কার পক্ষে দুদক?
গত ৩ বছর ধরে নিরলসভাবে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান ও তদন্তের পাশাপাশি শরীফ উদ্দিন দুর্নীতি দমন কমিশনে চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজারে বিভিন্ন ব্যক্তি ও মহলের বিরুদ্ধে ২২টি মামলা দায়েরের সুপারিশ করেছেন।
ওই সুপারিশ অনুসারে দুদক কাজ না করলেও গত বছরের সেপ্টেম্বরে শরীফ উদ্দিনের বিরুদ্ধে ৩ জনের দায়ের করা অভিযোগের তদন্ত শুরু করতে সংস্থাটি সময় নেয়নি।
মজার বিষয় হচ্ছে, পূর্ববর্তী তদন্তে শরীফ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা ওই ৩ ব্যক্তিকে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট পরিচালনার সঙ্গে জড়িত থাকার পাশাপাশি কক্সবাজারে জালিয়াতি ও পেশিশক্তি ব্যবহার করে ভূমি অধিগ্রহণের প্রমাণ পেয়েছিলেন।
বুধবার দুদক শরীফ উদ্দিনকে উপসহকারী পরিচালকের পদ থেকে বরখাস্ত করার পর তার সহকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়, যারা তাকে একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান কর্মকর্তা হিসেবে জানেন। তাদের ভাষ্য, দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থানের মূল্য দিয়েছেন শরীফ।
বৃহস্পতিবার শরীফকে চাকরিচ্যুতির প্রতিবাদে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন দুদকের প্রায় ৫০ জন কর্মকর্তা।
২০২১ সালের জুন মাসে পটুয়াখালীতে বদলি হওয়ার আগে শরীফ সাড়ে ৩ বছর চট্টগ্রামের দুদক কার্যালয়ে কাজ করেন। চট্টগ্রামে থাকাকালে তিনি বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও মহলের বিরুদ্ধে ৫২টি দুর্নীতির মামলা করেন।
অবৈধভাবে অনেক রোহিঙ্গাকে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা ও তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার অভিযোগে গত বছরের জুনে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুদকের দায়ের করা মামলার বাদীও ছিলেন শরীফ।
আওয়ামী লীগ সমর্থিত কক্সবাজার পৌরসভার ক্ষমতাসীন মেয়র, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ১ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলর, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের একাধিক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং পুলিশের ৩ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা করে তিনি আলোচনায় আসেন।
শরীফ উদ্দিনের সহকর্মীরা বলছেন, তিনি সাবেক এক মন্ত্রীর ছেলে, কক্সবাজারের পিবিআই পুলিশ সুপার, সাবেক জেলা প্রশাসক, উপসচিব, ইউএনও, এসি ল্যান্ড ও পেট্রোবাংলার সাবেক পরিচালকসহ কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) মহাব্যবস্থাপক, বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে আর্থিক অভিযোগের তদন্তও করেছেন।
এ ছাড়া তিনি ২০১৯ সালে কক্সবাজারে জমি অধিগ্রহণ কেলেঙ্কারিতে ১৫৫ জনের বিরুদ্ধে পৃথক ৩টি অভিযোগপত্র দুদকে জমা দেন। যে ৩ জন শরীফের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন, তাদের নাম ওই ১৫৫ জনের ভেতর আছে। দুদক ওই অভিযোগপত্রগুলো অনুমোদন করেনি।
শরীফ ২০১৯ সালে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগ এনে কেজিডিসিএল কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ৮টি এবং 'অসাধু উপায়ে রাতারাতি' পদোন্নতি প্রদান, বিভিন্ন কোম্পানি ও সংস্থাকে অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ দেওয়ার জন্য ৭টি মামলা দায়ের করার সুপারিশ করেছিলেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শরীফের সহকর্মীদের ভাষ্য, মামলা দায়েরের অনুমোদন না দিয়ে দুদক অভিযোগগুলো পুনঃতদন্তের নির্দেশ দেয়। এমনকি এর কোনো কারণও দেখানো হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের কমিশনার (তদন্ত) জহুরুল হক বলেন, ঠিক কী কারণে পুনঃতদন্ত শুরু করা হয়েছিল, তা তিনি তাৎক্ষণিকভাবে মনে করতে পারছেন না। এরপর এ বিষয়ে আর কোনো মন্তব্য করেননি তিনি।
চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি শরীফ চট্টগ্রামে নিজ বাড়িতে ছিলেন। সেই সন্ধ্যায় তিনি যে ভবনে থাকেন, তার বেসমেন্টে তাকে কিছু লোক থামায়। তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার করা না হলে শরীফকে চাকরিচ্যুত করা হবে বলে হুমকি দেন তারা।
এ জন্য ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করার হুমকিও দেওয়া হয় তাকে।
এ বিষয়ে ওই রাতেই শরীফ নগরীর খুলশী থানায় একটি সাধারণ ডায়রি (জিডি) করেন। এরপর যথাযথ নিরাপত্তা চেয়ে দুদকে চিঠিও দেন তিনি। যার ১০ দিন পর তাকে বরখাস্ত করা হয়।
শরীফের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ
শরীফের বিরুদ্ধে দায়ের করা লিখিত অভিযোগের একটি কপি দ্য ডেইলি স্টারের হাতে এসেছে।
ব্যবসায়ী মো. ইদ্রিস, বেলায়েত হোসেন ও আইনজীবী নুরুল হক তার বিরুদ্ধে ৩টি পৃথক অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগে বলা হয়, টাকা না দিলে জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত বিষয়ে শরীফ তাদের ফাঁসানোর হুমকি দেন।
তারা আরও অভিযোগ করেন, শরীফ আদালতের পূর্বানুমতি ছাড়াই তার এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন বন্ধ (নো ডেবিট) করেছেন।
আরেক অভিযোগকারীর ভাষ্য, অভিযোগ প্রমাণে তথ্য সংগ্রহের জন্য শরীফ ব্যবসায়ী মো. ইদ্রিসকে রিমান্ডে নির্যাতন করেছেন।
জানুয়ারিতে, এই অভিযোগের তদন্তকারী দুদকের একজন কর্মকর্তা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেন, যেখানে ইদ্রিসের চিকিৎসা চলছিল।
গত ২৯ জানুয়ারি মেডিকেল অফিসার মো. মমিন উল্লাহ ভূঁইয়া স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পক্ষ থেকে দুদককে জানানো হয় যে, ইদ্রিসকে নির্যাতনের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
গত বছর ডেইলি স্টারে প্রকাশিত বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন অনুসারে, ইদ্রিস, নুরুল ও বেলায়েত কক্সবাজারে একটি ভূমি অধিগ্রহণ সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে আছে। যারা জমির মালিকদের বঞ্চিত করে দলিল জাল করে ও পেশিশক্তি খাটিয়ে জনগণের অর্থ লুট করে আসছে।
প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোর একটিতে বলা হয়, কাগজ জাল করে ও ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে ওই সিন্ডিকেট কেবল ২০২০ সালেই ২৯ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য গতকাল এই ৩ জনের কাউকেই পাওয়া যায়নি।
তদন্তকারী কর্মকর্তা ও চট্টগ্রাম দুদকের তৎকালীন উপপরিচালক (অফিস-২) মাহবুবুল আলম শরীফের বিষয়ে তার তদন্ত প্রতিবেদনে বলেছিলেন, 'নো ডেবিট' আদেশ আরোপ করা দুদকের বিধিমালার পরিপন্থী। আদালতের অনুমতি নিয়েই এটা করতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শরীফ জানান, তিনি কোনো আদেশ দেননি। বরং তিনি কিছু ব্যাংককে অনুরোধ করেছিলেন, যেন তাদের কিছু গ্রাহককে টাকা তুলতে না দেওয়া হয়।
গত রাতে শরীফ উদ্দিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি জনগণের অর্থ লুণ্ঠনের বিষয়টি বন্ধ করার অনুরোধ করেছি। এখানে আমার ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ ছিল না।' এ ছাড়া ইদ্রিসকে তিনি নির্যাতন করেননি বলেও জানান।
গত বছর একটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে ব্যর্থ হওয়ায় উচ্চ আদালতে যান অভিযোগকারী বেলায়েত হোসেন। এরপর হাইকোর্ট বলেন, ব্যাংকগুলোর কাছে রাখা শরীফের এমন অনুরোধ অবৈধ।
এ ছাড়া শরীফের বিরুদ্ধে জব্দকৃত ৯৪ লাখ টাকা নিজের কাছে রাখার অভিযোগও আনে দুদক।
এ ব্যাপারে শরীফ জানান, পটুয়াখালীতে কাজে যোগ দেওয়ার আগে তিনি চট্টগ্রামে দুদক কার্যালয়ে টাকা হস্তান্তর করে এসেছেন। বলেন, 'অফিসের ভল্টে জব্দ করা টাকা রাখার বিষয়টি খুবই সাধারণ একটি ব্যাপার'। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এটি অবহিত করা হয়েছিল বলেও জানান তিনি।
চট্টগ্রাম দুদকের পরিচালক মাহমুদ হাসান এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
Comments