয়ে ড. আমিন বলেন, 'সাক্ষাতকার নেওয়া শিশুদের ৯০ শতাংশ বলেছে যে, তারা পরিবারের দারিদ্র্যের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে।'

দারিদ্র্যের গভীরতার চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, 'করোনা মহামারি পরিস্থিতির কারণে ৩৭ শতাংশ শিশুর পরিবার গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে (বিপরীত অভিবাসন), কিন্ত তাদের শিশু সন্তানেরা শহরে পরিবহন খাতে কাজে নিয়োজিত থেকে যায়।'

পরিবহন খাতে কর্মরত এসব শিশু প্রায়ই নির্যাতন ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। ড. আমিন বলেন, 'সাক্ষাৎকার নেওয়া শিশুদের মধ্যে ৯১ শতাংশ নির্যাতনের শিকার হয়েছে এবং ১৩ শতাংশ যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে।'

ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া শিশুরা কীভাবে গাড়ি চালাচ্ছে জানতে চাইলে ড. আমিন জানান, তিনি তাদের এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তারা বলে যে, তারা কোনোভাবে এটা ম্যানেজ করেছে।

'শিশুরা টোকেন কেনার জন্য পরিবহন নেতাদের টাকা দেয়, যাতে তারা কোনো বাধা ছাড়াই যানবাহন চালাতে পারে। পরিবহন নেতারা চালকদের এই টোকেনগুলো সরবরাহ করে এবং তারাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোকে ম্যানেজ করে', বলেন তিনি।

ড. আমিন বলেন, 'বর্তমানে বন্দরনগরীর মোট ৭১ দশমিক ৯০ শতাংশ চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। আমরা ২০১৩ সালে একটি সমীক্ষা চালিয়েছিলাম, যেখানে দেখা গেছে যে, বন্দরনগরীর মোট ১৮ শতাংশ চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। পরবর্তীতে আমরা ২০১৮ সালে আরও একটি গবেষণা পরিচালনা করেছি এবং দেখা যায় যে, মোট ৩৯ শতাংশ চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল না। এখন এটা বেড়ে ৭১ দশমিক ৯০ শতাংশ হয়েছে।'

তিনি জানান, গত ৩১ মার্চ বন্দরনগরীতে ঘাসফুল আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে তার গবেষণাপত্রটি উপস্থাপন করা হয়।

ড. আমিন বলেন, 'প্রশাসন যদি লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানো বা জাল লাইসেন্স দিয়ে গাড়ি চালানো বন্ধ করতে পারে এবং শিশুদের যথাযথ শিক্ষা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে পুনর্বাসন করতে পারে, তাহলে পরিবহন খাতে শিশুশ্রম কমানো সম্ভব।'

এসব বিষয়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (ট্রাফিক) আব্দুল ওয়ারিশ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রায় ৫ বছর আগেও শিশুচালকদের প্রায়শই রাস্তায় দেখা গেলেও এখন শিশুচালক খুব একটা দেখা যায় না।'

'আমরা পরিবহনে কিছু শিশু পাই, যারা চালকের সহকারী হিসেবে কাজ করে। পুলিশ যখন গণপরিবহনে শিশুচালক বা হেলপারদের খুঁজে পায়, তখন তারা তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে, যাতে শিশুদের পুনর্বাসন করা যায়। কিন্তু বেশিরভাগ অভিভাবক দারিদ্র্যতার কারণে রাজি এতে রাজি হন না', যোগ করেন তিনি।

ড. আমিন বলেন, 'আমরা পরিবহন মালিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করি এবং তাদের পরিবহনে শিশুদের কাজে না লাগাতে বলি। পরিবহন খাতে শিশুশ্রমকে নিরুৎসাহিত করার জন্য আমাদের প্রচেষ্টা চলছে।'

কেন আইন প্রয়োগ করেন না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমরা শুধু পরিবহনের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারি এবং চালক বা হেলপারের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে হয়।'

Comments

The Daily Star  | English

You have crushed fascism, now strengthen democracy and press freedom

The Daily Star Editor Mahfuz Anam's appeal to the ‘new generation leaders’

12h ago