কাঁদছে কুহেলিয়া
কক্সবাজারের কুহেলিয়া নদীর প্রায় ২৬ একর জমি ভরাট করে ২ লেনের সড়ক নির্মাণ করেছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)।
ব্যাপকভাবে দখলের কারণে মহেশখালীর মাতারবাড়ী ইউনিয়নের এক সময়ের প্রাণচঞ্চল এই নদীটি এখন সরু খালে পরিণত হয়েছে।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের আপত্তি সত্ত্বেও এখনো এই নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছে সওজ।
কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নাজমুল হুদা জানান, এই কাজের পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ণে সওজ নির্মাণকাজের জন্য পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল এই নদীর তীর ভরাট করার বিষয়টি গোপন করেছে।
দ্য ডেইলি স্টারের হাতে আসা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এ সংক্রান্ত একটি নথি অনুসারে, এই নদীর প্রাকৃতিক মূল্যের কারণে ভূমি মন্ত্রণালয় সড়ক নির্মাণের জন্য সওজের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল।
এছাড়া নথিতে দেখা যায়, কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নদীর ভূমি অধিগ্রহণের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো একটি প্রস্তাবে নদী এলাকাকে পুকুর ও ডোবা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
কুহেলিয়ার রাজঘাটা এলাকা থেকে ধলঘাটের মুহুরিয়াঘোনা পর্যন্ত ৭ দশমিক ৩৫ কিলোমিটারের এই সড়কটির নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে ২০১৮ সালের অক্টোবরে। আশা করা হচ্ছে, ২০২৩ সালের জুনে এটি শেষ হবে।
১৩ কিলোমিটার বিস্তৃত এ নদীটি সমুদ্র বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সুবিধা নিশ্চিতের পাশাপাশি এই এলাকার অনেক মানুষের জীবিকার উৎস। প্রচুর মাটি ফেলার কারণে এখন যেটি খালের মতো প্রবাহিত হচ্ছে।
গত বছরের জানুয়ারিতে পরিবেশ অধিদপ্তরের তদন্তে এই চিত্র বেরিয়ে আসে। সংস্থাটি দেখতে পায়, সওজ নদীটির প্রায় ২৬ একর জমি (১১ লাখ ১৯ হাজার বর্গফুট) ভরাট করে ফেলেছে। এই দখলদারত্বের হালনাগাদ তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে সূত্রগুলো বলছে, এরমধ্যে আরও নদী এলাকা দখল হয়ে গেছে।
জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার গত বছরের এপ্রিল মাসে নদীটি পরিদর্শন করেন। তিনি সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, সওজ যেভাবে নদীটি ভরাট করেছে, তা একটি ফৌজদারী অপরাধ।
এ প্রসঙ্গে নদীরক্ষা আইন ও সুপ্রিম কোর্টের আদেশের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'তারা (সওজ) নদীটির প্রশস্ততা ও গভীরতা কমিয়ে একেবারে শীর্ণ বানিয়ে ফেলেছে…তারা কোনোভাবেই নদীর স্রোত আটকাতে পারে না। কোনো নদীর প্লাবণভূমিও ভরাট করতে পারে না।'
সম্প্রতি সরেজমিন পরিদর্শনের সময় এই প্রতিবেদক দেখতে পান, রাজঘাটা সেতুর কাছে অনেক শ্রমিক রোলার মেশিন দিয়ে রাস্তা সমতল করার কাজ করছেন।
এর মধ্যে একজন শ্রমিক জানান, নির্মাণকাজ দ্রুত করার জন্য তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, 'এ জন্য আমরা দিন-রাত কাজ করছি।'
গত বছরের অক্টোবরের শেষ দিকে সওজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ও তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক ফজলে রাব্বী এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে জানান, তারা এ প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছেন।
তবে প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়নে সওজ কেন তথ্য গোপন করেছে, সে ব্যাপারে সরাসরি কোনো জবাব দেননি তিনি।
তিনি বলেন, 'প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার পর মাটি অপসারণ করা হবে। কিছু গড়তে হলে কিছু ভাঙতে হয়।'
ফজলে রাব্বী দাবি করেন, নির্মাণকাজের জন্য নদীর স্রোত বাধাগ্রস্ত হচ্ছে না। কারণ সড়ক তৈরি হচ্ছে প্লাবণভূমিতে। বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য যা স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া।
এর আগে ২০১৭ সালের আগস্টে সওজের হয়ে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন সড়ক নির্মাণের জন্য ৬২ একর জমি ইজারা দেওয়ার জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়কে একটি চিঠি দেয়।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গঠিত একটি কমিটির গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত এক সভার কার্যবিবরণী অনুসারে, এর প্রায় ৫৪ একর এলাকা হচ্ছে নদীর জমি।
এই পরিস্থিতিতে মন্ত্রণালয় সড়ক নির্মাণের ওই প্রস্তাব নাকচ করে দেয়।
গত বছরের অক্টোবরের শেষ দিকে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আমিন আল পারভেজ জানান, প্রকল্পটির জাতীয় গুরত্ব বিবেচনা করে এ সংক্রান্ত প্রস্তাব ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠান তারা।
তিনি বলেন, 'নদীর অবস্থা পরিবর্তনের জন্য মন্ত্রণালয় আমাদের আরেকটি প্রস্তাব পাঠাতে বলেছে।'
যোগাযোগ করা হলে গত বৃহস্পতিবার তিনি জানান, তারা এখন পর্যন্ত প্রস্তাবটি পাঠাননি। নদীর জমি এড়িয়ে সড়কটির নকশায় পরিবর্তন আনা হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, 'এর বিরুদ্ধে একটি রিট পিটিশন দাখিল করায় বিষয়টি এখন বিচারাধীন।'
অক্টোবরের শেষ দিকে দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (ভূমি অধিগ্রহণ) মো. সালেহ উদ্দিন বলেন, 'তারা (কক্সবাজার জেলা প্রশাসন) আমাদের কাছে কুহেলিয়া নদীর…অধিগ্রহণের প্রস্তাব পাঠায়, কাগজপত্রে যা নদী হিসেবে চিহ্নিত আছে। কেন আমরা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছি তা প্রকল্প পরিচালক ভালো করেই জানেন। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকেরও সেটি জানার কথা।'
ভূমি মন্ত্রণালয়ের আপত্তির বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক ফজলে রাব্বী বলেন, একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের জমিতে অন্য একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের সড়ক নির্মাণের ঘটনা এটি।
এমনকি সরকার এই প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণের জন্য ২৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে জানিয়ে তিনি এই কর্মকাণ্ডের ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করেন।
কনসালটেন্সি ফার্ম এসএমইসি বাংলাদেশের সাবেক সহকারী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম দাবি করেন, সড়কটি খাস জমিতে নির্মাণ করা হচ্ছে।
কাজ শুরুর জন্য সওজকে রাজঘাটা সেতু এলাকায় মাত্র ৩ একর ব্যক্তিগত জমি অধিগ্রহণ করতে হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'এখানে হয়তো এক সময় নদী ছিল। জোয়ারের পানি এখনো নির্মাণস্থল প্লাবিত করে। কিন্তু যখন জোয়ার থাকে না তখন প্রবাহও কম থাকে।'
মাতারবাড়ী এলাকার ভূমি রেকর্ড পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সিএস (১৮৮০), আরএস (১৯৩৮) ও বিএস (১৯৮০) জরিপে জায়গাটি নদী হিসেবে চিহ্নিত আছে।
মাত্র ৩ একর জমি অধিগ্রহণের পর এর জন্য বরাদ্দকৃত বাকি অর্থের কী হলো- জানতে চাইলে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আমিন আল পারভেজ অক্টোবরের শেষ দিকে বলেছিলেন, সেটা তিনি মনে করতে পারছেন না। জানিয়েছিলেন, ওই তথ্য ফাইলে আছে।
গত মাসে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানান, 'নদী থেকে দূরবর্তী অবস্থানে সড়ক নির্মাণের সুপারিশ করেছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।
'তাহলে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কীভাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আদেশ অমান্য করে নদী ভরাট করতে পারে?'- প্রশ্ন রাখেন তিনি।
নির্মাণপ্রতিষ্ঠান মীর আক্তার হোসেন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর নাসির হোসেনের ভাষ্য, তারা সরকারের দেওয়া পরিকল্পনা অনুসারে কাজ করছেন। তিনি বলেন, 'আমরা নিজেরা কোনো অ্যালাইনমেন্ট ঠিক করিনি।'
গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় নদীর স্রোত ফিরিয়ে আনতে একটি কমিটি গঠন করে।
কমিটি প্রমাণ পায় যে নদীটির 'আংশিক' ভরাট করা হয়েছে এবং সড়কটি 'নদীর দিকে কিছুটা এগিয়েছে'।
সভার কার্যবিবরণী অনুসারে এর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে কমিটি।
সভার ৩ দিন পর বেলার এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট কর্তৃপক্ষকে ৩ মাসের জন্য নির্মাণকাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। ২৮ সেপ্টেম্বর চেম্বার বিচারক হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করেন এবং কর্তৃপক্ষকে লিভ টু আপিল আবেদন করতে বলেন।
বিষয়টির নিষ্পত্তি এখনো হয়নি।
অনুবাদ করেছেন মামুনুর রশীদ
Comments